রবিবার, ১৯ নভেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

কেন আমরা বাঁকা পথে হাঁটতে ভালোবাসি

আফরোজা পারভীন

কেন আমরা বাঁকা পথে হাঁটতে ভালোবাসি

আমার একটা গল্পের নাম ‘সেফটিপিন’। গল্পটা বেশ সাড়া ফেলেছিল। অনেকে বলেছেন, সামান্য সেফটিপিন নিয়ে যে এমন একটা গল্প লেখা যায় ভাবিনি। আমি বলেছি, সেফটিপিন গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। অবশ্যই লেখা যায়। যেমন এখন ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ লিপস্টিক। রাজনীতির ময়দান, হরতাল, অবরোধ ডিঙিয়ে লিপস্টিক এখন জোর আলোচনায়। ভাবছি এবার লিপস্টিক নিয়ে গল্প লিখব।

২৮ অক্টোবর দিনটা ছিল ভীতিকর। বিএনপি সভা ডেকেছিল নয়াপল্টনে, আওয়ামী লীগ শান্তিসমাবেশ করেছিল বায়তুল মোকাররমের সামনে। জামায়াতকে অনুমতি দেওয়া হয়নি। তার পরও তারা বলেছিল সমাবেশ করবে। করেছে। কোনো সমস্যা হয়নি তাদের! সেদিন চারদিক ছিল থমথমে। নেহাতই প্রয়োজন ছাড়া মানুষ বের হয়নি ঘর থেকে। কিন্তু রোগ-শোক তো আর হরতাল-অবরোধ দেখে আসে না। ছোটবোন ছিল ডেঙ্গু আক্রান্ত, সরকারি কর্মচারী হাসপাতালে ভর্তি। প্লাটিলেটস ক্রমাগত নেমে যাচ্ছিল। আগে থেকেই তার অনেক সমস্যা। অনেক অপারেশনে জর্জরিত শরীর। দেখার তেমন কেউ নেই। এ সময়ের সবচেয়ে বড় সমস্যা জনবল। মানুষই নেই অধিকাংশ পরিবারে। ফ্যামিলি প্ল্যানিংয়ের এমনই ক্যারিশমা। কে কারে দেখে! আমরা উদ্বিগ্ন!

ভয়ভীতি উপেক্ষা করে বের হলাম বোনকে দেখতে। যথেষ্ট সতর্কতার সঙ্গে হাসপাতালে পৌঁছালাম। হাসপাতালের ভেতরে কনস্ট্রাকশন ওয়ার্ক চলছে। গাড়ি নেওয়া যাবে না! কে জানে সিরিয়াস রোগীরা কীভাবে যায় এতটা হেঁটে! কোনো হুইলচেয়ারও দেখলাম না। রাস্তায় গাড়ি রেখে গেলাম বোনের কাছে। দুপুর ২টায় সভা। ইচ্ছা তার আগেই ফিরে যাওয়া। উঠি উঠি করছি এমন সময় ড্রাইভারের ফোন। সে হন্তদন্ত হয়ে জানাল বড় বড় মিছিল আসছে। ওখানে গাড়ি রাখা নিরাপদ নয়। গাড়ি কি সরিয়ে নেবে? আমার ড্রাইভার বোকা, পথঘাট চেনে না, অসম্ভবরকম ভীতু। পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার যোগ্যতা ওর নেই। ওর হাতে গাড়ি ছেড়ে দিতে সাহস হলো না। দ্রুত নেমে এলাম। গাড়িতে যখন উঠলাম তখন চারপাশে হাজার হাজার লোক আর তাদের গগনবিদারী স্লোগান। প্রত্যেকের হাতে লাঠি পতাকা মাথায় ক্যাপ। দেখলেই শনাক্ত করা যায় কে কোন দলের। ‘দেখে নেব’ ধরনের প্রতিজ্ঞা সবার মুখ-চোখে। গাড়িতে বসে দোয়াদরুদ পড়তে লাগলাম। ওরা যেতে যেতে অকারণে গাড়ির গ্লাসে চাপড় দিতে থাকল, বাড়ি মারল, গাড়ির ওপর দিয়ে লাফ মারল, খর চোখে তাকাল বারবার। ভয়ে চুপসে গেলাম। ততোধিক ভয়ে ড্রাইভার। চাকরিজীবনের বেশির ভাগ সময় সচিবালয়ে কাজ করেছি। ওই এলাকার রাস্তাঘাট আমার চেনা। বকশীবাজার এলাকায় থেকেছি অনেকদিন। এশিয়াটিক সোসাইটির সামনে দিয়ে বেরোনোর রাস্তাঘাট সব জানি। কিন্তু বিপৎকালে কিছুই মনে পড়ল না। আর ড্রাইভার তো কিছুই চেনে না। ও ইউটার্ন নিয়ে এগোতে থাকল। এর একটু পরই চার মাথায় মারামারির মধ্যে পড়ল। আমার সামনে ডানে বাঁয়ে মারামারি হলো। সম্ভবত আমি নারী আর বয়স্ক বলে ওরা আমাকে আর পাশে আরও দু-চারটে গাড়িতে বসা আরোহীদের কিছু বলল না। কিন্তু একবার যদি একজন শুরু করত বাঁচার কোনো উপায় ছিল না!

