বৃহস্পতিবার, ১৬ নভেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

সরব হয়েই নীরব কেন মেজর হাফিজ

মহিউদ্দিন খান মোহন

সরব হয়েই নীরব কেন মেজর হাফিজ

হঠাৎ করেই সরব হয়ে দেশবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন বিএনপি নেতা মেজর হাফিজউদ্দিন আহমদ (অব.) বীরবিক্রম। কিন্তু দুই দিন না যেতেই পুনরায় নীরবতা অবলম্বনের পথ বেছে নিয়েছেন। এমনকি রাজনীতি থেকে অবসরে যাওয়ার আভাসও দিয়েছেন। অবশ্য মেজর হাফিজকে আলোচনায় টেনে আনতে ভূমিকা রেখেছিলেন তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। ৬ নভেম্বর এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, শিগগিরই বিএনপি নেতা মেজর হাফিজের নেতৃত্বে নতুন আরেকটি দল হতে যাচ্ছে। তাঁর এ মন্তব্যে সর্বত্র চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। এমন একটা সম্ভাবনা বা আশঙ্কার কথা গত কিছুদিন থেকে অনেকের মনেই ছিল। কেননা, ভাইস-চেয়ারম্যান পদে অধিষ্ঠিত থাকলেও গত প্রায় তিন বছর তিনি একরকম স্বেচ্ছা নির্বাসনের মতো সময় পার করছিলেন। ফলে তিনি যদি এতদিনের অবজ্ঞা, অবমূল্যায়ন আর অপমানের প্রতিশোধ নিতে কোনো একটা পদক্ষেপ নেন তাতে অবাক হওয়ার কিছু ছিল না। তাছাড়া তাঁর রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে এমন রেকর্ড রয়েছে। সবারই স্মরণ থাকার কথা, ২০০৭ সালে ওয়ান-ইলেভেন নামের রাজনৈতিক সিডরে লন্ডভন্ড বিএনপিকে দখলের প্রক্রিয়ায় মেজর হাফিজ অন্যতম কুশীলব ছিলেন। ওয়ান-ইলেভেন সরকারের প্রত্যক্ষ মদদে ওই বছর ৩০ অক্টোবর মধ্যরাতে সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমানের বাসায় স্থায়ী কমিটির বৈঠকের নামে যে ‘পলিটিক্যাল ক্যু’ বা রাজনৈতিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বিএনপির নেতৃত্ব দখলের চেষ্টা করা হয়েছিল, মেজর হাফিজ তাতে জোরালো ভূমিকা রেখেছিলেন। রূপকথার সোনার কাঠির ছোঁয়ার মতো সরকারের নির্দেশনায় রাতারাতি তিনি বনে যান বিএনপির অস্থায়ী মহাসচিব। সাইফুর রহমানকে বানানো হয় ‘ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান’। সে রাতের ঘটনার আমি একজন প্রত্যক্ষ সাক্ষী। সরকার একটা কিছু ঘটাবে এটা টের পেয়ে দেলোয়ার ভাই, মানে মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন বাসা ছেড়ে অন্যত্র অবস্থান নিয়েছিলেন। আমি ছিলাম আমার এক পরিচিত বিএনপি সমর্থকের বাসায়। রাত ১২টার দিকে যখন টিভিতে খবরটি প্রচারিত হলো, অসংখ্য ফোনকল এলো আমার সেলফোনে। সবার একই জিজ্ঞাসা-তাহলে কি ম্যাডামকে ‘মাইনাস’ করা হলো দল থেকে? হতাশ নেতা-কর্মীদের বললাম ধৈর্য ধরতে। যোগাযোগ করলাম ভারপ্রাপ্ত দফতর সম্পাদক রিজভী আহমেদের সঙ্গে। কয়েকবার ফোন