সোমবার, ১৩ নভেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

আত্মবিনাশের সহিংস রাজনীতি

মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার পিএসসি (অব.)

আত্মবিনাশের সহিংস রাজনীতি

নির্ভরযোগ্য তথ্যভিত্তিক ইতিহাসের বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে পাওয়া যুক্তিতর্ককে আমলে না নিয়ে যা কিছু করা হয় সেটিকে অন্ধত্ব ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। কোনো ব্যক্তি, পক্ষ বা নেতৃত্বকে যখন অন্ধত্বে পেয়ে বসে তখন তিনি যা কিছু করতে পারেন। সে পথ হয় আত্মবিনাশের পথ। আর সেটি যদি কোনো রাজনৈতিক পক্ষ বা নেতৃত্বের দ্বারা হয় তাহলে তাতে শুধু আত্মবিনাশই নয়, সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য অপূরণীয় ক্ষতির কারণ হয়। সব যুগের ইতিহাসেই এর সাক্ষ্য রয়েছে। বঙ্গবন্ধু অসমাপ্ত আত্মজীবনীর এক জায়গায় বলেছেন, নেতারা যখন ভুল করেন তখন তার খেসারত দিতে হয় সম্পূর্ণ জাতিকে, জনগণকে। একাত্তরে পাকিস্তানি শাসকরা সব যৌক্তিকতাকে উপেক্ষা করে সীমাহীন সহিংসতায় নেমেছিল বলেই স্বল্প সময়ের মধ্যে তাদের চূড়ান্ত পরাজয় ঘটে এবং পাকিস্তানের বিনাশ যাত্রা শুরু হয়। কথায় আছে ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না বলেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে। বিএনপির হরতাল ও জ্বালাও-পোড়াওয়ের মধ্যে গত ২৯ অক্টোবর বিকালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ভুয়া উপদেষ্টা জাহিদুল ইসলামকে বিএনপির পল্টন অফিসে নিয়ে আসা এবং তাকে নিয়ে বিএনপি নেতারা যা কান্ড করলেন তাতে স্পষ্টই বোঝা যায়, দলটি সব নৈতিকতা ও যৌক্তিকতাকে পদদলিত করে নিজেদের অন্ধত্ব ও রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটালেন। ডিজিটাল যুগে এমন আহম্মকিকে অন্ধ বিশ্বাস ছাড়া আর কী বলা যায়। বিএনপি এখনো বাংলাদেশের বড় এক রাজনৈতিক পক্ষ। তাদের জন্ম ও বিস্তার দুটোই হয়েছে সহিংসতার পথে। জিয়া-উত্তর সময়ে দুই মেয়াদে ক্ষমতায় থাকলেও সহিংসতার পথ পরিহার না করায় বিএনপির রাজনীতি টেকসই হওয়ার পর্যায়ে উন্নত হয়নি। পঁচাত্তরের আগস্টে বঙ্গবন্ধুকে এবং নভেম্বরে জেলের ভিতরে চার জাতীয় নেতাসহ মুক্তিযোদ্ধাদের যারা হত্যা করেছে তাদের পুরস্কৃত করার মধ্য দিয়েই বিএনপির যে রাজনীতি তার আবির্ভাব ঘটে। সহিংসতা আরও সহিংসতাকে ডেকে আনে। জিয়াউর রহমানের সাড়ে পাঁচ বছরের শাসনামল ছিল সহিংসতায় পূর্ণ। ২০-২১ বার জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে সেনা অভ্যুত্থানের চেষ্টা হয়। তার পরিণতিতে কয়েক হাজার সেনা ও বিমান বাহিনীর সদস্যকে প্রহসনের বিচারের মাধ্যমে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়, যার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ছিল মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭৭ সালের অক্টোবর মাসের অভ্যুত্থান চেষ্টার অভিযোগে মাত্র দুই মাসের মাথায় ১১৪৩ জন বিমান ও সেনা সদস্যের ফাঁসি কার্যকর হয় (মাসকারেনহ্যাস-বাংলাদেশ অ্যা লিগেসি অব ব্লাড, পৃ-১৪৮)। সহিংসতার পথ ধরে রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হওয়া জেনারেল জিয়াউর রহমানও নৃশংস সহিংসতার শিকার হয়েছেন, যা মোটেই কাম্য ছিল না। কিন্তু দানবের ধর্মই এটা, সৃষ্টিকারী প্রভুকেও দানব ছেড়ে দেয় না। এ বিষয়ে বাংলা সাহিত্যে অনেক বেদবাক্য আছে। আগুন নিয়ে খেলা করতে হয় না। প্রতিবেশীকে দংশন করার জন্য সাপ পালন করলে সে সাপ সুযোগ পেলে পালনকারীকেও ছোবল মারবে। পঁচাত্তরের পর ৪৮ বছর চলে গেছে। এ সময়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এবং আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট ও বাস্তবতার বিশাল পরিবর্তন ঘটেছে। কিন্তু বিএনপির কোনো পরিবর্তন হয়নি। তারা সেই একই সহিংসতার জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। সামরিক শাসকের রাজনীতি থেকে মুক্ত হতে পারেনি। পঁচাত্তরের খুনিরা জাতির পিতা, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ও জয় বাংলাকে যেভাবে পদদলিত করেছে, ২০২৩ সালে এসে বিএনপি একই কাজ করছে। পঁচাত্তরের পর জিয়াউর রহমান আত্মঘাতী সহিংসতার অনুঘটক দ্বিজাতিতত্ত্বকে বাংলাদেশে নতুনভাবে প্রতিষ্ঠা করেন। বিএনপি এখনো সেটিকে আঁকড়ে ধরে আছে। ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসার পর জামায়াত-বিএনপির ক্যাডার বাহিনী যখন হিন্দুদের দেশছাড়া করার জন্য সুপরিকল্পিত আক্রমণ চালায় তখনই তার প্রমাণ পাওয়া যায়। বঙ্গবন্ধু ও জেলহত্যার অসমাপ্ত মিশনকে সমাপ্ত করার জন্যই ২০০৪ সালে ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের ওপর গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। দ্বিজাতিতত্ত্বের বিদ্বেষে ২০০১-০৬ মেয়াদে জামায়াত-বিএনপি সরকার পাকিস্তানের প্রক্সি হয়ে ভারতের বিরুদ্ধে আন্তসীমান্ত সন্ত্রাসকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়, যা মানুষের সামনে আসে ২০০৪ সালে চট্টগ্রামে ১০ ট্রাক অস্ত্রের চোরাচালান ধরা পড়ার পর। যথেষ্ট সুযোগ থাকার পরও জিয়া-উত্তর বিএনপি সহিংস রাজনীতির পথ থেকে ফিরে আসেনি। রাজনৈতিকভাবে তাতে বিএনপির কোনো লাভ হয়নি। গত ২৮-২৯ অক্টোবর থেকে আবার সহিংসতার স্বরূপ নিয়ে মাঠে নেমেছে বিএনপি। বেসরকারি টেলিভিশনের সচিত্র প্রতিবেদন ও প্রধান দৈনিকগুলোর খবরে স্পষ্টই দেখা যায় বিএনপির কর্মী-সমর্থকরা বাসে-গাড়িতে আগুন দিচ্ছে। প্রধান বিচারপতির বাসায় আক্রমণ চালাচ্ছে। ২৮ অক্টোবর বিএনপির ৫০-৬০ জনকে দেখা গেল কাকরাইলের রাস্তায় ফেলে পুলিশ সদস্য আমিরুল পারভেজকে নৃশংসভাবে পিটিয়ে মারছে, যা দেখে বুঝতে কষ্ট হয় এরা বাংলাদেশের মানুষ। আরেকটি দৃশ্যে দেখা যায়, একজন পুলিশ সদস্যের হেলমেট কেড়ে নিয়ে সেই হেলমেট দিয়ে ওই পুলিশের মাথায় আঘাত করা হচ্ছে। বিএনপির একজন সিনিয়র নারীনেত্রী একটি টেলিভিশনের আলোচনায় বলেছেন, পুলিশকে হত্যা করলে দেশের মানুষ খুশি হয়। এ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে মনে হওয়াটা স্বাভাবিক যে, বিএনপির নেতা-নেত্রীদের হুকুমেই কর্মীরা পুলিশের ওপর হামলা করেছে। বিএনপির অঙ্গ-সংগঠন যুবদলের একজন নেতাকে দেখা যায় প্রেস লিখিত জ্যাকেট পরে গাড়িতে আগুন লাগাচ্ছে। পেছনে ফিরে তাকালে দেখা যাবে ২০১৩-২০১৫, এই সময়ে জামায়াত-বিএনপির ক্যাডার বাহিনী দেশব্যাপী পুলিশের ওপর হামলা চালিয়েছে এবং ডজনের ওপর পুলিশ সদস্যকে হত্যা করেছে। ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসের ৭ তারিখে দৈনিক জনকণ্ঠের প্রধান শিরোনাম ছিল, মানুষের নামে মানুষ পীড়ন। তাতে দেখা যায়, রাজশাহীতে পোশাক পরিহিত এবং দায়িত্বে নিয়োজিত দুই পুলিশ সদস্যের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে সেই অস্ত্র দিয়ে ব্যাপকসংখ্যক শিবিরকর্মী তাদের মাটিতে ফেলে পেটাচ্ছে। রাস্তায় পড়ে আছে অর্ধমৃত দুই পুলিশ সদস্য। পুলিশ বাহিনী রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। বাহিনীর দুই-চারজনের বিরুদ্ধে কারও অভিযোগ থাকতে পারে। কিন্তু কর্তব্যরত পুলিশকে রাস্তায় পিটিয়ে মেরে ফেলা এবং রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী কর্তৃক এই মর্মে মিডিয়ায় বলা হয় যে পুলিশকে হত্যা করলে মানুষ খুশি হয়, এর মানে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা। এটা রাষ্ট্র জননিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি। এ ধরনের কর্মকান্ডকে রাজনৈতিক আন্দোলন বলা যাবে না। এটা স্রেফ সন্ত্রাস। রাজনীতি একটা মহান ব্রত। এখানে সন্ত্রাসের কোনো স্থান নেই। সন্ত্রাসের মাধ্যমে কোনো রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হয় না। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন কেন্দ্র করে বিএনপি যে পথ ধরেছে সেটি নতুন কিছু নয়, ২০১৪-২০১৫ সালের অবিকল নকল। শত শত বাস, গাড়ি, দোকান ও রেলসহ জাতীয় সম্পদ ধ্বংস এবং প্রায় দেড় শতাধিক নিরীহ মানুষ হত্যা করে বিএনপি কি কিছু অর্জন করতে পেরেছে? বরং রাজনৈতিকভাবে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং আরও পেছনে চলে গেছে। কানাডার এক ফেডারেল আদালত ঘোষণা দিয়েছিলেন বাংলাদেশের বিএনপি একটি সন্ত্রাসী দল। অথচ ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেগম খালেদা জিয়াকে সরাসরি সমঝোতার যে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, সন্ত্রাসের পথে না গিয়ে সেটা গ্রহণ করলে অবশ্যই বিএনপি রাজনৈতিকভাবে লাভবান হতো, যে কথা এখন বিএনপির অনেক সিনিয়র নেতাও পরোক্ষভাবে স্বীকার করেন। বিএনপি নেতারা প্রায়ই বলে থাকেন, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ আন্দোলনের মাধ্যমে বিএনপি সরকারের পতন ঘটাতে পারলে বিএনপিও আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটাতে পারবে। সময়ের সঙ্গে সবকিছুর পরিবর্তন হয়। ২০১৪ সাল যেমন ১৯৯৬ সালের মতো ছিল না, তেমনি ২০২৩ সালে এসে ১৯৯৬ বা ২০১৪ সালের জায়গায় নেই।