কে ক্ষমতায় থাকবে কে যাবে তা নির্ধারিত হবে নির্বাচনের মাধ্যমে। সেই নির্বাচন যাতে সুষ্ঠু হয় সেদিকে সবারই নজর দেওয়া দরকার। নজর দেওয়া দরকার দেশের শক্তি যে জনগণ, যারা ভোটার তাদের ভালোমন্দের দিকে

স্বচক্ষে মারামারি দেখলাম, দেখলাম রক্ত। এরপর আগুনের মধ্যে পড়লাম কাকরাইলে। সারা ঢাকা তখন ধোঁয়ায় সয়লাব। পুলিশবক্সে তখনো আগুন জ্বলছে। মানুষ প্রাণভয়ে যত্রতত্র দৌড়াচ্ছে। রাস্তার উল্টো দিক থেকে উল্লাস করতে করতে আসছে অসংখ্য মোটরসাইকেল। কীভাবে সেদিন বাসায় এলাম, কীভাবে প্রাণ রক্ষা হলো ভাবলে এখনো অবাক হই! হরতালের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ১৯৯৯ সালে একটা মামলা হয়েছিল। কোর্ট কোনো প্রকার ভয়ভীতি না দেখিয়ে হরতাল ডাকা বৈধ কর্মকাণ্ড এবং এটি সংবিধানের ৩৯(২) (এ) সংরক্ষিত মর্মে রায় দিয়েছিলেন। রায়ে ‘ভয়ভীতি না দেখিয়ে’ বিষয়টির প্রতি সবার দৃষ্টি আকর্ষণও করা হয়েছিল। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সংবিধানস্বীকৃত, মৌলিক অধিকার। সংবিধানের ২৬ থেকে ৪৭ অনুচ্ছেদে মৌলিক অধিকারের কথা উল্লেখ রয়েছে। তবে আইনের দ্বারা আরোপিত বাধানিষেধে পালন সাপেক্ষে মৌলিক অধিকার পালনের কথা বলা আছে। হরতাল-অবরোধ-সভা করার মতো চলাচলের স্বাধীনতা, সম্পদ রক্ষার স্বাধীনতা, আত্মরক্ষার স্বাধীনতা, যাতায়াতের স্বাধীনতাও মৌলিক অধিকার, সংবিধানস্বীকৃত। স্বাধীনভাবে চলাচল করতে হলে, নিরাপদে চলতে হলে প্রয়োজন নিরাপদ পরিবেশ। আমাদের হরতাল-অবরোধ কখনই শান্তিপূর্ণ হয় না, সংহিসতা হয়। জ্বালাও-পোড়াও, গাড়ি ভাঙচুর, বোমা নিক্ষেপ, মারামারি, হত্যাকাণ্ড সবই ঘটে। অর্থাৎ মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার শর্ত পূরণ করতে গিয়ে অনেক শর্ত লঙ্ঘিত হয়। মানুষের অনেক অধিকার খর্ব হয়। একই সঙ্গে সহিংসতা ও পিকেটিংয়ের কারণে দণ্ডবিধি অনুযায়ী অপরাধ সংঘটিত হয়। তাহলে কীভাবে এ হরতাল-অবরোধ চলতে পারে দিনের পর দিন! হরতালে গণপরিবহন চলে না বললেই চলে। বাস পুড়িয়ে দেওয়ার ভয়ে মালিকপক্ষ গাড়ি বের করে না। সেটাই স্বাভাবিক। সাধারণ মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়ে। যেসব অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনলাইনে কাজ করার ব্যবস্থা আছে তারা হয়তো খানিকটা সুবিধায় থাকে, কিন্তু