শুক্রবার, ১৭ নভেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

সংসদ নির্বাচন ও হরেক রকমের কথা

মেজর নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ (অব.) পিএইচডি

সংসদ নির্বাচন ও হরেক রকমের কথা

এ লেখা শুরু করেছি ১২ নভেম্বর তারিখে। সামনে দেশের ১২তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। বিভিন্ন কারণে ১২ পরিপূর্ণতার প্রতীক। ঘড়ির কাঁটায় ১২টি দাগ, ১২ মাসে বছর, রাশিচক্র অনুসারে পৃথিবীতে ১২ জাতের মানুষ, ভূ-কক্ষের দ্রাঘিমাকে ১২টি ভাগে ভাগ-এমন নানা কারণে অনেকে ১২-কে পূর্ণতার প্রতিচ্ছবি মনে করেন। বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রেক্ষাপটে ঠিক ১০০ বছর আগে অর্থাৎ ১২ নভেম্বর ১৯২৩ সালে জার্মানির মিউনিখ অঞ্চলের এক ঐতিহাসিক ঘটনা মনে পড়ল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪ থেকে ১৯১৮) শেষে যুদ্ধফেরত জার্মান সৈনিক ইতিহাসখ্যাত হিটলার যোগ দেন জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টিতে।  এ দল থেকেই পরে কুখ্যাত নাজি পার্টির জন্ম। ১৯২৩ সালের ৮ নভেম্বর সন্ধ্যা থেকে হিটলার তার দলবল নিয়ে মিউনিখের সরকারের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থান ঘটানোর প্রচেষ্টা চালান। অসীম সাহসী ও বেপরোয়া হিটলার এ অভ্যুত্থানের সূত্রপাত ঘটান মাত্র ২০ জন সঙ্গীসাথী নিয়ে। পরে অন্য অনেকে তার সঙ্গে যোগ দেন। হিটলারের সাময়িক সাফল্য ও স্বভাবসুলভ উত্তেজনাকর বক্তব্য শুনে অনেকেই এগিয়ে আসেন আরও এক ধাপ। তবে সরকার অনুগত পুলিশ বাহিনী কঠোর অবস্থানে গেলে কমতে থাকে হিটলার সমর্থকদের সংখ্যা ও জমায়েত। ৯ নভেম্বর হিটলার ও তার একান্ত বিশ্বস্ত সামরিক শাখার প্রধান এফ ডব্লিউ লুদেনডর্ফ যখন সামনে এগোতে থাকেন, তখন তার সঙ্গে পান সর্বসাকুল্যে ২ হাজার কর্মী ও সমর্থক। স্টেট পুলিশ বিভাগের মিখাইল ভন গডিন নামের এক তরুণ অফিসার (সিনিয়র লেফটেন্যান্ট) মাত্র ১৩০ জন সরকারি সৈন্য নিয়ে রুখে দেন হিটলারের যাত্রা। উভয় পক্ষের মধ্যে প্রচ- গোলাগুলির পরিপ্রেক্ষিতে ১৬ জন হিটলার সমর্থক, চারজন পুলিশ অফিসার এবং একজন পথচারী প্রাণ হারান। এরপর দ্রুতই পটপরিবর্তন হতে থাকে এবং পরিস্থিতি হিটলারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। এক পর্যায়ে হিটলার পালিয়ে গেলে সেই ‘ব্যর্থ’ (?) অভ্যুত্থানের সমাপ্তি ঘটে। ১২ নভেম্বর ১৯২৩ তারিখে হিটলার সরকারি বাহিনীর হাতে বন্দি হন। বিচারক আদালতে হিটলারকে পাঁচ বছর জেল দিলেও ঘটনার বাঁক পরিবর্তিত হয়ে পরের বছরই (১৯২৪ সাল) জেল থেকে ছাড়া পান হিটলার। তারপর হিটলার ও নাজি পার্টির উত্থান, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ইহুদি নিধন, হিটলারের আত্মহত্যা-সব মিলিয়ে এক মহাকাব্য। ইতিহাস পড়ে যারা মজা পান, তারা এমন ঘটনাবলির মধ্যে একবার ডুব দিলে সহজে আর উঠতে পারেন না। আমিও পারিনি। যখন বাস্তবে ফিরে এলাম তখন গভীর রাত, ঘুমাতে হলো।

পরদিন ১৩ নভেম্বর ২০২৩ তারিখ, সোমবার। ঘুম থেকে উঠে সকালে হাঁটতে বের হতেই দেখি বাসার বাইরের সুন্দর দেয়ালে বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির (?) পোস্টারে ঠাসা। এক পীরসাহেবের হাস্যোজ্জ্বল নুরানি চেহারার ছবি, পাশে ঢাকা- ১৭ আসনে এ দলের মনোনীত প্রার্থীর প্রতীক ও ছবি এবং ভোট চেয়ে নানা কথাবার্তা। নির্বাচনি আচরণবিধির এমন লঙ্ঘন নির্বাচন কমিশনের প্রতি সংশ্লিষ্টদের অবজ্ঞার প্রতিচ্ছবি। আমাদের বাড়ির দেয়ালের হক একান্ত আমাদের। কোনো অনুমতি না নিয়ে দেয়াল দখল আর পীরসাহেবের হাস্যোজ্জ্বল ছবি অনেকেই দেখেছেন। অথচ একজন ধর্মীয় নেতা এভাবে আমাদের হক নষ্ট করলেন, দেয়ালের রং নষ্ট করলেন আর এসবের নেপথ্যে যে অনেকেরই বোবা কান্না, তা কেউ দেখেন না। বিদেশে দেখেছি ইচ্ছা করলেই ছাপাখানায় সবকিছু ছাপানো যায় না। স্থানীয় প্রশাসন (সিটি করপোরেশন বা পৌরসভা) থেকে কোথায় কীভাবে প্রচারপত্র ব্যবহার করা হবে তা জানিয়ে অনুমতি নিতে হয়। প্রচারপত্রে সেই অনুমতির একটি কোড নম্বরও দিতে হয়। সেই অনুমতি না দেখালে কোনো ছাপাখানা কোনো কিছুই ছাপাবে না। আমাদের দেশে বশীকরণে ক্যান্সার থেকে মুক্তি এমনটি ঢাকায় বসে মধ্যপ্রাচ্যের ‘কফিল’ (নিয়োগদাতা)-কে বশ করার পোস্ট বা প্রচারপত্র-সবই ছাপানো ও প্রচার করা যায়। বিদেশে গাড়ির সামান্য দুর্ঘটনাজনিত মেরামত বা ক্র্যাচ সারাতে গেলও ওয়ার্কশপে পুলিশের ছাড়পত্র দেখতে হয়। অন্যথা ঘটলেই বিরাট অঙ্কের জরিমানা। গোয়েন্দারা নজরে রাখেন এ বিষয়টি। ফলে সবাই বাধ্য হয়েই গাড়ি চালাতে সর্বোচ্চ সচেতনতা অবলম্বন করে শহরে। ঢাকা শহরে বিশ্রী দেয়াল ও চলতে ওঠা বাসগুলো দেখে সে কথা মনে পড়ে বারবার। ইদানীং অত্যাধুনিক মেট্রো ট্রেনেও বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপন লাগানোর অনুমতি পাওয়া যাচ্ছে। সামনে কী হবে এই মেট্রো ট্রেনের চেহারা?

