শুক্রবার, ১৭ নভেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী

অধ্যাপক মোহাম্মদ মাজহারুল হান্নান

মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী

উপমহাদেশের যে উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব আমৃত্যু শোষিত-নিপীড়িত মানুষের পক্ষে আপসহীন দৃঢ়তায় সোচ্চার ছিলেন, মাটি ও মানুষের সঙ্গে যাঁর সম্পর্ক ছিল সুনিবিড়, শোষণমুক্ত সমাজের প্রবক্তা, সেই জননেতাই তো মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। সমাজের মজলুম মানুষের সেবায় নিবেদিত চিত্ত মওলানা ভাসানী সারা জীবন সমাজসেবায় আত্মনিয়োগ করে দেশ ও জাতিকে চিরদিনের জন্য অপরিশোধ্য ঋণে আবদ্ধ করে গেছেন। মওলানা আবদুল হামিদ ভাসানী ১৮৮০ সালের ১২ ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জের ধানগড়া গ্রামে জন্মলাভ করেন। অতি সাধারণ পরিবারের সন্তান ছিলেন মওলানা ভাসানী। তিনি ছয় বছর বয়সে পিতাকে হারান এবং ১১ বছর বয়সে মাতাকে হারান। তারপর পীরসাহেব সৈয়দ নাসির উদ্দীন বোগদাদীর সংস্পর্শে আসেন আর তখন থেকেই বাইরের টানে ঘরের বাইরে বের হয়ে পড়েন এবং সারাটি জীবন মানবতার সেবায় কাটিয়ে দেন। মওলানা ভাসানী নিঃসন্দেহে বহুগুণে গুণান্বিত ব্যক্তি ছিলেন। যে গুণটি তাঁর চরিত্রে সবচেয়ে বেশি ছিল তা হলো নিঃস্ব, অসহায়, অত্যাচারিত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে বিদ্রোহী কণ্ঠে প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠা এবং ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় সোচ্চার হওয়া। অত্যাচারী সে যতই শক্তিশালী হোক না কেন, তাতে তিনি কখনো পিছপা হতেন না। বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁর অবদান এ দেশের মানুষ শ্রদ্ধার সঙ্গে চিরদিন স্মরণ করবে। মওলানা ভাসানী বাল্যকালে গ্রামের মক্তবে শিক্ষালাভ করেন। ১৯০৭ সালে তিনি ইসলামী শিক্ষার উদ্দেশে দেওবন্দে যান। সেখানে কিছুকাল অধ্যয়ন শেষে টাঙ্গাইল জেলার কাগমারীতে এসে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। এই সময়ে প্রজাদের ওপর জমিদারদের নির্দয় অত্যাচার দেখে তিনি ব্যথিত হন এবং ক্রমেই বিদ্রোহী ও আন্দোলনমুখী হয়ে ওঠেন। ইতিহাসের গতি ধারায় ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ, ১৯০৮ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামী ক্ষুদিরামের ফাঁসি, ১৯১৬ সালে মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের লক্ষ্মৌ চুক্তি, ১৯১৭ সালে কলকাতায় কংগ্রেসের ৩৩তম অধিবেশন, ১৯১৭ সালে ময়মনসিংহে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের ভাষণ শুনে রাজনীতিতে অংশগ্রহণে অনুপ্রাণিত হন। বিশেষ করে ১৯১৯ সালে পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগে নির্মম হত্যাকাণ্ডে তার মনে ইংরেজবিদ্বেষী মনোভাব সৃষ্টি হয়। ১৯১৯-এ কংগ্রেসে যোগদান করেন খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে ১০ মাস কারাদণ্ড ভোগ করেন। ১৯২৬ সালে মওলানা ভাসানী আসামে যান এবং সেখানে প্রথম কৃষক প্রজা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটান। এখানে তাঁর জীবনের এক নব অধ্যায়ের সূচনা হয়। আসামে গিয়ে তিনি লক্ষ্য করলেন যে এক ভীষণ দুঃখ-দুর্দশার মধ্যে কয়েক লাখ বাঙালি সেখানে অবস্থান করছেন। মওলানা ভাসানী লাইন প্রথাবিরোধী আন্দোলন শুরু করে তাতে নেতৃত্ব প্রদান করেন এবং লাইন প্রথা ভেঙে দিতে সক্ষম হন। যার ফলে আসামের বিপুলসংখ্যক ছিন্নমূল বাঙালির অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

মওলানা ভাসানী ১৯২৯ সালে আসামের ধুবড়ী জেলার ব্রহ্মপুত্র নদের ভাসানচরে প্রথম কৃষক সম্মেলন করেন, সেখান থেকেই তাঁর নামের পাশে ভাসানী শব্দ যুক্ত হয়। ১৯৩১-এ সন্তোষের কাগমারীতে, ১৯৩২-এ সিরাজগঞ্জের কাওড়াখোলায় এবং ১৯৩৩-এ গাইবান্ধায় বিশাল কৃষক সম্মেলনের আয়োজন করেন। সেসব সম্মেলনে যোগদানের জন্য অসংখ্য মানুষের থাকা, খাওয়া ও অন্যান্য আয়োজনের ব্যাপারে তাঁর অগণিত মুরিদ ও ভক্ত চাল, ডাল, তরকারি, ফল ইত্যাদি আনুষঙ্গিক প্রয়োজনীয় সব দ্রব্যাদি ও অর্থ দিয়ে সহায়তা করতেন।

১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার রোজগার্ডেনে মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয় এবং তিনি এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৪৯ সালে ভুখা মিছিলে নেতৃত্ব দেওয়ার দায়ে কারারুদ্ধ হন। তিনি ১৯৫০-এর শেষের দিকে সরকারি নির্যাতনের প্রতিবাদে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অনশন ধর্মঘট করেন। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করায় ১৯৫২ সালে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। দীর্ঘ ১৬ মাস কারা নির্যাতন ভোগ করেন। আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি হিসেবে মওলানা ভাসানী ১৯৫৩ সালের ৩ ডিসেম্বর কৃষক শ্রমিক পার্টির সভাপতি শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক ও আওয়ামী মুসলিম লীগের অন্যতম শীর্ষ নেতা শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে এক হয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠন করেন। ১৯৫৪ সালের ৮-১১ মার্চে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট বিপুলভাবে বিজয়লাভ করে। এরপর তিনি বিশ্বশান্তি সম্মেলনে যোগদান শেষে ইউরোপের কয়েকটি দেশ সফর করেন। ১৯৫৭ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ড. কাজী মোতাহার হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত কাগমারী সম্মেলনে ভাষণদানকালে বলেন, ‘পূর্ববাংলা’ পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসকের দ্বারা শোষিত হতে থাকলে পূর্ববাংলার মানুষ তাদের ‘আসসালামু আলাইকুম’ জানাতে বাধ্য হবে। কৃষক শ্রমিক মেহনতি মানুষের অকৃত্রিম সুহৃদ মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ১৯৭৬ সালের ১৭ নভেম্বর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর ৪৭তম মৃত্যুবার্ষিকীতে বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করি।

লেখক : প্রাক্তন ট্রেজারার খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ও সভাপতি বাংলাদেশ অধ্যক্ষ পরিষদ

সর্বশেষ খবর