বুধবার, ২৯ নভেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

গতির আনন্দ না জীবনের নিরাপত্তা

তপন কুমার ঘোষ

গতির আনন্দ না জীবনের নিরাপত্তা

তিন বন্ধু একসঙ্গে চেপে বসেছিল মোটরসাইকেলে। স্কুলে যাচ্ছিল পরীক্ষা দিতে। পথিমধ্যে ইঞ্জিনচালিত তিন চাকার যানের ধাক্কায় গুরুতর আহত হয় তারা। আহত অবস্থায় তাদের হাসপাতালে ভর্তি করা হলে একে একে তিন বন্ধুরই মৃত্যু হয়। পাবনা-ঈশ্বরদী সড়কে ৬ নভেম্বর এ মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে। এর দুই দিন আগে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মিরসরাইয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় তিন মোটরসাইকেল আরোহী নিহত হন। এদের দুজন উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। নভেম্বরের গোড়ার দিকে রাজধানীর নিউ ইস্কাটন এলাকায় মধ্যরাতে ট্রাকের চাপায় দুজন মোটরসাইকেল আরোহী নিহত হন। কয়েক সপ্তাহ আগে চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে বাস-সিএনজিচালিত অটোরিকশার মুখোমুখি সংঘর্ষে একই পরিবারের সাতজন প্রাণ হারিয়েছেন। এক আত্মীয়ের শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে যোগ দিতে তারা অটোরিকশাযোগে হাটহাজারীতে যাচ্ছিলেন। কী মর্মান্তিক। সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত সাম্প্রতিক কয়েকটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনার খবর এখানে উল্লেখ করা হলো মাত্র।

সড়ক-মহাসড়কে নিত্যদিন ঘটছে এমন দুর্ঘটনা। শুধু স্থান-কাল-পাত্র আলাদা। ‘সড়ক যেন মৃত্যুফাঁদ’ শিরোনামে প্রতিবেদন মাঝেমধ্যেই ছাপা হয় পত্রিকার পাতায়। মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর খবর আমাদের ব্যথিত করে। আমরা বিচলিত হই। সড়ক দুর্ঘটনার রাশ টেনে ধরার নানা উদ্যোগের কথা মাঝেমধ্যে শোনা যায়। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। ‘সড়কে থামছে না মৃত্যুর মিছিল’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন ১৫ নভেম্বর বাংলাদেশ প্রতিদিনে ছাপা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৯ থেকে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মোট ৩ হাজার ৮৯৬ জন শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়। এ হিসাবে সড়ক দুর্ঘটনায় দিনে অন্তত দুজন শিক্ষার্থী মারা যাচ্ছেন। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্যে এমনটি জানা যায় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির দুর্ঘটনা মনিটরিং সেলের তথ্যমতে, গত অক্টোবর মাসে সারা দেশে ৪২৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৩৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন ৬৮১ জন। নিহতদের প্রতি তিনজনের মধ্যে একজনই মোটরসাইকেল আরোহী। যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্যমতে, অক্টোবর মাসে বাংলাদেশে ১৩১টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১৪৪ জন আরোহী প্রাণ হারিয়েছেন। আহত হয়েছেন ৭৬ জন।

‘দুর্ঘটনার হটস্পট হানিফ ফ্লাইওভার’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন ছেপেছে বাংলাদেশ প্রতিদিন ১৪ নভেম্বর। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর হানিফ ফ্লাইওভারে সড়ক দুর্ঘটনায় ১০ বছরে ১ হাজার ১৪৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। দুর্ঘটনার বেশির ভাগই মোটরসাইকেল কেন্দ্রিক। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৪৯৯ জন, যা মোট মৃত্যুর ৪৪ শতাংশ। উল্লেখ্য, দুর্ঘটনায় প্রাণে বেঁচে গেলেও আহতদের অনেকে কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন। চিকিৎসা করাতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হন। চিরতরে পঙ্গু হয়ে যান অনেকে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মোটরসাইকেলের কারণে দেশে সড়ক দুর্ঘটনার হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দেশের মোট রেজিস্ট্রেশনপ্রাপ্ত যানবাহনের ৭২ শতাংশের বেশি মোটরসাইকেল। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে মোটরসাইকেলের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, এ অভিমত বিশেষজ্ঞদের।

আমার মনে একটা প্রশ্ন আছে। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর বিষয়টি যতটা গুরুত্ব পাওয়ার কথা ততটা গুরুত্ব কি পাচ্ছে? মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে এতটা হেলা কেন, তা অনেকের মতো আমারও বোধগোম্য নয়। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সচেতনতার বিকল্প নেই। এত মৃত্যুর পরও আমাদের সচেতনতা বাড়ছে না কেন? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনা অনিবার্য। এ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা অযথা। মৃত্যু নিয়তি-নির্ধারিত। এসব কথা ভেবে আমরা কি হাল ছেড়ে দিয়েছি?

যানবাহনের মালিক, চালক, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, পথচারী সবার গাফিলতি আছে। চালকদের বেপরোয়া মনোভাব, অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানো ও ওভারটেকিংয়ের কারণে সড়ক দুর্ঘটনা অহরহ ঘটছে। এ ছাড়াও দিনের পর দিন একটানা কাজের ফলে চালকদের শারীরিক ক্লান্তি ও মানসিক অবসাদ, মাদক সেবন, পথচারীদের অসতর্কতাসহ দুর্ঘটনার অনেক কারণ আছে। মহাসড়কগুলোতে দ্রুতগামী বাস-ট্রাকের পাশাপাশি চলছে ধীরগতির ত্রিচক্র যান। চলছে দুই চাকার মোটরসাইকেল। এতে দুর্ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ কথা সবাই একবাক্যে স্বীকার করেন, বিগত বছরগুলোতে দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলোর প্রভূত উন্নয়ন হয়েছে। ফলশ্রুতিতে, যানবাহনের গতি বেড়েছে। এ গতিই কাল হয়েছে অনেক ক্ষেত্রে। দুরন্ত গতিতে ছুটে চলা মালবোঝাই ট্রাকগুলো যেন মৃত্যুদূত। মহাসড়কের অনেক জায়গায় রোড ডিভাইডার নেই। অনেক স্থানে স্পিড ব্রেকার নেই। অবাক লাগে, খোদ রাজধানীতেও ফিটনেসবিহীন গাড়ি দিব্যি চলাচল করছে। এসব দেখার যেন কেউ নেই। আমাদের তরুণ ও যুবকদের একাংশ গতির নেশায় মেতে উঠেছে। এভাবে নিজেই নিজের বিপদ ডেকে আনছে। নতুন প্রজন্ম কি এতটাই অবুঝ, অপরিণামদর্শী? কোনো কিছুই গায়ে মাখতে নারাজ? কথায় বলে, ‘আপন বুঝ পাগলেও বোঝে’। শিক্ষা মানুষকে সচেতন করে। নতুন প্রজন্মের এ রকম তো হওয়ার কথা নয়। যুবকদের একাংশ গতির নেশায় পাগল হয়ে এ ধরাধাম হতে অকালে বিদায় নেবে, এটা মেনে নেওয়া কঠিন। গতির আনন্দ না জীবনের নিরাপত্তা, কোনটি বেশি মূল্যবান? বিষয়টা নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে হবে। জীবন অমূল্য। কড়ি দিয়ে কেনা যায় না। তাই জীবন নিয়ে ছেলেখেলা নয়। ‘সাবধানের মার নেই’ প্রবাদটা তো আর এমনি এমনি বলা হয় না। এ সত্যটা মনেপ্রাণে উপলব্ধি করতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনারোধে সংশ্লিষ্ট সবার দায়িত্বসচেতনতা একান্ত জরুরি।

লেখক : সাবেক উপব্যবস্থাপনা পরিচালক, জনতা ব্যাংক পিএলসি

সর্বশেষ খবর