রবিবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

শামসুন্নাহার হলে ছাত্রদলের বর্বরতা যেন ভুলে না যাই

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক

শামসুন্নাহার হলে ছাত্রদলের বর্বরতা যেন ভুলে না যাই

গত কয়েক মাস ধরে বিএনপি নামক রাজনৈতিক দলটি, তাদের একান্ত দোসর ধর্মান্ধ জামায়াতে ইসলামী দলের সঙ্গে মিলিত থেকে গোটা দেশে যে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছে তা দেখে বিএনপির আদি ইতিহাস ঘাঁটার প্রয়োজন সবাই অনুভব করেন। ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, বিএনপির জন্মই হয়েছিল খুনসহ বিভিন্ন জঙ্গি কার্যকলাপের মাধ্যমে। আরও দেখা যায় যে, দলটি তাদের সেই অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড সব সময়ই চালিয়ে গেছে। এ ব্যাপারে অনেক তথ্য উপস্থাপন করা হলেও ২০০২ সালের ২৩ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের আবাসস্থল, শামসুন্নাহার হলে বিএনপির ছাত্রদল এবং তাদের পালিত কিছু পুলিশ কর্তা মধ্যযুগীয় কায়দায় যে তাণ্ডব চালিয়েছিল, সেটি স্থান পাচ্ছে না। সম্ভবত সে ঘটনার কথা আমরা বেমালুম ভুলে গেছি। সে সময় বিএনপি ছাত্রদলের কয়েকজন মহিলা নেত্রী বেআইনিভাবে শামসুন্নাহার হলে রুম দখল করে বাস করায় সাধারণ ছাত্রীরা প্রতিবাদমুখর হলে বিএনপি নেতা তারেক জিয়া খেপে যান এবং তার দলের ছাত্রদের নির্দেশ দেন প্রতিবাদী ছাত্রীদের উচিত শিক্ষা দিতে। একই সময়ে তারেক জিয়া তার প্রতি অনুগত পুলিশ কর্মকর্তাদেরও সেই নির্দেশ দেন।

২০০২ সালের ২৩ জুলাই তারেক জিয়া এবং বিএনপির ছাত্রদল নেতাদের নির্দেশনা পেয়ে সর্বকালের কুখ্যাত পুলিশ কর্মকর্তা কোহিনুরের নেতৃত্বে ঢাকা মহানগর পুলিশের যে দলটি শামসুন্নাহার হলে মধ্যযুগীয় কায়দায় বর্বরতা চালিয়ে ছিল তা এতই বীভৎস ছিল যে, সে কথা ভুলে যাওয়ার নয়। ঘটনাটি জুলাই মাসের ২৩ তারিখে ঘটলেও নভেম্বর মাসে এটি বেশি মনে পড়ে এ জন্য যে, সেই মাসেই ওই পৈশাচিক ঘটনার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদে ভেঙে পড়েছিল গোটা দেশ। অন্যান্য দাবির মধ্যে ছিল ২৩ জুলাইকে কৃষ্ণ দিবস ঘোষণা করা, অপরাধীদের সাজা এবং তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা।

সেই কৃষ্ণগহ্বরে নিমজ্জিত দিনটিতে বিএনপির ছাত্র সংস্থা, ছাত্রদলের নেতাদের নির্দেশে বিএনপির লেজুড়বৃত্তি করা কোহিনুর নামক কুখ্যাত পুলিশ কর্মকর্তার নেতৃত্বে কয়েক ডজন পুরুষ পুলিশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উল্লিখিত মহিলা ছাত্রী হলে প্রবেশ করে বহু ছাত্রীকে উলঙ্গ করে, যে নির্যাতন চালিয়েছিল, তাকে যৌন হেনস্তা বৈ কিছু বলা যায় না। ছাত্রদল নেতারা এবং পুলিশ কমপক্ষে ১০০ জন ছাত্রীকে মাঝরাতে তাদের শয্যা থেকে তুলে, উলঙ্গ বা অর্ধ উলঙ্গ করে এমন অকথ্য নির্যাতন চালিয়েছিল, যার তুলনা বিরল। অতীতকালে তৈমুর-চেঙ্গিস-নাদির শাহর মতো রাজারা পরাজিত দেশের নারীদের ওপর যেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ত, কোহিনুরের নেতৃত্বে পুলিশ এবং ছাত্রদলের পুরুষ নেতাদের পৈশাচিকতা অনেকটা তেমনই ছিল। ১৯৭৫-এর ৩ নভেম্বর মোশতাক-জিয়ার পালিত খুনিরা জেলখানার অভ্যন্তরে অসহায় চার নেতার ওপর যেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, ২০০২ সালের ২৩ জুলাই খালেদা-তারেক অনুগত পুলিশ এবং ছাত্রদল নেতারা একইভাবে শামসুন্নাহার হলের অসহায় ছাত্রীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। কমপক্ষে ৫০ জন ছাত্রী মারাত্মকভাবে আহত হয়েছিলেন। গোটা ছাত্রসমাজ ফুঁসে উঠলে পরদিন, ২৪ জুলাই উপাচার্য আনোয়ারুল্লা চৌধুরী এবং হলের প্রক্টর পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। দিশা হারিয়ে ফেলে পরিস্থিতি শান্ত করার মানসে খালেদা জিয়া সে সময়ের হাই কোর্ট বিভাগের মাননীয় বিচারপতি তাফাজ্জল ইসলামের নেতৃত্বে এক সদস্যের তদন্ত কমিশন গঠন করেন। সে সময়ের পুলিশের আইজি, সংশ্লিষ্ট কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা এবং কয়েকজন নির্যাতিতা ছাত্রীর সাক্ষ্য নেওয়ার পর মাননীয় বিচারপতি তাফাজ্জল ইসলাম যে বস্তুনিষ্ঠ এবং দুর্বার সাহসী প্রতিবেদন তৈরি করেছিলেন, সে ধরনের বলিষ্ঠ প্রতিবেদন খুব একটা দেখা যায় না। সে বছরের ৩ সেপ্টেম্বর বিচারপতি তাফাজ্জল ইসলাম প্রতিবেদনটি জমা দেন। কিন্তু তিনি নিশ্চয়ই আঁচ করতে পেরেছিলেন যে খালেদার সরকার তার প্রতিবেদন প্রকাশ করবে না। তাই তিনি নিজ উদ্যোগেই প্রতিবেদনটি টেলিভিশন এবং পত্র-পত্রিকার সাংবাদিকদের কাছে প্রকাশ করে দেন, যা অতীতে অন্য কোনো তদন্তকারী করেননি। বিচারপতি তাফাজ্জল ইসলাম তার ৫০০ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে ছাত্রীদের ওপর নির্যাতনের পুরো চিত্রটি উল্লেখ করে রাখঢাক না রেখেই লিখেছেন ছাত্রদল নেতারাই এই কলঙ্কিত ঘটনার জন্য প্রাথমিকভাবে দায়ী। তিনি নাম উল্লেখ করে দায়ী পুলিশ কর্মকর্তাদের শাস্তি এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্টদের অপসারণ ও বিচার হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেছেন।