করার পর তাকে পেলাম। জিজ্ঞেস করলাম, কী করা যায় এখন। বললেন, মহাসচিবের বরাত দিয়ে যে কটা সম্ভব টিভি-চ্যানেল, পত্রিকা ও বার্তা সংস্থায় বলে দিন এটা বৈধ কোনো সভা নয়, আমরা এটা মানি না। আমি পাঁচ-ছয়টা টেলিভিশনে বলে দিলাম। একটু পরেই ফোন করলেন চ্যানেল আই-এর বার্তা বিভাগে কর্মরত সালেহ শিবলী। বললেন, মোহন ভাই, খবরটি আমরা স্ক্রলে দিয়েছি। তবে ভালো হয় যদি রিজভীর স্বকণ্ঠে এটা প্রচার করা যায়। একটু ব্যবস্থা করুন। আবার ফোন করলাম রিজভীকে। সালেহ শিবলীর ফোন নম্বর দিয়ে বললাম, শিবলী ফোন করলে যেন স্টেটমেন্টের মতো একটি বক্তব্য দেন, যা ওরা রেকর্ড করে প্রচার করবে। এর আধা ঘণ্টার মধ্যে চ্যানেল আই-এ রিজভীর কণ্ঠে মহাসচিবের বিবৃতি প্রচারিত হলো। তার পরের ইতিহাস সবারই জানা। পরদিন বারডেম হাসপাতালে নাকে-মুখে নল লাগানো গুরুতর অসুস্থ মহাসচিব দেলোয়ার হোসেনের সেই সাহসী সংবাদ ব্রিফিংয়ের কথা কারও ভুলে যাওয়ার কথা নয়। পরে অনেকেই আমাকে বলেছেন, ওই রাতে রিজভীর স্বকণ্ঠে প্রচারিত মহাসচিবের বিবৃতি বিএনপির হতাশ নেতা-কর্মীদের সাহস ফিরিয়ে দিয়েছিল। তারা এটা জেনে স্বস্তি পেয়েছিলেন, খালেদা জিয়াই দলের চেয়ারপারসন পদে অধিষ্ঠিত আছেন। মূলত আমাদের ত্বরিত সিদ্ধান্ত এবং পদক্ষেপের কারণেই সেদিন বিএনপি নিশ্চিত ভাঙন এবং বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেয়েছিল; যদিও পরবর্তী সময়ে দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব তা মনে রাখেননি। শৃঙ্খলা ভঙ্গ এবং দলের স্বার্থবিরোধী তৎপরতার জন্য ওইসব কুশীলবকে কোনো শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়নি। সাইফুর রহমান স্থায়ী কমিটির সদস্য আর মেজর হাফিজ সহসভাপতি পদে বহাল তবিয়তেই ছিলেন। সাইফুর রহমান আজ পৃথিবীতে নেই। তবে মেজর হাফিজ দলের ভাইস-চেয়ারম্যান হিসেবে আছেন। রাজনীতিতে আসার আগে থেকেই মেজর হাফিজ নামটি মশহুর ছিল। বিশেষ করে সত্তর দশকে যারা ঢাকাই ফুটবলের দর্শক ছিলেন তারা এ নামটির সঙ্গে বেশ পরিচিত ছিলেন। ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব ও জাতীয় দলের এ স্ট্রাইকার সুনাম কুড়িয়েছিলেন একজন দক্ষ ও কুশলী খেলোয়াড় হিসেবে। একটি ঘটনার কথা মনে পড়ছে। ১৯৭৭ সাল। ঢাকা স্টেডিয়ামে মোহামেডান আর অন্য একটি দলের খেলা। মেজর হাফিজের দেওয়া একটি গোল রেফারি সম্ভবত অফসাইডের অজুহাতে নাকচ করে দেন। এ নিয়ে রেফারির সঙ্গে প্রচণ্ড তর্ক-বিতর্ক। হঠাৎ মেজর হাফিজ গায়ের জার্সি খুলে ছুড়ে মারলেন রেফারির মুখে। উপহার পেলেন লালকার্ড। লালকার্ড পেয়ে রেফারিকে ডান হাতের বুড়ো আঙুল দেখিয়ে মাঠ ত্যাগ করেন তিনি। পরদিন দৈনিক সংবাদ মেজর হাফিজের বুড়ো আঙুল দেখানো সে ছবিটি বেশ বড় করেই ছেপেছিল।

