রবিবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

নির্বাচন বর্জনে মঙ্গল নেই

মাজহারুল ইসলাম

নির্বাচন বর্জনে মঙ্গল নেই

বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর (অব.) আখতারুজ্জামান সোজাসাপ্টা কথার লোক বলে পরিচিত। দল যখন ক্ষমতায় ছিল তখনো তিনি সাচ্চা কথা বলতে ইতস্তত করেননি। উচিত কথায় বেজার হয়ে তাকে দল থেকে একাধিকবার বহিষ্কার করা হয়েছে। কিন্তু এ বীর মুক্তিযোদ্ধা সাদাকে সাদা এবং কালোকে কালো বলার অভ্যাস ছাড়তে পারেননি। গত পাঁচ বছর ধরে বিজ্ঞ নেতাদের অনেকেই বলে আসছেন বিএনপিকে আবার ক্ষমতায় নিতে হলে পলাতক কারোর নেতৃত্বে দল চালালে চলবে না। আন্দোলনের নেতা যদি গ্রেফতারের ভয়ে বিদেশে পালিয়ে থাকেন তবে তার ডাকে কর্মীরাই তো রাস্তায় নামবে না-জনগণ তো দূরের কথা। দলের মধ্যে যারা সাহস করে সত্য বলার দুঃসাহস দেখিয়েছেন তাদের কথাই শেষ পর্যন্ত সত্য হতে চলেছে। বিশ্বমন্দার প্রভাবে দেশ গত ১৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে সংকটাবস্থা অতিক্রম করলেও বিএনপি সে অবস্থাতেও সুবিধা নিতে পারেনি। আন্দোলনের নামে অশ্বডিম্ব প্রসবই শুধু নিশ্চিত হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার তৃতীয় মেয়াদে পূর্ণ সময় পার করতে সক্ষম হয়েছে। নির্বাচন বানচাল করতে বিএনপির ডাকা হরতাল-অবরোধে মানুষ সাড়া দেওয়া দূরের কথা রাজপথে যানজটের দেখা মিলছে অন্য সময়ের মতো। দেশবাসী আশা করেছিল বিএনপি সরকারের সঙ্গে সংলাপে বসে কীভাবে সুষ্ঠু নির্বাচন করা যাবে সে রোডম্যাপ তৈরিতে অবদান রাখবে। সুযোগ ছিল সংসদে এ ব্যাপারে প্রস্তাব এনে সরকারকে আলোচনায় বাধ্য করা। কিন্তু সংসদ থেকে পদত্যাগ করে তারা সে সুযোগটির অপমৃত্যু ঘটিয়েছে বহু আগে। দুষ্টু লোকেরা বলে জামায়াতের বুদ্ধিতে চলতে গিয়ে বিএনপি আম-ছালা দুই-ই হারাতে চলেছে। ইতোমধ্যে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের শিডিউল ঘোষণা করা হয়েছে এবং ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হবে কাক্সিক্ষত ভোট উৎসব। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (ইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দলের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন। বিদ্যমান মতপার্থক্য নিরসনে তিনি রাজনৈতিক দলগুলোকে সংঘাত পরিহার করে সমাধানের পথ অন্বেষণের আবেদন জানিয়েছেন। বলেছেন অবাধ, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক ও উৎসবমুখর নির্বাচনের জন্য কাক্সিক্ষত অনুকূল রাজনৈতিক পরিবেশের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কিন্তু নির্বাচন প্রশ্নে, বিশেষ করে নির্বাচনের প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতির প্রশ্নে দীর্ঘ সময় ধরে দেশের সার্বিক রাজনৈতিক নেতৃত্বে মতভেদ পরিলক্ষিত হচ্ছে। বহুদলীয় রাজনীতিতে মতাদর্শগত বিভাজন থাকতেই পারে। কিন্তু মতভেদ থেকে সংঘাত ও সহিংতা হলে তা থেকে সৃষ্ট অস্থিতিশীলতা নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বিরূপ প্রভাব বিস্তার করতে পারে। এ আশঙ্কার অবসানে তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নির্বাচন প্রশ্নে মতৈক্য প্রতিষ্ঠার তাগিদ দিয়েছেন। সংলাপের মাধ্যমে তা যে সম্ভব এমন আস্থাও রেখেছেন। নির্বাচন হলো দেশের মালিক মোক্তার জনগণের উৎসব। এ উৎসবের মাধ্যমে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব কাদের হাতে ন্যস্ত হবে দেশবাসী সে বিষয়ে ভোটাধিকার প্রয়োগ করে। রাজনৈতিক দলগুলোর মতপার্থক্যের কারণে গত দুটি নির্বাচনে জনগণের উৎসব করার মতো পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি। সে অনুদার মনোভাব থেকে বেরিয়ে এসে শতভাগ সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সব পক্ষকে ভোটযুদ্ধে অংশ নেওয়ার সদিচ্ছা দেখাতে হবে। নির্বাচন বর্জনের অক্ষমতার বদলে জনগণের শক্তির প্রতিফলন ঘটাতে তাদের রায় মেনে নেওয়ার সাহসও দেখাতে হবে রাজনৈতিক দলগুলোকে।

