বুধবার, ৬ ডিসেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

নিরাপদ খাদ্যের অধিকার

প্রিন্সিপাল এম এইচ খান মঞ্জু

নিরাপদ খাদ্যের অধিকার

দেশে ভেজাল ও দূষণযুক্ত খাবারের বিরুদ্ধে নানারকম কর্মকাণ্ড অব্যাহত থাকা সত্ত্বেও সারা দেশে ভেজালের মহোৎসবের বিষয়টি উদ্বেগজনক। অপ্রিয় হলেও সত্য, দেশের প্রায় প্রতিটি খাদ্যসামগ্রীই ভেজালমিশ্রিত। ভেজাল খাদ্যের কারণে প্রতি বছর দেশে বিপুলসংখ্যক মানুষ ক্যান্সারসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।

প্রচলিত শিশুখাদ্যও ভেজালমুক্ত নয়; এমনকি জীবনরক্ষাকারী ওষুধও ভেজালমুক্ত রাখা যাচ্ছে না। ভেজাল ও মানহীন এসব পণ্য কিনে ভোক্তারা প্রতারিত হচ্ছেন; সেই সঙ্গে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। স্বাস্থ্যসচেতন অনেকে ফলমূল কেনাই বন্ধ রেখেছেন।

কৃত্রিম উপায়ে পাকাতে গিয়ে এবং ফল দ্রুত পচন থেকে রক্ষার লক্ষ্যে নানারকম ব্যবস্থা নেওয়া হয়, যা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দেখা দিতে পারে। ভোক্তা অধিকার ও স্বার্থরক্ষায় বাজার তদারকির কর্মকাণ্ডে আরও গুরুত্ব দিতে হবে। আইনের সর্বোচ্চ প্রয়োগের মাধ্যমে ভেজাল ও প্রতারণার হার শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা জরুরি।

শিশুখাদ্যসহ ওষুধের মতো জরুরি পণ্যেও ভেজাল মেশানোর কাজে কিছু ব্যক্তি জড়িত। এমন কার্মকাণ্ড থেকেই অসাধু ব্যক্তিদের নৈতিক অধঃপতনের বিষয়টি স্পষ্ট। কাজেই অসাধু ব্যক্তি ও ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া না হলে দেশের মানুষের নিরাপদ খাদ্যপ্রাপ্তিতে অনিশ্চয়তা তৈরি হবে, যা বলাই বাহুল্য। মানুষের নিরাপদ খাদ্যপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে সরকার নানা ধরনের পদক্ষেপ নিলেও বাজারে ভেজাল ও মানহীন পণ্যের সরবরাহ কমছে না। বস্তুত উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের যেমন সচেতন ও দায়িত্বশীল হওয়া প্রয়োজন তেমনই ভোক্তাদেরও সচেতন ও দায়িত্বশীল হওয়া প্রয়োজন।

খাদ্যে নকল-ভেজাল বন্ধে সরকারি উদ্যোগ বা মোবাইল কোর্টের অভিযান যেমন অব্যাহত রাখতে হবে তেমনি এ জন্য গড়ে তুলতে হবে সামাজিক আন্দোলন। প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় খাদ্যে ভেজালের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে উঠলে এ আপদ থেকে সহজেই নিস্তার পাওয়া যাবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় উপাসনালয়গুলো এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে। মানুষের জীবন নিয়ে যারা ছিনিমিনি খেলছে তারা দেশ ও জাতির শত্রু। জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচিত এ আপদের বিরুদ্ধে সমন্বিত পদক্ষেপের বিকল্প নেই।