মাঝরাতে যখন পুলিশ এবং ছাত্রদলের পুরুষ নেতারা হলের মূল দরজা ভেঙে এবং পরে ছাত্রীদের প্রতিটি কক্ষে অভিযান চালায়, তখন হলের কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিল। পুলিশ এবং ছাত্রদল নেতারা ছাত্রীদের অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেছিল।

২৪ জুলাই সেই দানবীয় ঘটনার কথা দেশের সব গণমাধ্যম পেরিয়ে বিদেশি পত্র-পত্রিকায়ও প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে ২০০৩, ২০০৪ এবং ২০০৫ সালে ইংরেজি ডেইলি স্টার পত্রিকা এবং বিডিনিউজ২৪ ডটকম খবরটি বহুল আকারে প্রকাশ করে। ওই দিনগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন ২০০২ সালের ২৪ জুলাই পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত বিভিন্ন ছবির সমন্বয়ে চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করে। তারা বিচারপতি তাফাজ্জলের প্রতিবেদন প্রকাশের দাবি জানালেও সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে তা কখনো করেনি, যদিও বিচারপতি তাফাজ্জল নিজে প্রতিবেদনের মূল কথাগুলো গণমাধ্যমে প্রকাশ করায় ঘটনার নির্মমতা কারও জানতে বাকি থাকেনি। বিচারপতি তাফাজ্জলের প্রতিবেদনে দায়ী পুলিশ এবং ছাত্রদল নেতাদের বিচারের নির্দেশনা খালেদা সরকার কখনো মানেনি, বরং প্রতিবেদনটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। খালেদা জিয়া এবং তার সরকার বিচারপতি তাফাজ্জলের ওপর চরমভাবে খেপে গিয়েছিলেন। বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা থাকলে খালেদা তাকে অপসারণই করতেন, কিন্তু সাংবিধানিক এই পদের কাউকে সরকার অপসারণ করতে পারে না বিধায় খালেদা তার জিঘাংসা চরিতার্থ করতে পারেননি। ১৮০৩ সালে মারবারি বনাম মেডিসন মামলায় সরকারের বিরুদ্ধে রায় দেওয়ার কারণে মার্কিন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি জন মার্শালের ওপর সে সময়ের মার্কিন প্রেসিডেন্ট জেফারসন যেভাবে খেপে গিয়েছিলেন, খালেদাও তেমনি খেপে ছিলেন বিচারপতি তাফাজ্জল ইসলামের ওপর। তবে দেশের আপামর জনগণ এই নির্ভীক, দেশপ্রেমিক বিচারপতি তাফাজ্জল ইসলামকে (যিনি পরবর্তীতে দেশে প্রধান বিচারপতির পদটি অলংকৃত করেছিলেন) কুর্নিশ করতে ভোলেননি। বিচারপতি তাফাজ্জল বহু নির্ভীক রায়ের জন্য চিরঞ্জীব হয়ে থাকবেন, যার সঙ্গে যুক্ত থাকবে শামসুন্নাহার হলে ছাত্রদল এবং বিএনপি পালিত পুলিশ কর্মকর্তাদের বর্বরতার বস্তুনিষ্ঠ প্রতিবেদনটিও। তবে আমরা যেন সে দিনটির কথা ভুলে না যাই। সেই দিনের বর্বর ঘটনাটিও জানান দেয় যে, বিএনপি সব সময়ই একটি সন্ত্রাসী দল হিসেবে বিরাজ করছে, অর্থাৎ বিএনপি বর্তমানে দেশে যে তাণ্ডব চালাচ্ছে তা নতুন কিছু নয়।

লেখক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি

সর্বশেষ খবর