শনিবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

কেন্দ্রীভূত শাসন আর কতকাল!

মোশাররফ হোসেন মুসা

কেন্দ্রীভূত শাসন আর কতকাল!

নিরপেক্ষ ও অনিরপেক্ষ নির্বাচন হয়, সরকার যায় আবার নতুন সরকার গঠিত হয়, কিন্তু কোনো সরকারই কেন্দ্রীভূত সরকারব্যবস্থা বিলোপ করে না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, তারা গণতন্ত্রকে বুলি হিসেবে গ্রহণ করেছে, বাস্তবায়নের জন্য নয়। বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে বিএনপিসহ অন্যান্য বিরোধী দলগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি করছে। ধরা যাক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো, বিএনপি ক্ষমতায় গেল; তারা যে সরকারের বিকেন্দ্রীকরণ, স্বশাসিত স্থানীয় সরকার বাস্তবায়ন, স্বাধীন নির্বাচন কমিশন গঠনসহ জনগণের ক্ষমতায়নের জন্য প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যকর করবে এর নিশ্চয়তা কোথায়! যেহেতু তারা এ পর্যন্ত কোনো ভুল স্বীকার করেনি এবং এ বিষয়ে রূপরেখাভিত্তিক কোনো কর্মসূচিও দেয়নি। বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ তোলা যায়। বাংলাদেশের সংবিধানে গণতন্ত্রকে রাষ্ট্র পরিচালনার অন্যতম মূলনীতি হিসেবে গণ্য করা হলেও আমাদের সরকারব্যবস্থা অত্যন্ত কেন্দ্রীভূত। সরকারগুলো ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক সরকারের উত্তরাধিকার বহন করে চলেছে। লক্ষণীয়, ভারত ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হওয়ার পরই একটি গণতান্ত্রিক সংবিধানের আওতায় সে দেশের উপযোগী যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো গ্রহণ করে; তথা কেন্দ্রীয় সরকার, রাজ্য সরকার ও স্থানীয় সরকার। সেই সঙ্গে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্টসহ স্বাধীন বিচার বিভাগ, স্বাধীন নির্বাচন কমিশন ও স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশনও গড়ে তোলা হয়। রাষ্ট্র পরিচালনার অন্যতম নীতি হিসেবে সেখানে বিকেন্দ্রীভূত সরকারের ধারণাকে গ্রহণ করা হয়। পরবর্তীকালে ভারতে এ নীতির প্রয়োগ ঘটিয়ে নতুন নতুন প্রদেশ গঠিত হতে দেখা যায়। সে ধারা এখনো অব্যাহত আছে। তা ছাড়া প্রদেশের অভ্যন্তরে স্থানীয় সরকারগুলোর স্বায়ত্তশাসনের বিষয়েও অগ্রাধিকার দিয়েছে দেশটি। ১৯৯৩ সালে ভারতীয় সংবিধানের তিয়াত্তরতম সংশোধনীর কথা এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে; এটার ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন প্রদেশে গড়ে উঠেছে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা। এসবের ফলে সেখানে ক্ষমতা বহুকেন্দ্রে বিভক্ত হয়েছে আর রাজনৈতিক বিরোধ মীমাংসায় প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্যের পদ্ধতি গড়ে উঠেছে। অন্যদিকে পাকিস্তানকে এ বিষয়ে শুরু থেকেই হোঁচট খেতে দেখি। সেখানে ১৯৪৭ সালে রাষ্ট্র্র গঠিত হওয়ার পর ৯ বছর লেগেছে সংবিধান প্রণয়নের কাজে। ১৯৫৬ সালের সংবিধানে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন খুব কমই ছিল আর স্থানীয় সরকারব্যবস্থাও ছিল ব্রিটিশ আমলের মতো। ১৯৫৮ সালে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার আগেই সামরিক শাসন জারি হলে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান আবির্ভূত হন প্রেসিডেন্ট হিসেবে। পাকিস্তান আমলে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের অনুপস্থিতিতে যে কেন্দ্রীভূত সরকারব্যবস্থা গড়ে ওঠে তার প্রতিবাদেই মূলত পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশ তথা বাংলাদেশ স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে যায়। আশা করা গিয়েছিল, স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারগুলো কেন্দ্রীভূত সরকারের ধারণাকে পরিহার করে কেন্দ্রীয় অর্থাৎ জাতীয় সরকারের ক্ষমতাকে বিকেন্দ্রীকরণ করে ব্যতিক্রমী শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করবে, যা হবে জনকল্যাণমুখী। ১৯৭৫ সালে জেলা গভর্নর ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। কিন্তু ১৫ আগস্টের পটপরিবর্তনে তার বাস্তবায়ন বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৭৫ সালের মধ্য আগস্টের মর্মান্তিক ঘটনায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হওয়ার পর যে সামরিক সরকারগুলো ক্ষমতায় এসেছে তারা যথারীতি আইয়ুব খানের পদাঙ্ক অনুসরণ করে স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে নিজেদের ক্ষমতাকে বৈধতা দানের চেষ্টা করে। এদিকে ১৯৯০ পরবর্তী স্বৈর শাসন-উত্তর সরকারগুলো জাতীয় ক্ষেত্রে সংসদীয় গণতন্ত্রের মাধ্যমে সংসদ সদস্যদের ক্ষমতাকে বৃদ্ধি করতে যতটা আগ্রহী হয়েছে ততটাই অনাগ্রহী হয়েছে বিকেন্দ্রীভূত স্থানীয় সরকারব্যবস্থা প্রবর্তনে। কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থা এক পর্যায়ে ব্যক্তিকেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা নিয়ে আসে। যার প্রভাব তৃণমূল পর্যায়ে পড়তে দেখা যায়। বর্তমানে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কেন্দ্র করে রাজনীতিতে যে জটিল অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে তার জন্য ত্রুটিযুক্ত শাসনব্যবস্থাই দায়ী। আওয়ামী লীগের বহু নেতা প্রকাশ্যেই বলছেন, বিএনপি ক্ষমতায় এলে বহু লোকের প্রাণহানি ঘটবে। অনেকে মনে করেন, জামায়াতমুক্ত বিএনপি সহনীয় কিন্তু জামায়াতযুক্ত বিএনপি ভয়ংকর। এটা ঠিক মৌলবাদী রাজনীতি কখনো গণতন্ত্র নিয়ে আসে না। উল্টোভাবে বলা যায়, অগণতান্ত্রিক রাজনীতি মৌলবাদী রাজনীতির উত্থান ঘটায়। তা ছাড়া অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় জবাবদিহিতা না থাকায় দলীয় সন্ত্রাসের বিস্তারসহ ব্যাপক দুর্নীতির ঘটনা ঘটে। সে জন্য জনগণের ক্ষমতায়নের স্বার্থে সর্বস্তরে গণতন্ত্র বাস্তবায়ন করতে হবে। আপাতত দুই প্রকারের সরকারব্যবস্থা তথা কেন্দ্রীয় সরকারব্যবস্থা ও স্থানীয় সরকারব্যবস্থা সমাধানের দিকে নিয়ে যেতে পারে। জাতীয় ও বৈশ্বিক কাজ কেন্দ্রীয় সরকারের জন্য নির্দিষ্ট থাকবে আর স্থানীয় যাবতীয় কাজ স্থানীয় সরকারের হাতে ছেড়ে দিতে হবে। সমগ্র দেশটি নগরায়ণের দিকে ধাবিত হওয়ায় পরিবেশবান্ধব ও পরিকল্পিত নগরায়ণের চিন্তা এখনই মাথায় নিতে হবে। স্থানীয় ইউনিটগুলোর সময়োপযোগী স্তরবিন্যাস করে প্রতিটি ইউনিটকে প্রজাতান্ত্রিক রূপ দিতে হবে। জেলা সরকার হবে স্থানীয় সরকারের সর্বোচ্চ স্তর।