সময়ের চেয়েও দ্রুতগতিতে সামগ্রিক পরিবেশ, পরিস্থিতি ও মানুষের মনোজগতের পরিবর্তন হচ্ছে। এই স্বাভাবিক অতি সত্যটিকে আমলে না নিয়ে বিএনপি ১৯৯৬ সালের উদাহরণ টেনে ২০২৩ সালে এসে সরকার পতন ঘটাবে এমন ধারণার যৌক্তিকতা ও উপযুক্ততা একদম নেই। দৈব কিছু ঘটলে সেটা ভিন্ন কথা। উপরন্তু ২০১৪ সালে বিএনপি রাজনৈতিকভাবে যতখানি শক্তিশালী ছিল সেটা এখন আর নেই। বিপরীতে আওয়ামী লীগ ও সরকারের অবস্থান সব বিচারেই ২০১৪ সাল থেকে অনেক শক্ত এবং নেতৃত্বের গ্রহণযোগ্যতা দেশ ও বিদেশে আগের যে কোনো সময়ের থেকে এখন অনেক বেশি। সংগত কারণেই প্রশ্ন ওঠে বিএনপি সব জেনেও কেন আবার সেই পুরনো ব্যর্থ সহিংসতার পথে যাচ্ছে। বিএনপির কাছে হয়তো এক ধরনের উত্তর আছে। কিন্তু বাইরে থেকে যা কিছু দৃশ্যমান তার বিচার-বিশ্লেষণে এমন সহিংসতায় নামার পেছনে কোনো যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায় না। আগের উদাহরণ থেকে বলা যায়, সহিংসতার মাধ্যমে নির্বাচন ও নতুন সরকার গঠন বিএনপি ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। নির্বাচনে যদি জনগণের অংশগ্রহণ থাকে এবং তাতে শতকরা ৪০ ভাগের ঊর্ধ্বে ভোট পড়ে তাহলে দেশে-বিদেশে কোথাও নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না। চলমান ভূ-রাজনীতির যে সমীকরণ তাতে নির্বাচনের পর গঠিত নতুন সরকারকে অভিনন্দন জানাতে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শক্তিগুলো সময়ক্ষেপণ করবে না। বাস্তবতাকে সবাই গ্রহণ করবে। একটি রাজনৈতিক দলের কাছে নির্বাচন, গণতন্ত্র, রাজনীতি ও রাষ্ট্র জিম্মি হয়ে থাকতে পারে না। ২০১৪ সালে সরকারের পক্ষ থেকে অনেক ছাড় দিয়ে সমঝোতার প্রস্তাব দেওয়ার পরেও সেটি অসৌজন্যমূলকভাবে প্রত্যাখ্যান করায় আওয়ামী লীগের কাছ থেকে পুনরায় ছাড় পাওয়ার প্রত্যাশা বিএনপি করতে পারে না। সহিংসতার পথ ত্যাগ করে নিয়মতান্ত্রিক শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের পন্থায় থেকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ অথবা অংশ না গ্রহণ, যে সিদ্ধান্তই নেয় সেটা বিএনপির জন্য অদূর ভবিষ্যতে রাজনৈতিকভাবে অনেক ইতিবাচক হবে। কিন্তু সহিংস রাজনীতি কেবলই আত্মবিনাশের দিকে নিয়ে যাবে।

 

লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক

[email protected]

সর্বশেষ খবর