বৃহস্পতিবার, ১৬ নভেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

কৃষিতে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের উপায় কী

মুনাওয়ার মাহতাব

কৃষিকে ঘিরেই মানবসভ্যতার জাগরণ শুরু। কৃষি পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং আদিতম বিষয়গুলোর অন্যতম। মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সংশ্লিষ্টতায় কৃষির বিকল্প নেই। কৃষিই পৃথিবীর মূল চালিকাশক্তি। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা ও বিনোদনের অধিকাংশ উপাদান আসে এ কৃষি থেকেই। ফসল উৎপাদন, পশুপাখি পালন, মাছ চাষ এবং বনায়নের জন্য মাটির জৈবিক ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনাই হলো কৃষি। কৃষিকাজ মানবজাতির আদিতম পেশা। এ কৃষিকার্য প্রচলনের ইতিহাস হাজার বছরেরও পুরনো। কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকা শক্তি। অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০২০ অনুযায়ী কৃষির ওপর নির্ভরশীল- ৪০.৬ শতাংশ মানুষ। বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষির ওপর ৮০ ভাগ লোক নির্ভরশীল। তাই বাংলাদেশের কৃষিকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে কৃষকদের বিস্তার জ্ঞান লাভ করা প্রয়োজন।

কৃষিকে একটি উড়ন্ত পাখি কল্পনা করলে পাখিটির মাথাকে কৃষি শিক্ষা এবং ডানা দুটিকে যথাক্রমে কৃষি গবেষণা এবং কৃষি সম্প্রসারণের সঙ্গে তুলনা করা চলে। পাখিটিকে সুষমভাবে ওড়ার জন্য মাথার সঙ্গে ডানাদ্বয়ের সমন্বয় একান্ত প্রয়োজন। তেমনি কোনো দেশের কৃষির সুষম উন্নয়নের জন্য উচ্চতর কৃষি শিক্ষার সঙ্গে কৃষি গবেষণা এবং কৃষি সম্প্রসারণের সমন্বয় অপরিহার্য। কৃষি শিক্ষা, বিশেষত দেশের উচ্চতর কৃষি শিক্ষা বিভিন্ন সময়ে নানা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়েছে। দেশে কৃষি শিক্ষার প্রথম ও মজবুত বুনিয়াদ গড়ে ওঠে ১৯৩৮ সালে তদানীন্তন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক কর্তৃক ঢাকার মণিপুর ফার্মে (বর্তমানে শেরেবাংলা নগর) বেঙ্গল কৃষি ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। রয়েল এগ্রিকালচারাল কমিশনের পরামর্শক্রমে প্রতিষ্ঠিত এ ইনস্টিটিউট ছিল তৎকালে প্রদেশে উচ্চতর কৃষি শিক্ষার একমাত্র প্রতিষ্ঠান।

বাংলাদেশে উচ্চতর কৃষি শিক্ষার বৃহৎ বিদ্যাপীঠ ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, যা ১৯৫৯ সালে জাতীয় শিক্ষা কমিশন এবং খাদ্য ও কৃষি কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ ১৯৬১-এর আলোকে ১৯৬১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৮০ সালে বিএসসি, এজি ডিগ্রি দানের লক্ষ্যে গাজীপুরের সালনায় বাংলাদেশ কৃষি বিজ্ঞান কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি কয়েকবার পুনর্বিন্যস্ত হয়েছে। ১৯৮৩ সালে কৃষির বিভিন্ন শাখায় এমএসসি, এজি এবং পিএইচডি ডিগ্রি দেওয়ার জন্য এটির নতুন নামকরণ হয় স্নাতকোত্তর কৃষি শিক্ষা ইনস্টিটিউট (ইনস্টিটিউট অব পোস্ট গ্র্যাজুয়েট স্টাডিজ ইন এগ্রিকালচার-ইফসা)। সর্বশেষ ১৯৯৮ সালে একে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় নামে পূর্ণাঙ্গ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে রূপান্তরিত করা হয়।