জেলা সরকার এক হাতে নগর সরকার এবং অন্য হাতে গ্রামীণ সরকারগুলো নিয়ন্ত্রণ করবে। জেলা সরকার থেকে প্রতিনিধি নিয়ে জাতীয় সংসদের উচ্চকক্ষ সৃষ্টি করা যেতে পারে অথবা জাতীয় ও স্থানীয়তে একই সঙ্গে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বার্থে প্রতিটি গণতান্ত্রিক দলের কাছ থেকে রূপরেখা আহ্বান করা যেতে পারে। যেমন একটি দল ‘গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকারের রূপরেখা, আরেকটি দল গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারের রূপরেখার প্রস্তাব করল- এভাবে গণতান্ত্রিক নির্বাচন কমিশন, গণতান্ত্রিক আইন কমিশন, গণতান্ত্রিক বিচার বিভাগ, গণতান্ত্রিক পুলিশিংব্যবস্থা, গণতান্ত্রিক বিদ্যুৎব্যবস্থা, গণতান্ত্রিক শিক্ষাব্যবস্থা, গণতান্ত্রিক চিকিৎসাব্যবস্থা ইত্যাদি গ্রহণ করে ব্যাপক জাতীয় ঐকমত্য সৃষ্টি করা সম্ভব। এ দেশের প্রতিটি নাগরিক সুষ্ঠু নির্বাচন চাচ্ছে। অর্থাৎ তাদের আকাক্সক্ষায় গণতন্ত্র রয়েছে। কাজেই উপরোক্ত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা হলে জনগণ অবশ্যই স্বাগত জানাবে।

লেখক : গণতন্ত্রায়ণ ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারবিষয়ক গবেষক

সর্বশেষ খবর