ফিরে আসি ১৩ বিষয়ে। যারা ১২-কে পরিপূর্ণতার প্রতীক মনে করেন, তাদের কাছে ১৩ একান্ত অপাঙ্ক্তেয়। ১৩ অনেক দেশের অনেকের কাছে অনেক কারণে অলক্ষুণে বা আনলাকি সংখ্যা। জার্মান পুরাণ, বিভিন্ন ধর্মীয় গোঁড়ামি, কুসংস্কার প্রভৃতি ঘিরে আছে ১৩ সংখ্যাটিকে। এ সংক্রান্ত বহু তথ্য পাওয়া যায় ইন্টারনেটে। বিদেশে অনেকেই ১২ তলার ওপর বাড়ি করেন না, হোটেলে ১৩ নম্বর কক্ষ রাখেন না, বিমান সংস্থায় ১৩ নম্বর ফ্লাইট বা বিমান থাকে না, ইত্যাদি। এসবে বিশ্বাস না করলেও ১৩ তারিখ সকালে হেঁটে বাসায় ফিরে নিজেকে সত্যি সত্যি আনলাকি মনে হলো-যখন রান্নাঘর থেকে জানানো হলো যে, যথারীতি গ্যাস সংকট, চুলা টিম টিম করছে এবং নাশতা দেরি হবে। অগত্যা বিভিন্ন মাধ্যমের খবর সন্ধানে মনোনিবেশ করলাম। দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র টানেল উদ্বোধনের পর আগের দিন ১২ নভেম্বর নরসিংদীতে উদ্বোধন করা হয় দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ ইউরিয়া সার কারখানা। এই সার কারখানার ওপর প্রতিবেদনে পরিপূর্ণ বিভিন্ন মিডিয়া। ক্ষুধা যেমন পেটকে কষ্ট দেয়, তথ্যের চাহিদা তেমন বিবেককে কষ্ট দেয়। তাই জানার চেষ্টা করলাম দেশের বাকি সার কারখানার খবরাখবরে। সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি) ওয়েবসাইট অনুসারে বাংলাদেশে সরকারি সার কারখানা আছে ৭টি তথা লাকি সেভেন। এর মধ্যে চারটি ইউরিয়া সার কারখানা। তবে এ নিয়ে আনলাকি খবর দিয়েছে এ বছর ৭ সেপ্টেম্বরের একটি দৈনিক।