২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি যে নির্বাচন হতে যাচ্ছে তাতে সরকারের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপির অংশগ্রহণ ইতোমধ্যে অনিশ্চিত হয়ে উঠেছে। বিএনপি এবং সমমনারা আন্দোলনে ব্যর্থ হয়ে এখন নির্বাচন প্রতিহত করার স্বপ্ন দেখছেন। বিদেশি প্রভুরা অর্থাৎ ওয়াশিংটন-লন্ডন-তেল আবিবের বাবাজান, চাচাজানরা বিএনপি-জামায়াতকে ক্ষমতায় বসিয়ে যাবে এমন স্বপ্ন দেখছেন।

বিএনপির প্রবীণ নেতা সাবেক সংসদ সদস্য (অব.) আখতারুজ্জামান স্বীকার করেছেন, বিএনপিসহ সরকারবিরোধী সব রাজনৈতিক দল ঐক্যবদ্ধ হয়ে সম্মিলিত প্রতিরোধ করেও নির্বাচন ঠেকাতে পারবে না। নির্বাচন কখনো ঠেকানো যায় না। হয়তো ভোটার উপস্থিতি কমিয়ে দেওয়া যায়। প্রতিযোগিতামূলক কোনো নির্বাচন না হলে সেখানে ভোটার যেতে চায় না। তবে ভোটার উপস্থিতি কম বা বেশি তাতে নির্বাচনের সুষ্ঠুতায় কোনো ব্যাঘাত সৃষ্টি করে না। তাছাড়া ভোটার উপস্থিতি কম হলে নির্বাচন অবৈধ হয় না। তবে তা হয়তো অনেকের কাছে গ্রহণযোগ্য হয় না। কিন্তু যাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয় না, তাদের মতামতের তোয়াক্কাই বা কে করে?

মেজর (অব.) আখতারুজ্জামান প্রথম থেকেই বিএনপিকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে আসছেন। দলের মাঠপর্যায়ের নেতাদের মনের কথা ফুটে উঠেছে তার বক্তব্যে। দল সে পথে না যাওয়ায় তিনি বিএনপির বন্ধু-বান্ধবদের অনুরোধ করে বলেছেন, আপনারা কেউ তৃণমূল বা অন্য কোনো দলে যোগদান করবেন না। তার বদলে যার যার নির্বাচনি এলাকায় দুই বা তিনজন নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়ে যাবেন। তার মধ্যে যাদের মনোনয়ন বৈধ হবে তারা সবাই নির্বাচন পর্যন্ত নির্বাচনে থাকবেন। যদি পরিবেশ অনুকূলে থাকে তাহলে শেষ পর্যায়ে একজনকে বিজয়ী করে আনবেন।

বাংলাদেশের মানুষ নির্বাচনের প্রতি আলাদা আবেগ অনুভব করে। এ দেশে নির্বাচন বর্জনের রাজনীতি করে মওলানা ভাসানীর মতো বিশাল নেতাও তাঁর দলের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারেননি। সে পরিণতি না চাইলে বিএনপিকে নির্বাচনের পথে ফিরে আসতে হবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক

সর্বশেষ খবর