বুধবার, ২৯ নভেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

মজুদদারি ও কালোবাজারি ইসলাম বিবর্জিত কাজ

মুফতি রুহুল আমিন কাসেমী

মজুদদারি ও কালোবাজারি ইসলাম বিবর্জিত কাজ

মানবতার নবী, প্রিয় নবী, রাহমাতুল্লিল আলামিন (সা.) ইরশাদ করেন : পৃথিবীর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি সে, যে মানুষের কল্যাণে কাজে আসে, আল হাদিস। অন্য হাদিসে ইরশাদ করেন : যে ব্যক্তি তার সাথিগণ ও প্রতিবেশীর কাছে ভালো সে আল্লাহতায়ালার কাছেও ভালো, আর যে ব্যক্তি নিজের সাথি এবং প্রতিবেশীর কাছে অপছন্দনীয়, সে আল্লাহতায়ালার কাছেও অপছন্দনীয়, আল হাদিস। ইসলাম সর্বময় শান্তির ধর্ম। আল্লাহর হুকুমের সামনে সর্বতোভাবে আত্মসমর্পণকারীই প্রকৃত মুসলিম। আর খাঁটি ইমানদার সে, যে নিজেও ধোঁকা খায় না এবং অন্য কেউ ধোঁকা দেয় না। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ধোঁকা দেয় সে আমার উম্মতের মধ্যে গণ্য হবে না। (তিরমিযি) নবীজি (সা.) আরও ইরশাদ করেন, তোমরা ক্রেতাকে প্রতারিত করার উদ্দেশে দাম বাড়াবে না। কেননা, প্রতারণার মাধ্যমে অর্জন করা জীবিকা, ইমানদারের জন্য হারাম।

আল্লাহতায়ালা কোরআনকারিমের মধ্যে ইরশাদ করেন, হে রসুলগণ! তোমরা পবিত্র বস্তু হতে আহার কর ও সৎকর্ম কর, তোমরা যা কর সে সম্বন্ধে আমি সবিশেষ অবহিত। (সুরা মুমিনুন ২৩:৫১)

তিনি আরও ইরশাদ করেন : হে মুমিনগণ! আমি তোমাদের যে হালাল রিজিক দান করেছি তা থেকে আহার কর। (বাকারা, ২:১৭২)

প্রিয় নবী (সা.) ইরশাদ করেন, একজন সৎ ও বিশ্বস্ত ব্যবসায়ী, নবী, সিদ্দিক, শহীদ ও নেককারদের সঙ্গে জান্নাতে বসবাস করবে। মূল্যবৃদ্ধির উদ্দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য আটকে রেখে অস্বাভাবিকভাবে মুনাফা হাসিল করাকে শরিয়তের পরিভাষায় ইহতিকার বা মজুদদারি বলা হয়। মজুদদারির ফলে অর্থনৈতিক ভারসাম্য ক্ষুণ্ন হয়। এ জন্য ইসলামী শরিয়তে একে নিষিদ্ধ ও হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। রসুলুল্লাহ (সা.) মজুদদারকে পাপী ও অভিশপ্ত বলেছেন। তিনি বলেন, পণ্যদ্রব্য আটক করে অধিক মূল্যে বিক্রয়কারী অবশ্যই পাপী। (মিশকাত : ২৫১)

অপর হাদিসে রসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, মূল্য বাড়ার উদ্দেশে যে ব্যক্তি ৪০ দিন পর্যন্ত খাদ্যশস্য মজুদ রাখে, সে ব্যক্তি আল্লাহর দায়িত্ব থেকে মুক্ত এবং আল্লাহ তার প্রতি অসন্তুষ্ট। (ইবনে মাজাহ ও বাইহাকি)

একজন মজুদদার খুবই নিকৃষ্টতম ব্যক্তি। যদি জিনিসপত্রের দর কমে যায়, তবে তারা চিন্তিত হয়ে পড়ে। আর যদি দর বেড়ে যায়, তবে আনন্দিত হয়। (হিদায়া)

