সোমবার, ৪ ডিসেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

চীনে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের কৃষিযন্ত্র তৈরির প্রতিযোগিতা

শাইখ সিরাজ

চীনে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের কৃষিযন্ত্র তৈরির প্রতিযোগিতা

চীনের উহানে আয়োজন করা হয় এশিয়ার সবচেয়ে বড় কৃষি যন্ত্রপাতি মেলার। চীনে গত ৭০ বছরের অধিক সময় ধরে আয়োজন হয়ে আসছে এ কৃষি যন্ত্রপাতি মেলার। পৃথিবী থেকে আসা কৃষিযন্ত্র উৎপাদনকারী, প্রযুক্তিবিদ, উদ্ভাবক, কৃষি উদ্যোক্তা, ব্যবসায়ীসহ লাখো পর্যটকের অংশগ্রহণে জমজমাট এক আসর। চায়না এগ্রিকালচারাল ম্যাকানাইজেশন অ্যাসোসিয়েশন,  চায়না অ্যাসোসিয়েশন অব অ্যাগ্রিকালচারাল মেশিনারি মেনুফ্যাকচারার এবং চায়না এগ্রিকালচার মেশিনারিজ ডিস্ট্রিবিউশন অ্যাসোসিয়েশন যৌথভাবে আয়োজন করেছিল গত ২৬ থেকে ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত তিন দিনের এ মেলার। এবারকার মেলার মূল প্রতিপাদ্য ছিল রূপান্তরিত কৃষির বিকাশে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সংবলিত কৃষিযন্ত্র, ডিজিটাল ও স্মার্ট প্রযুক্তি।

প্রতিবারের মতোই এবারও প্রদর্শনীর পাশাপাশি ছিল বিভিন্ন বিষয়ে সেমিনার সিম্পোজিয়ামের আয়োজন। গবেষক ও বিশেষজ্ঞরা তুলে ধরেন তাদের গবেষণাপত্র। সেমিনারে অংশ নিয়েছেন বিভিন্ন দেশের কৃষিযন্ত্র ব্যবসায়ী, বিজ্ঞানী, সম্প্রসারণকর্মী, গবেষক, উদ্যোক্তা ও গণমাধ্যমকর্মী। স্টলে স্টলে সাজানো হাজার হাজার কৃষিযন্ত্রের পসরা। তবে মূল প্রতিপাদ্য মাথায় রেখে স্মার্ট কৃষি প্রযুক্তির অংশগ্রহণ ছিল এবার লক্ষ্য করার মতো। মেলার মূল কেন্দ্রে প্রবেশের গেটের পাশেই খোলা প্রান্তরে চোখে পড়ল অন্য রকমের কর্মকান্ড। মেলায় অন্য স্টলগুলোতে তৈরি নানা যন্ত্রের পসরা। আর ওখানে আগামীর কান্ডারিদের হাতে তৈরি হচ্ছিল ভবিষ্যতের যন্ত্র। আগামীর স্বপ্নকে বড় আর চিন্তাকে প্রসারিত রাখতে তরুণদের ভিতর সেই স্বপ্নের বীজ বুনে দিতে হয়। এ উপলব্ধি থেকেই চীন কৃষিযন্ত্রের বিকাশকে আধুনিকতর করতে তরুণদেরও যুক্ত রাখছে তাদের প্রতিটি কার্যক্রমে। প্রতি বছর এ মেলায় তরুণ শিক্ষার্থীদের কৃষিযন্ত্র তৈরির প্রতিযোগিতা তারই সাক্ষ্য বহন করে। একেকটি গ্রুপ চীনের একেক প্রদেশের ভিন্ন ভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসেছে। কিন্তু তাদের লক্ষ্য এক। তারা কাজ করছে একটি চিন্তাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার। এ বছরের প্রতিযোগিতা সম্পর্কে বিস্তারিত জানালেন চায়না অ্যাগ্রিকালচারাল ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপক লিং ওয়াং। তিনি জানালেন, প্রতিবছরই এ মেলাকে ঘিরে কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কৃষিযন্ত্র তৈরির প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। এ বছর এই প্রতিযোগিতায় চীনের ৪০টি বিশ্ববিদ্যালয় অংশগ্রহণ করছে। একেক বছর একেক টপিক দেওয়া হয়। এবারের বিষয়টি হচ্ছে পাকা স্ট্রবেরি উত্তোলনের জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সংবলিত রোবোটিক যন্ত্র তৈরি। দেখলাম শিক্ষার্থীরা দারুণ আগ্রহ নিয়ে কাজ করছে। অধ্যাপক লিং আরও জানালেন, চীনের যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রযুক্তি বিষয়ে পড়াশোনা ও গবেষণা হয়- প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে আন্তবিশ্ববিদ্যালয় প্রতিযোগিতা হয়। সেখান থেকে বাছাই করে ৪০টি বিশ্ববিদ্যালয় এখানে অংশ নিচ্ছে। এখানে যারা প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয় হবে তারা যাবে দেশের বাইরে আর একটি প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে। এখানকার একটি দল যাবে আমেরিকায় প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে। অন্যদিকে যন্ত্র তৈরি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে তাদের চুক্তি আছে। উদ্ভাবিত যন্ত্রটি তারা তৈরি করে। যারা নিয়মিত ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠানটি দেখেন, তাদের মনে থাকতে পারে, এর আগে ২০১৯ সালে দেখিয়েছিলাম চীনের চিংদাও-এ খুদে প্রকৌশলীদের যন্ত্র তৈরির প্রতিযোগিতা। চীন শিক্ষার্থীদের এ আবিষ্কারগুলো অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নেয়, তার প্রমাণ মিলেছে এবারকার মেলায়।

উন্নত রাষ্ট্রগুলোর বিশ্ববিদ্যালয় তাদের শিল্পপ্রতিষ্ঠান এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে নানা সূত্রে যুক্ত থাকে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের গবেষণা এবং তাদের নতুন চিন্তা বাস্তবায়নে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো সহায়তা করে। এমনটি আমরা দেখেছি নেদারল্যান্ডসের ভাগিনেংগন ইউনিভার্সিটিতেও। সেখানে খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠান ইউনিলিভার বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গবেষণাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। চীনেও যন্ত্র তৈরির প্রতিষ্ঠানগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে নানাভাবে যুক্ত। যা হোক, মেলার প্রতিযোগিতা শিবিরে শিক্ষার্থীরা দারুণ ব্যস্ত। একটুও ফুসরত নেই। একেকজনের একেক কাজ। কেউ প্রোগ্রামিং করছে। কেউবা তৈরি করছে যন্ত্রের অবকাঠামো। কেউ বা যাচাই করে দেখছে যন্ত্র ঠিকঠাক কাজ করছে কি না। শেষ হলো চীনের জেনজিয়াং ইউনিভার্সিটি থেকে আসা দলটির প্রতিযোগিতা। তারা দারুণ উল্লসিত। এগিয়ে গিয়ে তাদের সঙ্গে কথা বললাম। তারা যন্ত্রটি তৈরির প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানাল।

তরুণদের এ দলটিকে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন জেনজিয়াং ইউনিভার্সটির কৃষি প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক জুনঝং ইয়ে। কথা হলো তার সঙ্গে। তিনি বললেন, ‘আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে সরকার ও বিভিন্ন কোম্পানির যোগাযোগটা খুব ভালো। আমি আসলে বলতে চাচ্ছি, আমরা শিক্ষার্থীদের এমনভাবে তৈরি করি, তারা যা শিখছে তা যেন শুধু পুঁথিগত বা মস্তিষ্কেই রেখে না দেয়, যেন তারা সেটা কাজে লাগাতে পারে। আমরা শুধু তাদের একটা পথ দেখিয়ে দিই। সেই পথে তাদের নিজেদেরই হাঁটতে হয়। কোম্পানিগুলোও আমাদের তরুণদের মেধাকে কাজে লাগাতে তৎপর। এ ক্ষেত্রে ফলাফলটা কিন্তু বেশ ভালো। যে গাছটা থেকে ফল আশা করবে তার ঠিকঠাক যত্ন নিতে হয়। না হলে, ভালো ফল দেওয়া গাছটাও নষ্ট হয়ে যায়। আমরা সবাই মিলে সে রকম একটি পরিবেশ তৈরির চেষ্টা করেছি মাত্র।’

চ্যানেল আইয়ে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের যন্ত্র তৈরিতে অনুপ্রাণিত করতে আয়োজন করেছিলাম এসো রোবট বানাই প্রতিযোগিতার। তখন লক্ষ্য করেছি, প্রটোটাইপ তৈরি করার মতো সুযোগ-সুবিধাই আমাদের নেই।

দক্ষিণ কোরিয়ার গ্যাংনামেও এমন একটি প্রযুক্তি মেলায় উপস্থিত থেকে সে দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম দেখার সুযোগ হয়েছিল। সেখানে বাংলাদেশি শিক্ষার্থী শফিউলের স্মার্ট অ্যারেটার তৈরির কার্যক্রমও তুলে ধরেছিলাম।

কৃষিযন্ত্র তৈরিতে চীনের যে দুরন্ত অগ্রগতি তার পেছনে রয়েছে তরুণ শিক্ষার্থীদের যন্ত্র তৈরির অনুকূল পরিবেশ। আর এ পরিবেশ ও সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা চীন সরকার গুরুত্বসহকারে করে দিয়েছে। এ কথা আমাকে বলেছিলেন চীনের হাইব্রিড ধানের জনক ইয়ং লং পিং। তিনি বলেছিলেন, ‘পলিসি হচ্ছে সবচেয়ে বড় বিষয়। সরকার যদি নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত নেয় এবং সায়েন্স ও টেকনোলজির ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়, তবে অনেক কিছুই করা সম্ভব। বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রা কখনোই থামবে না। বিশেষ করে বায়োটেকনোলজির দুর্দান্ত অগ্রগতি লক্ষ্য করার মতো। চীন সরকার নীতিগতভাবেই কৃষকের পাশে আছে। তারা কৃষককে সব ধরনের সহযোগিতা দিয়ে কৃষিকে আধুনিক ও লাভজনক একটি খাতে পরিণত করছে।’

একটি জাতিকে টেকসই উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিতে নিজেদের ভাবনার সঙ্গে তরুণদের ভাবনার মেলসূত্র গাঁথতে হয়। চীনসহ উন্নত দেশগুলো তা দারুণভাবে করছে। যার প্রতিফলন প্রতিবছর আমরা দেখতে পাই বিভিন্ন দেশের তৈরি আধুনিক যন্ত্র ও প্রযুক্তির মাধ্যমে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে চলেছে পৃথিবী। সেই সঙ্গে আধুনিক থেকে আধুনিকতর হচ্ছে বিশ্বের কৃষি ব্যবস্থাপনা ও উৎপাদন কৌশল। খাদ্য নিরাপত্তার প্রশ্নে প্রতিটি রাষ্ট্রই উদ্যোগী হচ্ছে স্মার্ট কৃষির বিকাশে। পরিবর্তিত কৃষি প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কৃষি কৌশল নিয়ে গবেষণা ও যান্ত্রিক উৎকর্ষে খুব দ্রুতই এগিয়ে যাচ্ছে চীনের মতো দেশগুলো। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার ও ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে কম লোকের অংশগ্রহণে স্বল্প সময়ে বেশি উৎপাদন নিশ্চিত করছে। এ ক্ষেত্রে আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন পিছিয়ে রয়েছে, তাদের ভিতর সমন্বয়ও তেমন লক্ষ্য করা যায় না। আগামীর পৃথিবীর প্রতিনিধিত্বশীল রাষ্ট্র হতে হলে এ বিষয়গুলোর প্রতি আমাদের সবার যত্নশীল হওয়া দরকার।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব  

[email protected]

সর্বশেষ খবর