বেসরকারি চাকরিজীবী আর শ্রমজীবীরা পড়ে প্রচণ্ড অসুবিধায়। তাদের অফিস যথারীতি চলে। ঝুঁকি নিয়ে অফিসে যেতে হয় কখনো হেঁটে, কখনো বাসে-টেম্পোয়। ভাড়া গুনতে হয় তিন গুণ। যারা অধিক ভাড়া নেন তাদের দোষ দেওয়া যায় না। তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রিকশা-টেম্পো-সিএনজি চালান। আগের মতো একের পর এক ভাড়া খাটতে পারেন না, ভয়ে সব জায়গায় যেতে পারেন না। তাদের কর্মক্ষেত্র সীমিত হয়ে পড়ে। আয় কমে যায়। তা ছাড়া বাজারে প্রতিটি জিনিসে আগুন। যে টাকায় আগে চার দিনের বাজার হতো এখন এক দিনেরও হয় না। এ অবস্থায় ভাড়া বেশি না নিলে তারা চলবে কী করে! সবচেয়ে বিপদে পড়ে শিক্ষার্থীরা। কারও ক্লাস চলে, কারও পরীক্ষা। এখন যেমন পরীক্ষা চলছে। হরতাল-অবরোধ-সভা যদি হতো দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিসহ অন্যান্য সমস্যার সমাধানকল্পে তাহলে বুঝতাম জনগণের জন্য আমাদের রাজনীতিবিদদের দরদ আছে। তা কিন্তু নয়। প্রয়োজনের সময় তারা টুঁশব্দটি করেন না। একজন ক্ষমতাধর বলেছেন, ‘দেশের মানুষ ভালো আছে। মেয়েরা তিনবার লিপস্টিক আর চারবার স্যান্ডেল বদলায়’। প্রশ্ন হলো, নারীরা কি শুধুই লিপস্টিক আর স্যান্ডেল বদলায়? তাদের আর কোনো কাজ নেই? এ দেশে এমন অনেক নারী আছেন যারা জীবনে একবারও লিপস্টিক পরেননি। আমার মাও আছেন এই দলে। কর্মজীবী নারীরা সকালে যে লিপস্টিক আর স্যান্ডেল পরে বের হন সন্ধ্যায় সেটা পরেই বাড়ি ফেরেন। তিন-চার বার বদলানোর সুযোগই বা কোথায়। এ দেশের অসংখ্য নারী ঘরে থাকেন। ঘরে তাদের সাংসারিক কাজ করতে হয়। লিপস্টিক বা স্যান্ডেল বারবার বদলানোর প্রয়োজন তাদের পড়ে না। হ্যাঁ পাগল হলে এ কাজ করতে পারে। তাহলে কি এ দেশের সব নারী পাগল! এ দেশে এমন অনেক নারী আছেন যাদের পায়ে দেওয়ার স্যান্ডেল নেই। লিপস্টিক পরার বিলাসিতা তারা কল্পনাও করতে পারেন না। ক্ষমতাধর ব্যক্তি কি ১৮ কোটি মানুষের দেশে তেমন একজন নারীও দেখেননি? জানতে ইচ্ছা করে কতজন নারীর ওপর গবেষণা করে তিনি এ কথা বললেন? কোন এলাকার নারী তারা? মনে হয় যিনি বলেছেন তিনি তার অভিজ্ঞতা থেকে বলেছেন। তার বাড়িতে বোধহয় ঘণ্টায় ঘণ্টায় লিপস্টিক আর স্যান্ডেল বদলানোর ব্যাপার আছে। লিপস্টিক আর স্যান্ডেল কিনতে কিনতে তিনি বোধহয় গলদঘর্ম, নাকাল, হতাশ!