এ পত্রিকার মতে, বিসিআইসির ৪টি ইউরিয়া সার কারখানার ৩টিই বন্ধ। ‘গ্যাসের সংকট তৈরি হওয়ায় কয়েকটি সার কারখানা আপাতত বন্ধ রাখতে হচ্ছে মর্মে তথ্য দিয়েছেন খোদ বিসিআইসি চেয়ারম্যান।’ ইউরিয়া সার উৎপাদনের জন্য মূলত প্রয়োজন এই প্রাকৃতিক গ্যাস। তাই গ্যাস সংকটের সমাধান আর ১৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ব্যয় দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ ইউরিয়া সার কারখানা নির্মাণ একই সঙ্গে করে চলে কাক্সিক্ষত উন্নয়ন। গ্যাস না পেয়ে বাকি ইউরিয়া সার কারখানার মতো এ কারখানাও যদি অলস পড়ে থাকে, তবে কাক্সিক্ষত উন্নয়ন মুখ থুবড়ে পড়বে। তাই কেবল উন্নয়ন নয়, সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট বা টেকসই উন্নয়নই আজ সব সময়ের দাবি। ১৩ তারিখে মিরপুর ১৩ এলাকার এক বাসিন্দার ক্ষোভ প্রকাশ পায় আরেক মাধ্যমে। তার মতে, মিরপুরের মানুষ ১৩ বছর প্রসব বেদনা সহ্য করেছে মেট্রোলাইন নির্মাণের কারণে। এখন বেলা ১১টার পর কেন মেট্রোতে মতিঝিলে যাওয়া-আসা যাবে না? কেন সব স্টেশনে মেট্রো থামবে না? ‘শার্ট বানিয়ে দিলেন কিন্তু বোতাম দিলেন না’-এ কেমন কথা? এমন কথা শুনে কেউ হেসেছেন কি না জানি না, তবে অনেকেই কেঁদেছেন বাংলাদেশের শ্রম আইনের ১৩ নম্বর ধারার কারণে। বর্ধিত বেতনের দাবিতে শ্রমিক আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে বৃহত্তর ঢাকা ও ঢাকার আশপাশের ১৩০টি মতান্তরে ১১৩টি তৈরি পোশাক কারখানা বন্ধ করে দিয়েছেন কারখানার মালিকরা। এ ছাড়া তাদের আর কোনো উপায় ছিল না। শ্রম আইনের ১৩/১ ধারা বলে ‘কোনো প্রতিষ্ঠানের কোনো শাখা বা বিভাগে বেআইনি ধর্মঘটের কারণে মালিক ওই শাখা বা প্রতিষ্ঠান আংশিক বা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিতে পারবেন এবং বন্ধের ক্ষেত্রে ধর্মঘটে অংশগ্রহণকারী শ্রমিকরা কোনো মজুরি পাবেন না।’ এ কথা সত্য, একসময় পোশাক শ্রমিকরা অবহেলিত ছিল। তবে বর্তমানে চা শ্রমিক, বিড়ি শ্রমিক, গ্রামীণ নারী শ্রমিকদের তুলনায় তারা অপেক্ষাকৃত ভালো বেতন ও অন্যান্য সুবিধা পাচ্ছেন। ধাপে ধাপে তাদের বেতন বেড়েছে। বর্তমানে একেবারে নতুন শ্রমিকদের বেতন সাড়ে ১২ হাজার টাকা করা হয়েছে। যোগদানের পর অভিজ্ঞতার সঙ্গে সঙ্গে এই বেতন বাড়তে থাকে। পক্ষান্তরে একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে লিফটে নামার সময় দুজন ছাত্রের কথা শুনছিলাম। গার্মেন্টস আন্দোলন প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তাদের একজন বললেন, নতুন পাস করা ডাক্তারদের ইন্টার্নি শেষে ১৬ থেকে ১৮ হাজার টাকায় বেসরকারি হাসপাতালে যোগদানের প্রস্তাব মেলে, যেখানে আয়া বা ড্রাইভারদের বেতনও ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। অথচ বেসরকারি মেডিকেল কলেজে পড়তে তাদের গুনতে হয় কম বেশি ৩০ লাখ টাকা। তাহলে আমরা ছয় বছরে নতুন ডাক্তারদের কী শিখালাম যার শ্রমের মূল্য মাসে ১৬ থেকে ১৮ হাজার টাকা? একই চিত্র বিবিএ পাস চাকরি প্রার্থীদের ক্ষেত্রেও। শিক্ষানীতি নিয়ে ১৩ গুণ ৪ সমান ৫২ বছরে বহু আন্দোলন ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে। এখনো হচ্ছে। তবে সমাধান হয়নি অনেক কিছুর। সঠিক শিক্ষার অভাবই দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় এবং অন্য সব সমস্যার মূল কারণ কি না এ নিয়ে জমজমাট বিতর্ক হয়েছে-সমাধান হয়নি। লেখাটি শেষ করার মুহূর্তে এক বন্ধুর ফোন পেলাম। রাজনীতিতে নতুন লু হাওয়া প্রসঙ্গে তার যত জিজ্ঞাসা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি ও রাজপথের বিরোধী দল বিএনপিকে চিঠি দিয়েছেন।

দেশটির ঢাকাস্থ রাষ্ট্রদূত পিটার হাস জাতীয় পার্টির শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। কূটনৈতিক শিষ্টাচারে এক দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দাফতরিক চিঠি অন্য দেশের আরেকটি রাজনৈতিক দলকে এভাবে হস্তান্তরের নজির আছে বলে আমার জানা নেই। দুর্ভাগ্য, এমনটাও দেখতে হলো আমাদের অদূরদর্শিতা, নমনীয়তা ও অমিলের কারণে। বর্তমান সমস্যার গোড়া সংবিধানের ১৩তম সংশোধনীতে। ১৯৯৬ সালের ২৭ মার্চ তারিখে ১৩তম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নিরপেক্ষ-নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়। পরে ২০১১ সালের ৩০ জুন ১৫তম সংশোধনীর মাধ্যমে তা বাতিল করা হয়।

এখন রাজপথে আন্দোলনকারীদের মূল চাওয়া সেই ১৩তম সংশোধনীর পুনর্বহাল। সাতসমুদ্র তেরো নদী পাড়ি দেওয়া ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ আপাতদৃষ্টিতে এ দাবি মানবে না বলেই প্রকাশ্যে জানানো হয়েছে। তবে কি বিএনপি ১২ ঘাটের জল খেয়েই শান্ত হয়ে যাবে? নাকি দেশের ১৩তম প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল কোনো চমক দেখাবেন?

 

লেখক : গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট

Email: [email protected]

সর্বশেষ খবর