কেউ যদি মুসলমানদের থেকে নিজেদের খাদ্যশস্য আটকে রাখে (মজুদদারি করে) আল্লাহতায়ালা তার ওপর মহামারি ও দারিদ্র্য চাপিয়ে দেন। এ প্রসঙ্গে নবীজি বলেন, গ্রামের প্রান্তিক চাষিগণ, তাদের উৎপাদিত খাদ্যশস্য বহন করে শহরে নিয়ে আসে, তাদের বাধা দিও না, তাদের সঙ্গে অগ্রে সাক্ষাৎ করে তাদের খাদ্যশস্য কম মূল্যে কিনে নিও না। (আল হাদিস)

রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, গ্রামের প্রান্তিক চাষি অত্যন্ত কঠোর পরিশ্রম করে খাদ্যশস্য উৎপাদন করে, একটু ভালো দামের আশায় তাদের কাফেলা শহরে এসে, ন্যায্যমূল্যে তাদের উৎপাদিত খাদ্যশস্য বিক্রি করে খুশিমনে নিজ গৃহে ফিরে যায় এবং শহরের ক্রেতাগণ ও ন্যায্যমূল্যে তাদের প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য পেয়ে যায়। এতে কারোরই মনঃক্ষুণ্ন ও প্রতারিত হওয়ার সুযোগ থাকে না। অথচ আজ মুসলমান ব্যবসায়ীদের চরিত্র দেখে ভিন্ন ধর্মের লোকেরাও হতবাক।

মানব সভ্যতায় কলঙ্কময় অধ্যায় রচনা করে চলছে একের পর এক। খাদ্যদ্রব্যসহ সব বস্তুর ওপর রয়েছে নিকৃষ্ট মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কালো থাবা। খাদ্যদ্রব্য মজুদ করে, কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা হচ্ছে। দর বৃদ্ধির পাহাড় ডিঙিয়ে, বহুগুণে মুনাফা লাভের আশায়, কালো টাকার পাহাড় গড়ার লক্ষ্যে, এ কুচক্রী মহল বাজারে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে। মগের মুল্লুকের মতো, সামান্য দশ-বিশ টাকার জিনিস, চার শ-পাঁচ শ টাকা হয়ে যায়। অপরদিকে খাদ্যদ্রব্য উৎপাদনকারী প্রকৃত প্রান্তিক চাষিরা, ন্যায্যমূল্য না পেয়ে হতাশাগ্রস্ত হয়ে খাদ্যদ্রব্য উৎপাদনে নিরুৎসাহিত হচ্ছে। তদুপরি ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটদের সামান্যতম কোনো আক্ষেপ বা আফসোস নেই। বরং তারা আনন্দে আত্মহারা হয়ে স্বপ্নে বিভোর। যেখানে বিশ্বে, রমজান মাসসহ বিভিন্ন সময়ে ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া হয়। সেখানে আমাদের দেশে অসাধু ব্যবসায়ীরা এসব সুযোগের অপেক্ষায় বসে থাকে। এক্ষেত্রে আল্লামা শামী (রহ.) বলেন। দেশে চরম দুর্ভিক্ষ ও কৃত্রিম সংকট দেখা দিলে, ইসলামী আদালত, এসব দুর্নীতিবাজ, সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের গোডাউন ভেঙে তাদের সংরক্ষিত খাদ্যশস্য জনগণের মধ্যে বিতরণ করে দেওয়া বৈধ। যাতে করে জনগণ তাদের চক্রান্তের শিকার হয়ে কষ্টে জর্জরিত না হয়। আল্লাহতায়ালা আমাদের বোঝার তৌফিক দান করুন, আমিন।

লেখক : ইমাম ও খতিব। কাওলারবাজার জামে মসজিদ, দক্ষিণখান, ঢাকা

সর্বশেষ খবর