বুধবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

রাজনীতিকরা দেশকে কোথায় নিচ্ছেন

আলম রায়হান

রাজনীতিকরা দেশকে কোথায় নিচ্ছেন

বাংলাদেশে বিদেশি রাষ্ট্রদূতরা বিধি-বিধানের বাইরে অতিরিক্ত গুরুত্ব পেয়ে থাকেন। বিশ্বে যার উদাহরণ বিরল। এর একাধিক কারণ আছে। এক. প্রধান কারণ হয়তো আমাদের মজ্জাগত অতিথিপরায়ণ প্রবণতা। এটি প্রশংসনীয়। দুই. দীর্ঘকাল বৈদেশিক শাসনের অধীনে থাকার কুপ্রভাব। যা নিন্দনীয়। আরও অনেক কারণ থাকলেও থাকতে পারে। কারণ যাই হোক, বিদেশিদের ব্যাপারে আমাদের অন্যরকম বিবেচনার বাড়াবাড়ি আছে। যা প্রকাশ্য এবং নগ্ন প্রকাশ ঘটে প্রায়ই। আর তা যদি হয় মার্কিন রাষ্ট্রদূত কেন্দ্রিক, তা হলে তো মাশাল্লা! আর কোনো কথা নেই। এর মধ্যেও আবার মাত্রার হেরফের আছে। দেশ স্থিতিশীল থাকাকালে বিদেশি কূটনীতিকদের বাড়াবাড়ি কম পরিলক্ষিত হয়। যেমন গত প্রায় একটানা সাড়ে তেরো বছর। প্রভাব প্রকট হয় রাজনীতিতে অস্থিতিশীলতা প্রকট হলে। উদাহরণ গত এক বছরের ঘটনাপ্রবাহ। আর সম্প্রতি সবকিছু ছাপিয়ে বাংলাদেশের আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের তৎপরতা এবং দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে আকাশ স্পর্শ করার মতো প্রভাব। তাকে তো বিএনপির এক নেতা ‘অবতার’ এমন কী ‘আব্বা’ বলে সম্বোধন করেছেন। এবং বাঁচাবার আকুতি জানিয়েছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূতের কাছে। এই উচ্চারণ বিএনপি কীভাবে নিয়েছে তা জানা যায়নি। তবে অবস্থা বেগতিক দেখে বিএনপির এক খুচরা নেতা টিভি টকশোতে তাকে ‘কর্মী হিসেবে’ আখ্যায়িত করে মুখ রক্ষার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু মুখ রক্ষা হয়নি। কারণ তিনি মোটেই কর্মী নন। তিনি বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতা। বিএনপির মন্ত্রিসভায় ছিলেন। শুধু তাই নয়। সেনাবাহিনী থেকে আসা এই নেতা মুক্তিযুদ্ধে কিংবদন্তিসম যোদ্ধা ও অধিনায়ক ছিলেন বরিশাল অঞ্চলে। তাঁর বীরগাথা এখনো মানুষের মুখেমুখে। বাংলাদেশ হানাদারমুক্ত হওয়ার এক সপ্তাহ আগে ৮ ডিসেম্বর বরিশাল হানাদার মুক্ত হয়েছে। এদিকে মুক্তিযুদ্ধ উপলক্ষে ভারতে হিজরতকারী নেতা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই তখনো বরিশালে আসেননি। মুক্তিযুদ্ধে বরিশাল এমন ভয়াবহ ছিল যে, ক্যাপ্টেন বেগের মতো দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধাও মাস দুয়েকের মধ্যে বরিশাল ছেড়ে অন্য এলাকায় যুদ্ধে নিয়োজিত হয়েছেন। এ ঘটনা সংক্ষেপে তুলে ধরার উদ্দেশ্য হচ্ছে, মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস কেন্দ্রিক অগ্রহণযোগ্য বাক্য উচ্চারণকারী বিএনপির শীর্ষস্থানীয় ওই নেতার মূল অনেক গভীরে। তিনি এখন পেশাদার আইনজীবী। ব্যারিস্টার।

বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন কেন্দ্রিক বিদেশি কূটনীতিকদের নানান তৎপরতা শুরু থেকেই অনেকে দৃষ্টিকটু হিসেবে বিবেচনা করছেন। র‌্যাবের ওপর স্যাংশন, বাংলাদেশের জন্য ভিসানীতি-ইত্যাকার কাণ্ড আলোচনা-সমালোচনা যখন তুঙ্গে তখন এর সঙ্গে যুক্ত ১৬ নভেম্বর পিটার হাসের ‘হঠাৎ’ বিদেশযাত্রা করেন। বিষয়টি টপ অব দ্য কান্ট্রি হয়ে গেছে। এর ফলে আগের দিন অর্থাৎ ১৫ নভেম্বর ঘোষিত জাতীয় নির্বাচন শিডিউল প্রসঙ্গ অনেকটাই ছাপিয়ে আলোচনার কেন্দ্রে চলে যায় পিটার হাসের ‘হঠাৎ’ বিদেশযাত্রা প্রসঙ্গ। মার্কিন রাষ্ট্রদূতের ছুটিতে ঢাকার বাইরে যাওয়া নিয়ে ১৬ নভেম্বর সারা দিন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিরক্তি প্রকাশ করেছেন আমাদের দেশের কতিপয় সাবেক কূটনীতিক। এরা এক কিসিমের বুদ্ধিজীবী। নাই দেশে নলখাগড়াও যেমন বৃক্ষ। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, দীর্ঘ সময় আমাদের দেশে এ অনুশীলন চলছে। অথচ অন্য কোনো দেশে এসব হয় না। রাষ্ট্রদূতের এত গুরুত্ব দেওয়ার কারণে তারা আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের সুযোগ পায়। এর দায় যেমন রাজনীতিবিদের ওপর বর্তায় তেমনি গণমাধ্যমেরও যথেষ্ট দায় রয়েছে। সাবেক রাষ্ট্রদূত মুনশি ফায়েজ গণমাধ্যমকে বলেন, পিটার হাস হয়তো কোনো প্রয়োজন রয়েছে, সে জন্য শ্রীলঙ্কায় গেছে। সেটা নিয়ে আমরা এত অস্থির হচ্ছি কেন? তাঁরা এ ঘর থেকে ওই ঘরে গেলে, হাতমুখ ধুতে গেলেও আমরা যদি অস্থির হয়ে যাই, তাহলে খুব মুশকিল। এই দোষটা আমাদের। তাদের সেই সুযোগ করে দেই। আর তারা যখন দেখে গুরুত্ব পাচ্ছে, তারাও মজা পায়। মুনশি ফায়েজের মতো বিদেশি কূটনীতিক প্রশ্নে সাংবাদিকদের দায়ী করে এমন কথা আমার মাননীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রায়ই বলে থাকেন। সাবেক রাষ্ট্রদূত ওয়ালিউর রহমান বলেছেন, মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে নিয়ে চলমান আলোচনা বাড়াবাড়ি। তার ভাষায়, ‘এটা নিয়ে আমাদের এত ব্যস্ত হয়ে পড়ার তো কিছু দেখছি না। এটাকে বাড়াবাড়ি ছাড়া আমি আরও কিছুই বলতে চাইছি না।’ কিন্তু এই বুদ্ধিজীবীরাই ২০১৪-এর নির্বাচনে ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুজাতা সিং বাংলাদেশে এসে জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনে অংশ নিতে জেনারেল এরশাদকে বাধ্য করার মধ্যে কোনো বাড়াবাড়ি দেখেননি। এই বুদ্ধিজীবীরাই ঢাকার যুক্তরাষ্ট্রের হাসের ‘হঠাৎ’ বিদেশযাত্রা এবং অন্যান্য বিষয়কে তেমন বিবেচনায় নিতে চান না। এ যেন আষাঢ়ের বৃষ্টির মতো সাধারণ ঘটনা। এবং আমাদের দেশের সাবেক কূটনীতিকরা প্রধানত গণমাধ্যমকে একহাত নিয়েছেন। সঙ্গে ধরি মাছ না ছুঁই পানি তরিকায় রাজনীতিকদের কিঞ্চিৎ সমালোচনার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু পিটার হাস কেন এসব করে বেড়াচ্ছেন বা করার সুযোগ পান সে প্রসঙ্গে আগাগোড়াই মুখে কুলুপ এঁটে আছেন আমাদের দেশের কথিত বুদ্ধিজীবীরা। কারণ হয়তো, মার্কিন ভিসানীতির আওতায় পড়ার অজানা আতঙ্ক। অথবা তাদের পোষ্যরা ফেঁসে যাওয়ার ভয়। উল্লেখ্য, আমেরিকার বিদেশি শিক্ষার্থীদের মধ্যে বাংলাদেশির সংখ্যা সর্বাধিক। আবার যাদের নিজের বা সন্তানের ভিসানীতির কারণে ইঁদুর মারার কেঁচিকলে পড়ার আশঙ্কা নেই। তারা আবার সরকারের শেনদৃষ্টিতে পড়ার ভয় করেন। তবুও কিছু কথা বলতে হবে। তা না হলে কীভাবে বোঝা যাবে, তারা অনেক জ্ঞানী এবং দেশ নিয়ে খুবই ভাবেন! এ জন্য মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে নিয়ে অনেক বাগাড়াম্বর করার পাশাপাশি একহাত নিলেন ‘বোবা প্রাণী’ হিসেবে পরিচিত সাংবাদিকদের। যারা কেবল অন্যের কথা বলেন, নিজের কথা বলার সুযোগ খুবই সীমিত। অথবা সেই গানের বাস্তবতায় থাকেন, ‘ভাবি যেন লাজুক লতা’। তবে সাংবাদিক নেতারা অন্য মেরুতে। তবে সেখানে বসে কেবল নিজেদের কথা বলেন। তাঁদের মধ্যে অনেকেই আছেন মাশাল্লা! এরাও এক প্রকার বুদ্ধিজীবী।

বুদ্ধিজীবীদের স্বরূপ উন্মোচন বরতে গিয়ে আহমেদ ছফা বলেছেন, ‘তারা আসল কোনোকালেই সঠিক কথাটি বলেন না। এমনকী তিনি এও বলেছেন, বুদ্ধিজীবীরা যা বলেছেন, তা শুনলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না।’ তারা হাওয়া বুঝে বাক্য উদ্গিরণ করেন। কাজেই পিটার হাস প্রসঙ্গে বুদ্ধিজীবীরা যা বলছেন তা বাস্তবতা নয়। বরং পিটার হাস এক কঠিন বাস্তবতা। আর তিনি কোনো ব্যক্তি নন। তিনি বাংলাদেশে আমেরিকার ছায়া। অথবা আত্মা। সব দেশেই রাষ্ট্রদূতরা নিজ নিজ দেশের আত্মা অথবা প্রেতাত্মা হয়েই থাকেন। তাঁরা নিজ দেশের স্বার্থে চকিদার। টকশোর ভাষায়, ভ্যানগার্ড। মানে রক্ষক। প্রয়োজনে ভক্ষক হয়ে যান। এর উদাহরণ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে একাধিক আছে। আছে এই সেদিনের ঘটনা হিসেবেও। আমাদের এই উপমহাদেশেও এর নিদারুণ ইতিহাস খুব বেশি প্রাচীন নয়। প্রসঙ্গক্রমে বলা যায়, ব্রিটিশ রাজ নানান প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে ছলে-বলে-কৌশলে আমাদের উপমহাদেশ দখল করেছিল। সাধারণভাবে যা বলা হয় তাতে প্রতিভাত হতে পারে, সব দোষ ব্রিটিশদের। কিন্তু বাস্তবতা মোটেই তা নয়।