স্বাধীনতা-উত্তর দেশের ক্রমবর্ধমান চাহিদার ভিত্তিতে বেশ কয়েকটি নতুন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও কৃষি শিক্ষা কার্যক্রম সম্প্রসারণ করা হয়েছে। কিন্তু দেশের চলমান খাদ্য সংকটের আজকের বাস্তবতায় উচ্চতর কৃষি শিক্ষার গুণগতমান নিয়ে মূল্যায়ন করা উচিত। দেশের ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর আগামীর খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করার স্বার্থে এখনই এ বিষয়ে যথাযথ গুরুত্বারোপ করার কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশের মোট ১৮টি এ টি আই (কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট) রয়েছে। যেখানে শিক্ষার্থীদের হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়ে থাকে। এ ছাড়াও সারা দেশে বেসরকারি প্রায় ১৫০টিরও ঊর্ধ্বে এ টি আই রয়েছে। যেখানে শিক্ষার্থীরা কৃষি বিষয়ক সম্যক জ্ঞান অর্জন করে থাকে। যেটিকে বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক চার বছরমেয়াদি কৃষি ডিপ্লোমা বলা হয়ে থাকে। আর এই কৃষিতে উচ্চশিক্ষা নিয়ে কৃষকদের সহযোগিতা করার মূল লক্ষ্যই কৃষি ডিপ্লোমাবিদদের।

যোগ্যতম মানবসম্পদ গড়ার জন্য গুণগত উচ্চশিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। কৃষি শিক্ষাকে আরও বেশি বাস্তবধর্মী ও সময়োপযোগী করার জন্য এর বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার প্রয়োজন। আর এ জন্য প্রথমেই প্রয়োজন কৃষি শিক্ষার সঙ্গে গবেষণা ও সম্প্রসারণ বিভাগের কার্যকর সমন্বয় সাধন। বর্তমান চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে কৃষির নতুন নতুন কোর্স ও ডিগ্রি সমন্বয় করা প্রয়োজন। এ ছাড়া থাইল্যান্ডের মতো কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে দেশের সব ধরনের কৃষিবিষয়ক প্রশিক্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে আনতে হবে।

কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে মাঠপর্যায়ের কৃষক এবং কৃষি উপকরণ সরবরাহকারী ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করা জরুরি।

যেখানে সে একটি ফসল উৎপাদনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সব কার্যক্রম নিজ হাতে করবে। এতে কৃষির সঙ্গে তার একটি সংযোগ তৈরি হবে ও শিক্ষণ কার্যকর হবে। কৃষি শিক্ষায় স্নাতক পর্যায়েই শিক্ষার্থীদের কোনো একজন শিক্ষকের অধীনে ন্যস্ত করতে হবে, যিনি চার বছর শিক্ষার্থীকে গাইড করবেন। যিনি তাকে দিয়ে একটি গবেষণা পরিচালনা ও সম্পন্ন করবেন।

কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এই চার বছরমেয়াদি কৃষি ডিপ্লোমা শেষ করার পরে শিক্ষার্থীদের নেই কোনো উচ্চ শিক্ষার সুযোগ।

যেখানে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে চার বছরমেয়াদি ডিপ্লোমা শেষ করার পর উচ্চশিক্ষার জন্য রয়েছে সরকারিভাবে ডুয়েট। কিন্তু ডিপ্লোমা ইন এগ্রিকালচারের শিক্ষার্থীদের উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএজিএড নামক ডিগ্রি সমমানের কোর্স করা ছাড়া আর কোনো কোর্স সরকারিভাবে করার সুযোগ নেই। বাংলাদেশে এ ছাড়াও আটটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, কিন্তু ডিপ্লোমা ইন এগ্রিকালচারের শিক্ষার্থীদের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ নেই।

এ ছাড়া এটিআইগুলোতে নেই পর্যাপ্ত পরিমাণে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক। যার কারণে পাঠদান কালে বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি হয়।

লেখক : বাংলাদেশ কৃষি ডিপ্লোমা ঐক্য ফোরামের সদস্য, নোয়াখালী

সর্বশেষ খবর