সেনাবাহিনী এবং খেলার মাঠ ছেড়ে মেজর হাফিজ একসময় অবতীর্ণ হন রাজনীতির মাঠে। তারও আগে সেনাবাহিনীতে থাকতে জড়িয়ে ছিলেন এক বিতর্কিত ঘটনায়। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে যে ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছিল, তাতে জড়িত ছিলেন মেজর হাফিজও। সে সময় তিনি ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে ৪৬ পদাতিক ব্রিগেডের ব্রিগেড মেজর হিসেবে কর্তব্যরত ছিলেন। কমান্ডার ছিলেন কর্নেল শাফায়াত জামিল। ৩ নভেম্বরের ব্যর্থ অভ্যুত্থানে মেজর হাফিজের সরব উপস্থিতি ও ভূমিকার বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে একই ঘটনার অন্যতম কুশীলব মেজর নাসির উদ্দিনের ‘বাংলাদেশ : বাহাত্তর থেকে পঁচাত্তর’ গ্রন্থে। যা হোক, মেজর হাফিজ রাজনীতির মাঠে তাঁর পদচারণা শুরু করেন জাতীয় পার্টির মাধ্যমে এবং ভোলার লালমোহন-তজুমুদ্দিন আসন থেকে ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালে এমপি নির্বাচিত হন। ১৯৯১ সালে তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হয়ে বিএনপিতে যোগ দেন ও প্রতিমন্ত্রী হন। এরপর ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের নির্বাচনেও তিনি একই আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং খালেদা জিয়া সরকারের মন্ত্রী ছিলেন। ২০২০ সালের ১৪ ডিসেম্বর দলের একটি অনুষ্ঠান শেষে মেজর হাফিজ এবং আরেক ভাইস-চেয়ারম্যান সাংবাদিক নেতা শওকত মাহমুদ হঠাৎ করে পল্টন মোড়ে রাস্তা অবরোধ করার চেষ্টা করেন সরকারের পদত্যাগের দাবিতে। কিন্তু ব্যর্থ হন। দলের পূর্বানুমতি ব্যতিরেকে ‘হঠকারী’ ওই কাজের জন্য শোকজ নোটিস পান দুজনেই। জবাবও দেন সময়মতো। তবে জবাব সন্তোষজনক না হওয়ায় শওকত মাহমুদ বহিষ্কার হন দল থেকে। আর মেজর হাফিজ থেকে যান পর্যবেক্ষণে। তবে তারপর থেকে দলে তার অবস্থান ছিল অনেকটাই নড়বড়ে। একরকম নীরবেই কেটে যাচ্ছিল তাঁর সময়। গত তিন বছরে দলের কোনো কর্মসূচিতে তাঁর সরব উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়নি। এবার তথ্যমন্ত্রীর সাম্প্রতিক উক্তির পরেই আবার আলোচনায় আসেন মেজর হাফিজ। পরদিন তথ্যমন্ত্রীর বক্তব্য সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি সাংবাদিকদের জানান, ‘যদি বিএনপি নির্বাচনে না যায়, তখন সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেব। তবে আমি খুবই অসুস্থ। সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) এবং সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা করিয়েছি। আবারও সিঙ্গাপুর যাব। বর্তমানে আমি রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি। (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ৮ নভেম্বর, ২০২৩)। তিনি তৃণমূল বিএনপি নামে কোনো দলকে চেনেন না এবং সে দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার সম্ভাবনাও নাকচ করে দেন। এর দুই দিন পরেই একেবারে ইউটার্ন করেন মেজর হাফিজ। বনানীর নিজ বাসায় এক সংবাদ সম্মেলন করে নিজের অবস্থান এবং দলের করণীয় সম্পর্কে খোলামেলা কথা বলেন তিনি। বিএনপিতেই থাকবেন উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, ‘আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতায় হলেও বিএনপির নির্বাচনে যাওয়া উচিত’। তাঁর মতে, ‘জিয়াউর রহমানের