বিশ্ব সাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, প্রতি বছর বিশ্বের প্রায় ৬০ কোটি মানুষ ভেজাল ও দূষিত খাদ্য গ্রহণের কারণে অসুস্থ হয়। এর মধ্যে মারা যায় ৪ লাখ ৪২ হাজার মানুষ। এ ছাড়া দূষিত খাদ্য গ্রহণজনিত কারণে পাঁচ বছরের কম বয়সের আক্রান্ত হওয়া ৪৩ শতাংশ শিশুর মধ্যে মৃত্যুবরণ করে ১ লাখ ২৫ হাজার। পরিবেশ বাঁচাও অন্দোলনের (পবা) এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- শুধু ভেজাল খাদ্য গ্রহণের কারণে প্রতি বছর দেশে দুই লাখ লোক কিডনি রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।

দেশের শতকরা ৯৭ ভাগ মানুষ হৃদরোগের ঝুঁকিতে রয়েছে বলে এক সমীক্ষায় জানা গেছে। বর্তমানে প্রায় ২ কোটি মানুষ কিডনি রোগে আক্রান্ত এবং ২০ লক্ষাধিক মানুষ ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করছে। প্রধান এ তিনটি রোগ ছাড়াও আরও বেশ কিছু স্বাস্থ্য জটিল রোগে ভুগছে কোটি কোটি মানুষ। এসব স্বাস্থ্য সমস্যার মূলে রয়েছে পরিবেশগত দূষণ এবং খাদ্যে ভেজাল।

ভেজাল খাদ্যের কারণে জনস্বাস্থ্যের যে ক্ষতি হয় তা পুরো স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপর যেমন চাপ পড়ে তেমনি অসংখ্য পরিবার চিকিৎসা করাতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ছে। হোটেলগুলোতে এখন নানা ধরনের কেমিক্যালের পাশাপাশি মবিল ব্যবহারের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব ভেজাল ও মারাত্মক ক্ষতিকর খাদ্য প্রতিরোধে যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে জনস্বাস্থ্যের জন্য তা ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। ভেজালবিরোধী কার্যক্রম ও অভিযানের কথা গণমাধ্যমে ওঠে এলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা খুবই অপ্রতুল।

খাদ্য নিরাপত্তা ও জনস্বাস্থ্যের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত হওয়ায় খাদ্যের ভেজাল প্রতিরোধ রাষ্ট্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু।

জনস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাবারের কোনো বিকল্প নেই। নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্য যেমন শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, উল্টোদিকে অনিরাপদ খাদ্য হৃদরোগ, ক্যান্সার, কিডনি রোগ, বিকলাঙ্গসহ অনেক রোগের কারণ হয়। দুঃখজনক হলেও সত্যি, এসব রোগ বাংলাদেশে মহামারির আকার নিয়েছে। বলতে গেলে ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে এসব ঘাতক ব্যাধি।

নতুন করে আর বলার অপেক্ষা রাখে না খাদ্যে ভেজালই জনসংখ্যার বড় একটা অংশকে তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছে। বিশেষ করে, ট্রান্স ফ্যাটি অ্যাসিড (টিএফএ) যুক্ত বিষাক্ত খাবার।

কয়েক বছর আগে রাজধানীতে কয়েকজন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে পরিচালিত ভেজালবিরোধী অভিযান যথেষ্ট ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা করেছিল। ম্যাজিস্ট্রেটের সংখ্যা বাড়িয়ে ভেজাল ও দূষণবিরোধী অভিযান জোরদার ও অব্যাহত রাখা হলে ভেজাল ও দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব নয়।

নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, ভোক্তা অধিকার পরিষদসহ সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোকে এ বিষয়ে আরও সোচ্চার ভূমিকা নিয়ে মাঠে নামতে হবে। খাদ্যে ভেজালবিরোধী অভিযান সারা বছর বলবৎ রাখতে হবে। সরকারি সংস্থাগুলোর পাশাপাশি স্থানীয় প্রশাসন, বাজার কমিটিসহ জনসাধারণের সামাজিক সচেতনতা ও আন্দোলন গড়ে তোলার মাধ্যমে খাদ্যের ভেজাল প্রতিরোধ ও নিরাপদ খাদ্যের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ও প্রাক্তন প্রিন্সিপাল এম এইচ খান ডিগ্রি কলেজ, গোপালগঞ্জ

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর