ভোট আমি জীবনে বহুবার দেখেছি। কিন্তু ভোটের আনন্দ যদি কোথাও দেখে থাকি কিংবা পেয়ে থাকি তবে অবশ্যই আমাকে ফিরে যেতে হবে ২০০৮ সালের ডিসেম্বর মাসে। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের বিস্তীর্ণ সমুদ্রতীরের উর্বর ভূমি গলাচিপা ও দশমিনার প্রায় দেড় হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকার প্রায় সাত লাখ মানুষের মাঝে নির্ভীকচিত্তে ভোটের আনন্দ যেভাবে উপভোগ করেছি তার তুলনা জীবনের অন্য কোনো ভোগবিলাসের সঙ্গে কিংবা সফলতা প্রাপ্তির সঙ্গে তুলনীয় নয়। পরবর্তীতে সেই একই অঞ্চলে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে যে অবস্থার মাঝে পড়েছি তা হাড়ে হাড়ে টের পাওয়ার মতো। সুতরাং অতীতের সেসব অভিজ্ঞতার আলোকে ২০২৪ সালের নির্বাচন নিয়ে আমার মনে যেসব শঙ্কা ও আতঙ্ক ভর করেছে তা নিয়ে আলোচনার আগে আমার দেখা ভোটের সুখময় স্মৃতি নিয়ে কিছু বলা আবশ্যক।
সত্তরের দশকের ভোট বলতে আমার স্মৃতিতে ১৯৭৩ সালের জাতীয় নির্বাচনের কথা তেমন একটা মনে নেই। কিন্তু স্থানীয় নির্বাচন অর্থাৎ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে উৎসব হতো তা বাঙালির হাজারো দুঃখ-কষ্ট বেদনাকে ভুলিয়ে দিত। জিয়াউর রহমানের হ্যাঁ-না ভোট ছিল নিরুত্তাপ। কিন্তু জিয়াউর রহমান, জেনারেল ওসমানী এবং হাফেজ্জি হুজুর যেবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন প্রতিযোগিতা করেছেন সেবার পুরো বাংলা যেভাবে উৎসবমুখর হয়ে উঠেছিল এমনটি আর দ্বিতীয়বার ঘটেনি। পরবর্তীতে এরশাদ পতনের পর যখন সংসদীয় পদ্ধতি ফিরে এলো তখন ১৯৯১, ১৯৯৬ এবং ২০০১ সালের নির্বাচনে যে উৎসব বাঙালিকে উদ্বেলিত করেছিল তার চেয়ে চমকপ্রদ ছিল ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচন। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল অব্দি বিএনপি সরকারের ভুলভ্রান্তি, অনিয়ম দুর্নীতি এবং জুলুম অত্যাচারের ফলে যখন ১/১১ অনিবার্য হয়ে পড়ল তখন বিএনপি জামানার ভালো কাজগুলোও মনে করার কোনো সুযোগ জনগণ তো দূরের কথা কট্টোর বিএনপিপন্থি নেতা-কর্মীরাও পেলেন না। অধিকন্তু ১/১১-এর কুশীলবদের সর্বগ্রাসী দমনপীড়ন ভুল সিদ্ধান্ত দুর্নীতি রাষ্ট্র পরিচালনায় অদক্ষতা ও ব্যর্থতার কারণে সারা বাংলায় গণতন্ত্রের জন্য রীতিমতো হাহাকার শুরু হয়ে গেল। মানুষের অভিমান, অসহযোগিতা, অর্থনীতির চরম দুরবস্থা দেশের ব্যবসায়ী সম্প্রদায়কে খেপিয়ে তোলাসহ নানা অপকর্মের কারণে ১/১১-এর সরকার পুরোপুরি জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল। ফলে তড়িঘড়ি করে একটি নির্বাচন দিয়ে ক্ষমতা ছেড়ে নিরাপদে পালানোর যে আয়োজন তারা করল তাতে করে বাংলার মানুষের মধ্যে গণতন্ত্রের জোয়ার শুরু হয়ে গেল। আর সেই জোয়ারে একজন সংসদ সদস্য প্রার্থী হয়ে যখন আমি পটুয়াখালী-৩ আসনের মাটি ও মানুষের মাঝে গেলাম তখন আকাশ-পাতাল চাঁদ, সূর্য, দিন-রাত, নদী-সমুদ্রসহ পুরো প্রকৃতি ও পরিবেশের মধ্যে আমি গণতন্ত্রের বিজয়ধ্বনি অনুভব করতে লাগলাম। ২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনে আমার মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন আমার মামাশ্বশুর যিনি বিএনপির ধানের শীষ নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছিলেন। তিনি ছিলেন অতিশয় জনপ্রিয় এবং সাংগঠনিকভাবে দক্ষ-অভিজ্ঞ ও শক্তিশালী। তার ছিল বিশাল পারিবারিক ভোটব্যাংক। ফলে এলাকাটি আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হওয়া সত্ত্বেও সাবেক এমপি আ খ ম জাহাঙ্গীরের পক্ষে বিজয়ী হওয়াটা ছিল দুরূহ বিষয়। অধিকন্ত ১/১১-এর সময় সংস্কারবাদী গ্রুপে যোগ দেওয়ার কারণে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর চক্ষুশূলে পরিণত হয়েছিলেন। ফলে এক ঢিলে দুই পাখি মারার জন্য অর্থাৎ বিএনপি প্রার্থীর পারিবারিক ভোটে ভাগ বসানো এবং সংস্কারবাদী নেতা আ খ ম জাহাঙ্গীরকে একটি উচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ সভানেত্রী আমাকে দলীয় মনোনয়ন দেন।
![](/assets/archive/images/Print-Edition/2023/11.%20November/30-11-2023/BD-Pratidin_2023-11-30-19.jpg)
উল্লিখিত অবস্থায় ২০১৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে ২০১৯ সালের ২ জানুয়ারি পর্যন্ত প্রায় ৫০ জন পরিবারের সদস্য নিয়ে গৃহবন্দি ছিলাম। আওয়ামী ব্রিগেড দয়া করে আমার খানাপিনা বন্ধ করেনি। তবে আমার বাড়ির পুরনো কেয়ারটেকার জাফর ছাড়া অন্য কেউ ঘর থেকে বের হয়ে খাদ্যসামগ্রী কিনে আনার মতো অনুমতিপত্র বা দয়াদাক্ষিণ্য আওয়ামী ব্রিগেড যারা আমার বাসাবাড়ি ঘিরে রেখেছিল তাদের কোনো অনুকম্পা পায়নি। ফলে সেবার কেমন ভোট কীভাবে হয়েছিল তা চাক্ষুষ দৃষ্টি আমার নেই। কিন্তু আমার কান মোবারক ২০১৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর রাত ১০টার পর থেকে অন্তত ১০০টি ফোন পেয়েছে বিভিন্ন মাধ্যম থেকে। যারা সবিস্তারে বলেছেন কীভাবে থানা-পুলিশ এবং আওয়ামী লীগের লোকেরা রাতের মধ্যেই ভোটের মহাকাব্য রচনার কাজটি সমাধা করে ফেলেছিলেন।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য