শুক্রবার, ১৭ নভেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

গুনাহমুক্ত জীবন কেন প্রয়োজন

আল্লামা মাহ্মূদুল হাসান

গুনাহমুক্ত জীবন কেন প্রয়োজন

বুজুর্গানের দীনের জীবনী পাঠ করলে মানুষের মনে নেক আমল করার আগ্রহ সৃষ্টি হয়। আলহামদুলিল্লাহ, দীন সম্পর্কে আমরা কমবেশি সবাই জানি। প্রয়োজন হলো জানাগুলোর ওপর আমল করা। আমল ছাড়া আল্লাহর প্রিয় বান্দা হওয়া আদৌ সম্ভব নয়। আল্লাহকে রাজি-খুশি করার নিয়তে তাঁর সব আদেশ-নিষেধ যথাযথভাবে পালন করলে মানুষ আল্লাহর ওলি হয়ে যাবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এখন আমাদের চিন্তা করতে হবে যে, আমরা যা জানি তা আমল করি কি না। আমরা জানি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া ফরজ এবং জামাত সহকারে তা আদায় করা সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ। বহু আলেম এমনকি ইমাম আহমদ বিন হাম্বল (রহ.) ফরজ নামাজের জন্য জামাতকে ফরজ বলেছেন। তাঁদের মতে, একাকী পড়লে ফরজ নামাজ আদায় হবে না। তবে হাদিসের আলোকে হানাফি মাজহাব হলো- ফরজ নামাজের জন্য জামাত সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ। বিশেষ ওজর বা কারণ ছাড়া জামাত তরক করা জায়েজ নেই। বিশেষ কারণ কি তা আপনারা বাংলা ‘বেহেশতি জেওর’, ‘আহকামে জিন্দেগি’ ইত্যাদি কিতাব পড়ে জেনে নিতে পারেন। মোটকথা এতটুকু তো আমরা সবাই জানি যে, নামাজ পড়া এবং তা জামাত সহকারে পড়া শরিয়তের অতি গুরুত্বপূর্ণ বিধান। কিন্তু যদি আমরা নিজেই নিজের বিগত এক সপ্তাহের রিপোর্ট নিই তাহলে দেখা যাবে যে,  অনেকেই একাধিক নামাজের জামাত তরক করেছি।

গুনাহ  এবং তওবা : বান্দা থেকে গুনাহ সংঘটিত হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। গুনাহ হবে বলেই তো কোরআন-হাদিসে বারবার তওবার কথা বলা হয়েছে। কোনো বান্দা যদি আসমান-জমিন সমান গুনাহ নিয়েও খাঁটি মনে তওবা করে তাহলেও আল্লাহ তাকে ক্ষমা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তবে তওবা করলেই মাফ পাওয়া যায় এ কথা ভেবে কেউ যদি নির্দ্বিধায় বেপরোয়াভাবে গুনাহ করতে থাকে তাহলে সে বড়ই নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দেবে। কারণ তওবা করার জন্যও তো আল্লাহর তৌফিক দরকার। যদি মৃত্যুর আগে তওবার তৌফিক না হয়? আবার মৃত্যু কখন এসে মোলাকাত করবে তাও তো জানা নেই। এসব বিষয় ভাবলে কোনো বান্দা স্বেচ্ছায় গুনাহ করতে পারে না। তবে হ্যাঁ, অনিচ্ছায়, শয়তানের প্ররোচনায় গুনাহ হয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে তওবা করে নেওয়া কর্তব্য।

নামাজের গুরুত্ব ও উপকারিতা : যাই হোক নামাজের গুরুত্বের কথা বলছিলাম। হাদিস থেকে বোঝা যায় যে, হাশরের ময়দানে বান্দার নামাজের হিসাব যদি কোনো প্রকার সমস্যা না থাকে তাহলে আল্লাহপাক অন্য হিসাব দেখা ছাড়াই তার জন্য জান্নাতের ফয়সালা করে দেবেন। ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের প্রথমটি হলো- ইমান। দ্বিতীয় স্তম্ভ হলো- নামাজ। এ নামাজ যদি কেউ ঠিকমতো আদায় না করে তাহলে তার অন্যান্য আমল আল্লাহর দরবারে গুরুত্ব পাবে না। প্রত্যেক আকেল, বালেগ ও সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন ব্যক্তির ওপর পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা ফরজ, এটা আমরা সবাই জানি। নামাজের মাধ্যমে জীবনকে পাপমুক্ত রাখা সম্ভব হয়। এ ব্যাপারে আল্লাহপাক পবিত্র কোরআনে ঘোষণা দিয়েছেন যে, ‘নিশ্চয়ই নামাজ (মানুষকে) অশ্লীল ও পাপকাজ থেকে বিরত রাখে।’ নামাজ পড়লে সবচেয়ে বড় লাভ হলো- নামাজ মানুষের মন-মেজাজকে দীনমুখী করে দেয়, গুনাহর আসক্তি নিঃশেষ হয়ে যায়, পাপের প্রতি মোহ শেষ হতে থাকে। তবে নামাজি ব্যক্তির দ্বারাও গুনাহ সংঘটিত হওয়া অস্বাভাবিক নয়। একমাত্র নবীগণই সম্পূর্ণ গুনাহমুক্ত। আল্লাহপাক কেবল নবীদেরই মাছুম তথা গুনাহমুক্ত জীবন দান করেছিলেন। নবী ছাড়া অন্য বান্দাদের তিনি বলে দিয়েছেন যে, ইচ্ছাকৃত গুনাহ করবে না, তবে ইচ্ছার বাইরে হয়ে গেলে খাঁটি মনে তওবা করতে থাক। 

আল্লাহর ক্ষমার দ্বার অবারিত : দুনিয়াতে অধীনস্থ কেউ অন্যায় করলে মালিক একবার-দুবার মাফ করে, তিনবারের মাথায় আর মাফ করে না। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা ও প্রতিপালক রহমানুর রহিম আল্লাহ ক্ষমার দরজা কখনো বন্ধ করেন না।

আল্লাহতায়ালা বলেছেন, বান্দা যদি গুনাহ করে কাউকে না জানিয়ে নির্জনে বসে অনুতপ্ত ও লজ্জিত হয়ে আমার কাছে তওবা করে তাহলে আমি তার আমলনামা থেকে সব গুনাহ মিটিয়ে দেব। এরপর যদি করে তাহলে একটি গুনাহ লেখা হবে, দুবার করলে দুটি গুনাহ লেখা হবে।

অতঃপর আবার খাঁটি মনে তওবা করলে সব গুনাহ মিটিয়ে দেওয়া হবে। বস্তুত গুনাহ না করার দৃঢ় ইচ্ছা করে খাঁটি মনে তওবা করার পরও যদি অনিচ্ছায় শতবার, হাজারবার গুনাহ হয়ে যায় তাহলেও আল্লাহ ক্ষমা করেন। তবে বান্দার কর্তব্য হলো সব ধরনের গুনাহ থেকে যথাসাধ্য বিরত থাকা।

মানুষের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি : আল্লাহ মানুষকে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি দান করেছেন। সে এই ইচ্ছাশক্তি দ্বারা ভালো বা মন্দ যে কোনো পথ অবলম্বন করবে। উভয় পথের পরিণতিও আল্লাহপাক বান্দাকে যথাযথভাবে জানিয়েছেন। এরপরও আমরা নিজেই নিজের প্রতি জুলুম করে নিজের বরবাদি ডেকে আনছি। বেপরোয়ভাবে আল্লাহর নাফরমানি করে যাচ্ছি। জিনা-ব্যভিচার, বেপর্দেগি-অশ্লীলতা সমাজে ভরে গেছে। মাহরাম আত্মীয়দের মধ্যেও ব্যভিচারের মতো পাপ সংঘটিত হচ্ছে। আগে শুনতাম এগুলো পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে হয়। সেসব দেশে ভাইবোনের মাঝেও নাকি ব্যভিচার হয়। এখন মুসলমানের দেশেও এমন ঘটনা শোনা যায়। শরিয়তের নির্দেশ হলো- যুবতী মেয়ে পিতা বা ভাইয়ের সঙ্গে বা কাছাকাছি শয়ন করবে না। প্রত্যেকেই পৃথক পৃথক রুমে অবস্থান করবে। ইসলামের যুক্তিযুক্ত ও কল্যাণধর্মী বিধি-বিধান না মানার কারণেই সমাজের আজ এ লজ্জাজনক অবস্থা। ইসলামে পর্দার বিধান আমরা সবাই জানি যে, ইসলামে পর্দার বিধান রাখা হয়েছে। যা প্রতিটি মুসলিমের জন্য ফরজ তথা অবশ্য পালনীয়। মানুষ পর্দার ব্যাপক উপকার সম্পর্কে জানুক বা না জানুক এটা আল্লাহর হুকুম তাই পালন করতে হবে। আমার আপনার জ্ঞানের চেয়ে আল্লাহ ও তাঁর রসুলের জ্ঞান অনেক অনেক বেশি। পর্দাকে যিনি ফরজ করেছেন তিনি হলেন মানুষের স্রষ্টা আর যিনি এ বিষয় উম্মতকে অবগত করেছেন তিনি হলেন নবীদের সরদার মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। অথচ মুসলিম নামধারী কথিত বুদ্ধিজীবীরা বলে থাকে যে, মৌলভী সাহেবরা ফতোয়া দিয়ে মহিলাদের ঘরের কোণে আবদ্ধ করে রেখেছে। বস্তুত মায়ের জাতিরা যদি বাস্তবেই মৌলভীদের ফতোয়া মতে অবস্থান করত তাহলে আজ তারা বিশ্বময় পণ্যের ন্যায় বিক্রি হতো না। পর্দার বিধি-বিধান না মানার কারণেই এ মায়ের জাতি ধর্ষিত হচ্ছে, নির্মমভাবে নিহত হচ্ছে। পত্রিকা খুললেই এরকম ঘটনা প্রতিদিনই পাওয়া যায়। স্বামী ও চার-পাঁচজন সন্তান ফেলে রেখে অন্যের হাত ধরে স্ত্রী চলে গেছে এমন ঘটনার অভাব নেই। বাপ-মা অফিসে চলে যায় আর তাদের যুবতী মেয়ে বয়ফ্রেন্ডকে নিয়ে বাসায় ফুর্তিতে মত্ত হয়। এগুলো অবাস্তব কিছুই বলছি না। সমাজের চিত্র আজ এমনই। চেহারার নয়, প্রয়োজন অন্তরের সংস্কার যারা সমাজ সংস্কারের কথা বলছে তাদের আমি বলেছিলাম যে, শুধু চেহারার সংস্কার করলে কোনো লাভ হবে না, অন্তরের সংস্কার করতে হবে। নেতার পরিবর্তনের দ্বারা সমাজে শান্তি আসবে না, বরং চরিত্রের পরিবর্তন করতে হবে।  এর জন্য প্রয়োজন সঠিক দীনি শিক্ষা অর্জন করা। ইসলামী শিক্ষা ছাড়া জেনারেল শিক্ষার মাধ্যমে মানুষের চরিত্রের সংশোধন যে সম্ভব নয় তা বলাই বাহুল্য। যদি সম্ভব হতো তাহলে পশ্চিমারা করতে পারত। তারা তাদের পার্লামেন্টে ফ্রি-সেক্সের আইন অনুমোদন করেছে। আমাদের দেশেও এগুলো তারা রপ্তানি করছে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে এ বিষয়ে সতর্ক থাকার তৌফিক দান করুন।

লেখক : আমির, আল হাইআতুল উলয়া ও বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ

সর্বশেষ খবর