আদর্শ থেকে দূরে সরে যাওয়ার কারণে বিএনপি ক্ষমতার বাইরে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। বিএনপিতে সত্যি কথা বলার মতো লোক, বিশেষ করে চেয়ারপারসনের সামনে সত্যি কথা বলার মতো লোক চোখে পড়েনি। অনেক আগে সাইফুর রহমান সাহেব বলতেন। তাঁকে দুই চারবার সত্যি কথা বলতে দেখেছি। এ ছাড়া কোনো নেতা ‘ইয়েস স্যার, রাইট স্যার’ বলা ছাড়া আর কোনো কিছু জানেন না। (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ৯ নভেম্বর, ২০২৩)। সংবাদ সম্মেলনে মেজর হাফিজ বিএনপির কিছু কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করে বলেন ‘এভাবে কোনো রাজনৈতিক দল চলে না।’ তিনি তারেক রহমানকে দল সংস্কার করার জন্যও আহ্বান জানান। সংবাদ সম্মেলনে মেজর হাফিজের বক্তব্য এখন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলে আলোচনার অন্যতম বিষয়বস্তু। তথ্যমন্ত্রীর মন্তব্যের বিষয়ে গণমাধ্যমকে নিজের বক্তব্য দেওয়ার এক দিন পরেই কেন তাঁর আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন করার প্রয়োজন পড়ল তা নিয়েও কানাঘুষা রয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, বিশেষ একটি টেলিফোন-বার্তার পরেই তিনি সংবাদ সম্মেলন ডেকেছিলেন। ওই বার্তায় নাকি তাঁকে বলা হয়েছিল, গণমাধ্যমে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করে বলার জন্য। কিন্তু তা করতে গিয়ে তিনি পুনরায় যে নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন তা তাকে কোন বিপদে ফেলে বলা যায় না। লক্ষ্য করলে প্রতীয়মান হবে, তিনি যে কথাগুলো বলেছেন, তার প্রায় সবই বিএনপির বর্তমান রাজনৈতিক স্ট্যান্ড বা স্ট্র্যাটিজির সম্পূর্ণ বিপরীত। যেমন বিএনপি শেখ হাসিনার পদত্যাগ এবং এ সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্তে অনড়-অটল। পক্ষান্তরে মেজর হাফিজ বলেছেন বিএনপির নির্বাচনে যাওয়া উচিত। তাছাড়া ‘এভাবে দল চলে না’ এবং সংস্কারের কথা বলে তিনি নতুন করে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের বিরাগভাজন হন কি না সে প্রশ্ন সচেতন মহলে দেখা দিয়েছে। এরপর যদি মেজর হাফিজ তাঁর দলের কাছ থেকে আরেকটি কারণ দর্শাও নোটিস পান এবং তার সূত্র ধরে ‘বহিষ্কার গিলোটিনের’ শিকার হন তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। বিএনপিতে সত্যি কথা বলার লোক নেই বলে যে মন্তব্য করেছেন মেজর হাফিজ, তা একেবারে অমূলক নয়। তবে অনেকেই আছেন যারা সত্যি বলতে গিয়েও বলতে পারেন না। এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনায় না গিয়ে বিশ্বব্যাপী প্রচলিত এটি গল্প বলেই ক্ষান্ত দিতে চাই। জোসেফ স্ট্যালিনের মৃত্যুর পরে সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রপ্রধানের পদে বসেন নিকিতা ক্রুশ্চেভ। এক দিন মন্ত্রিসভায় তিনি স্ট্যালিনের বিভিন্ন কাজের তীব্র সমালোচনা করছিলেন। এ সময় উপস্থিত একজন মৃদুস্বরে বলে ওঠেন, ‘আপনিও তো সে সময় মন্ত্রী ছিলেন, তখন বলেননি কেন?’ ক্রুশ্চেভ গলা উঁচিয়ে বললেন, ‘কে, কে বললেন এ কথা?’ সবাই নিশ্চুপ। হলঘরে পিনপতন নিস্তব্ধতা। খানিক পরে স্মিত হেসে ক্রুশ্চেভ বললেন, ‘আজ আপনি যে কারণে চুপ, একই কারণে সেদিন আমিও কিছু বলিনি।’ আকেলমান্দ কা লিয়ে ইশারাই কাফি হ্যায়।

লেখক : সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক

সর্বশেষ খবর