সেই সময় উপমহাদেশে মুঘলদের ক্ষমতার ভিত খুবই দুর্বল হয়ে পড়েছিল। সঙ্গে ছিল শাসক শ্রেণির অভ্যন্তরীণ নানান কোন্দল, ষড়যন্ত্র ও পাল্টা ষড়যন্ত্র। এই সুযোগ নিয়েই ব্রিটিশরাজসহ অনেকে এই উপমহাদেশে প্রবেশ করে। কিন্তু লং রেসে সবাইকে হটিয়ে শক্ত অবস্থান করে নেয় ইংরেজরা। সঙ্গে ইতিহাস থেকে স্মরণ করা যেতে পারে, ইংরেজরা ভারতীয় উপমহাদেশে প্রবেশ করেছিল বাংলা হয়ে। যার কেন্দ্রে ছিল কলকাতা। তখন নানা মোর্শেদকুলি খানের কাছ থেকে মুর্শিদাবাদের নবাবী পাওয়া সিরাজুদ্দৌলার মসনদের ভিত ছিল নাজুক। আর তাঁর বিরুদ্ধাচারীর সংখ্যা ছিল অসংখ্য। এর সুযোগ পুরো মাত্রায় নিয়েছে প্রচলিত প্রবচনের ‘সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপারের’ দেশটি। ব্রিটিশরা মুঘলদের মতো জনবিচ্ছিন্ন রাজাদের হটিয়ে দখল করার পথে আসেনি। বরং ডারইউনের সূত্রকে সামাজীকরণের আওতায় অনুন্নত জনগোষ্ঠীকে উন্নত করার বুলি আউড়ে ভারতবর্ষের সমৃদ্ধ অঞ্চল বাংলাকে দখল করেছিল। তারা বলার চেষ্টা করেছে, উন্নত মানবগোষ্ঠী হিসেবে অনুন্নত জনগোষ্ঠীর প্রতি তাদের কর্তব্য আছে। এবং প্রায় দুই শ বছর ধরে ভারতবর্ষ লুণ্ঠন শেষে ফিরে গেছে। তবে যাওয়ার সময় চিরকালের বিরোধের বিষবৃক্ষ রোপণ করে গেছে। এরপরও আমাদের অবতার হয়েছিল বহু বছর। এখনো প্রশংসিত হয়। ব্রিটিশ রাজ এই উপমহাদেশে এসেছিল নির্দোষ বাণিজ্যের কথা বলে। তাদের পক্ষে কাজ করার লোকের সংখ্যা ছিল অগুনতি। এবং নাটক-সিনেমায় দেখানো দৃশ্যপট অনুসারে লর্ড ক্লাইভের হাত ধরে মসনদে বলেছিলেন সিরাজুদ্দৌলার প্রধান সেনাপতি মীর জাফর আলী খান। কিন্তু তার শেষ রক্ষা হয়নি। হয়ও না! এটি আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতারা যতটা বিবেচনায় নেবেন ততই মঙ্গল।

সঙ্গে আর একটি কথা বিবেচনা করা প্রয়োজন। তা হচ্ছে, সামরিক সরকার অথবা সামরিক প্রবণতার সরকার দিয়ে বেশি দিন টিকে থাকার অধ্যায় বাংলাদেশে অনেক আগেই পেছনে ফেলে এসেছে। যার অকাট্য প্রমাণ-ওয়ান-ইলেভেন সরকার। অনেক কষ্টে দুই বছর টিকলেও পরে আর থাকতে পারেনি। সেটি তো সামরিক সরকার ছিল না। ছিল সামরিক প্রবণতার অটোক্রেটিক সরকার। যা পরে সংবিধানের আওতায় আনা হয়েছে। দাঁড়াচ্ছে, যে খোলসেই হোক, জোর খাটিয়ে ক্ষমতায় আসা অথবা থাকার একটি মেয়াদ থাকে। যা অনিশ্চিত। এই মেয়াদ বিভিন্ন মাত্রার হতে বাধ্য। এটি মনে রাখা প্রয়োজন। এ প্রসঙ্গে একটি কথা স্মরণ করা যেতে পারে। ছাত্রলীগ থেকে বেড়ে ওঠা রাজনীতিক মনিরুল হক চৌধুরী বেগম খালেদা জিয়ার সরকারে আমলে এক আলাপচারিতায় বলেছিলেন, ‘আমাদের দেশের রাজনীতির মৌলিক প্রবণতা হচ্ছে, সরকার জোর খাটালে তা হয় রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস।’

আর সরকারের চেয়ে বহু গুণ বেশি করলে তা অনেক সময়ই বিবেচিত হয় ‘বিপ্লব’ হিসেবে। এর সঙ্গে আর একটি বাস্তবতা আছে। তা হচ্ছে, জনগণকে পাশ কাটিয়ে কথিত বিপ্লব এবং রাষ্ট্রের সন্ত্রাস ক্লাইমেস্কে পৌঁছালে ভাগের পিঠা চলে যেতে পারে মগডালে বসে থাকা বাঁদরের হাতে অথবা জমিনে বিচরণকারী শিয়ালের গ্রাসে। তখন পুরো দায়ই কিন্তু রাজনীতিকদের ওপর বর্তাবে। পিটার হাসদের কেউ দুষবে না। বলে রাখা ভালো, দেশ যেমন রাজনীতিকরা রক্ষা করেন; তেমনি দেশ ধ্বংসও কিন্তু রাজনীতিকদের কারণেই হয়। মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের রাজনীতিকরা দেশকে আসলে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন!

লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

সর্বশেষ খবর