রবিবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

মুসলমানরা ভাই ভাই একটি দেহের ন্যায়

মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমান

পবিত্র কোরআনে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুপম চরিত্রের প্রশংসা করে বলা হয়েছে, ‘হে রসুল! নিঃসন্দেহে আপনি মহান চরিত্রের অধিকারী।’ (সুরা কালাম-০৪)। হুজুর (সা.) সব মানুষের জন্য মহান শিক্ষকরূপে প্রেরিত হয়েছেন। মানব চরিত্রে যতগুলো সৎ গুণ থাকতে পারে তার সবকটি রসুল (সা.)-এর চরিত্রে মূর্তমান হয়েছে। তাঁর নূরে আলোকিত সাহাবায়ে কেরামগণ ছিলেন রসুল চরিত্রের মহাকাশে প্রজ্বল তারকা ও নক্ষত্রসদৃশ। তাদের প্রশংসায় কোরআনে অসংখ্য আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে। ইতিহাস ও হাদিসের পাতায় পাতায় রয়েছে তাঁদের আত্মত্যাগের অসংখ্য অসাধারণ ঘটনা। যিনি ভিতরে-বাইরে সাহাবায়ে কেরামগণকে নূরানি শিক্ষায় আমূল পরিবর্তন এনে দিয়েছেন তিনি নূর নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)। তাঁর চারিত্রিক বিভায় আলোকিত সাহাবায়ে কেরামগণ এ উম্মতের জন্য নক্ষত্রতুল্য। এ জন্যই হুজুর (সা.) বলেছেন, ‘আমার সাহাবিরা নক্ষত্রতুল্য। তোমরা এদের যাকেই অনুসরণ কর না কেন, হেদায়েতপ্রাপ্ত হবে।’ অন্য হাদিসে তিনি বলেন, ‘সর্বোত্তম যুগ হচ্ছে আমার যুগ, তারপরে আমার সাহাবিগণের যুগ, তারপর তাবেয়িগণের যুগ।’ তাই সোনালি যুগের এসব সোনার মানুষকে পরিপূর্ণ অনুসরণ ও অনুকরণেই প্রকৃত সাফল্য আসতে পারে। পতনোন্মুখ মুসলিম জাতি ফিরে পেতে পারে তাঁর হৃতগৌরব ও হারানো ঐতিহ্য।

পবিত্র কোরআন ও হাদিসের আলোকে মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধ : পবিত্র কোরআনে আল্লাহ রব্বুল আলামিন ইরশাদ করেন, ‘মুমিনগণ কেবল ভাই ভাই।’ (সুরা হুজুরাত-১০) অন্য আয়াতে তিনি ইরশাদ ফরমান, ‘তারা কাফেরদের ওপর অত্যন্ত কঠোর, নিজেদের মাঝে পরম সহনশীল।’ (সুরা মুহাম্মদ-২৯) হাদিসে পাকে রসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘প্রত্যেক মুসলমানের জন্য অপর মুসলমানের জানমাল ও ইজ্জত নষ্ট করা হারাম।’ (বুখারি-৬০৬৪) ‘মুমিনদের পরস্পরের ভালোবাসা, অনুগ্রহ, হৃদ্যতা ও আন্তরিকতার উদাহরণ হচ্ছে একটি দেহ বা শরীরের মতো। যখন দেহের কোনো একটি অঙ্গ আহত হয়, তখন সারা দেহের সবা অঙ্গ নিদ্রাহীন হয়ে পড়ে এবং কষ্ট ও যন্ত্রণায় জরাগ্রস্ত ও কাতর হয়ে পড়ে।’ (বুখারি-৬০১১) সাহাবায়ে কেরাম ও সোনালি যুগের মুমিনগণ উপরোক্ত কোরআন ও হাদিসের বাস্তব নমুনা। তাই তো কালামে পাকে তাদের প্রশংসা করে বলা হয়েছে, ‘তারা ক্ষুধার্ত হলে কী হবে, তারা অপরকে নিজেদের ওপর প্রাধান্য দেয়।’ (সুরা হাশর-০৯)

হাদিস ও ঐতিহাসিক গ্রন্থে মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধের অনুপম নজির : আম্মাজান হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) বলেন, রসুলে করিম (সা.) কখনো উপর্যুপরি তিন দিন পেটভরে আহার করেননি। দুনিয়া থেকে বিদায় নেওয়া পর্যন্ত এমনি অবস্থা অব্যাহত ছিল। আমরা ইচ্ছা করলে পেটভরে খেতে পারতাম। কিন্তু মুহাজিরগণকে পেটভরে খাওয়ানো আমাদের কাছে অগ্রগণ্য ছিল। আম্মাজান আরও বলেন, একবার আমাদের বাড়িতে এক অতিথি আগমন করল। ঘরে তখন কিছুই ছিল না। এমন সময় জনৈক আনসারী সেখানে এলো এবং অতিথিকে সঙ্গে নিয়ে গেল। বাড়ি পৌঁছে অতিথির সামনে সে খাবার রেখে দিল এবং স্ত্রীকে বাতি নিভিয়ে দিতে বলল। সে অন্ধকারে নিজের হাত খানার দিকে বাড়াতে লাগল, মনে হচ্ছে যেন অতিথির সঙ্গে খেয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে সে খাচ্ছিল না। অবশেষে অতিথি সম্পূর্ণ খাদ্য খেয়ে নিল। প্রত্যুষে রসুল (সা.) আনসারীকে ডেকে বললেন, তোমার কাজে খুশি হয়ে আল্লাহ নিম্নোক্ত আয়াতে কারিমা নাজিল করেছেন, ‘তারা ক্ষুধার্ত হলে কী হবে, তারা অপরকে নিজেদের ওপর প্রাধান্য দেয়।’ (সুরা হাশর-০৯) মোটকথা, দানশীলতা আল্লাহর পছন্দনীয় কাজ হলেও আত্মত্যাগের মহিমা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পড়ে। আত্মত্যাগ রসুল (সা.)-এর নিত্যদিনের অভ্যাস ছিল। আত্মত্যাগের মাধ্যমে উম্মতে মুহাম্মদি বনি ইসরাইলের নবীদেরও ছাড়িয়ে গেছেন : হজরত সোহায়ল তস্তরি (রহ.) বলেন, হজরত মুসা (আ.) দোয়া করলেন, ইয়া এলাহি! আমাকে মুহাম্মদ (সা.) ও তাঁর উম্মতের কিছু মর্তবা দেখিয়ে দিন। ইরশাদ হলো, হে মুসা তুমি সহ্য করতে পারবে না। তবে একটি মহান মর্তবা দেখিয়ে দিচ্ছি, যার কারণে আমি তাঁকে তোমার ওপর ও সমগ্র সৃষ্টির ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি। এরপর একবারের জন্য ঊর্ধ্বজগতের আবরণ সরিয়ে নেওয়া হলো। হজরত মুসা (আ.) যখন উম্মতে মুহাম্মদির মর্তবা দেখলেন, তখন নূরের বিকীরণ ও আল্লাহর নৈকট্যের প্রভাবে তাঁর প্রাণ ওষ্ঠাগত হওয়ার উপক্রম হলো। তিনি আল্লাহর দরবারে আরজ করলেন, কোন বৈশিষ্ট্যের কারণে তাঁদের এ মাহাত্ম্য দান করা হলো। প্রত্যাদেশ হলো, একটি অভ্যাসের কারণে, যা আমি তাঁদের মধ্যে রেখেছি আর অন্য কাউকে দিইনি। অর্থাৎ আত্মত্যাগের অনন্য অসাধারণ গুণের জন্য। মহান আল্লাহ আরও বলেন, ‘হে মুসা! যদি কোনো ব্যক্তি সারাজীবন এই আত্মত্যাগ অবলম্বন করে এবং আমার কাছে আসে। আমি তার হিসাব নিতে লজ্জাবোধ করব এবং তাকে বেহিসাবে জান্নাতে দাখিল করব। শুধু তাই নয়, জান্নাতের যে স্থানে সে থাকতে চাইবে আমি তাকে সেই স্থানে জায়গা করে দেব।’

গোলাম ও আবদুল্লাহ ইবনে জাফরের অনন্য দানশীলতা ও আত্মত্যাগ : হজরত আবদুল্লাহ ইবনে জাফর নিজের কিছু জমি দেখার জন্য বের হন। পথে এক বাগানে কিছু সময় অবস্থান করলেন। বাগানে এক হাবশি গোলাম কাজ করছিল। যখন তার খাদ্য এলো ঠিক তখনই একটি কুকুর বাগানে ঢুকে তার কাছে এলো। গোলাম কুকুরটিকে একটি রুটি দিয়ে দিল। এটি খাওয়া শেষ হয়ে গেলে দ্বিতীয় রুটিটিও দিয়ে দিল। এরপর তৃতীয়টিও দিয়ে দিল। এভাবে দিতে দিতে সে সব রুটি কুকুরটিকে খাইয়ে দিল।

লেখক : সহকারী রেজিস্ট্রার (আইন), জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়

সর্বশেষ খবর