আমরা আজকাল রাজনীতিবিদদের মুখ থেকে মুখরোচক নানান কথা শুনছি। এখন আর আমাদের ঝালমুড়ি, মুড়ি-চানাচুর বা চিপসের দরকার হয় না। আমি শুধু ভাবি দেশের এ অবস্থায় কীভাবে তারা এসব বাক্য বলেন!

হরতাল আর লাগাতার অবরোধে দেশব্যাপী মারা গেছেন অনেকে। অনেক বাস পোড়ানো হয়েছে। বিপুল পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এ সংস্কৃতি আজকের নয়। জ্বালাও-পোড়াও, ভাঙো-ওপড়াওয়ের রাজনীতি ক্রমে বিস্তার লাভ করছে। এক দল সভা করলে অন্য দল পাল্টা সভা দিচ্ছে। সভা করতে চাইলে অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না। তারা সভা করে দেখিয়ে দিচ্ছে। গণগ্রেফতার চলছে। এসব হয়ে আসছে বছরের পর বছর। সভা করলে পাল্টা সভা না দিলে এ-জাতীয় পরিস্থিতির উদ্ভব হয় না। সভার অনুমতি দিয়ে দিলে সহজ সমাধান হয়। কিন্তু জানি না কেন আমরা বরাবর বাঁকা পথে হাঁটতে ভালোবাসি। এখন তো আবার টানা অবরোধের রেওয়াজ চলছে। সন্ধ্যায়, রাতেও পোড়ানো হয় গাড়ি। ৪৮ ঘণ্টা, ৭২ ঘণ্টা, ৯৬ ঘণ্টা লাগাতার অবরোধে মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়ে। একবার এক হরতালে একজন অন্তঃসত্ত্বা নারীর পা গড়িয়ে রক্তের স্রোত বয়ে যেতে দেখেছিলাম। কে জানে তার পেটের বাচ্চাটা শেষাবধি ছিল কি না! অসংখ্য অ্যাম্বুলেন্স রাস্তায় আটকা পড়ে। হাসপাতালে নিতে দেরি হওয়ায় কতজন মারা যায়। রাস্তা ফাঁকা করে একটু জায়গা দেওয়ার জন্য কত কাকুতিমিনতি করে তারা। কত অনুষ্ঠানের তারিখ বদলাতে হয়, বিয়ের অনুষ্ঠান পণ্ড হয়ে যায়। অবরোধকারীদের মন গলে না। শুনেছি পাষাণও নাকি গলে! কে ক্ষমতায় থাকবে কে যাবে তা নির্ধারিত হবে নির্বাচনের মাধ্যমে। সে নির্বাচন যাতে সুষ্ঠু হয় সেদিকে সবারই নজর দেওয়া দরকার। নজর দেওয়া দরকার দেশের শক্তি যে জনগণ, যারা ভোটার তাদের ভালোমন্দের দিকে। এভাবে পেশিশক্তি প্রদর্শন হলে জনগণ ভয় পাবে। এমনিতেই নানা সমস্যায় জর্জরিত এ দেশের মানুষ ঝামেলা সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। তাই সরকারি দল, বিরোধী দল এবং সংশ্লিষ্টদের ভোট প্রদান উপযোগী পরিবেশ গড়ে তোলার দিকে মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন।

লেখক : কথাশিল্পী, গবেষক, সাবেক যুগ্মসচিব

[email protected]

সর্বশেষ খবর