বুধবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

তোমার দুহিতা একি গুরুভার বয়

ওয়াহিদা আক্তার

তোমার দুহিতা একি গুরুভার বয়

বহুল প্রতীক্ষিত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বায়োপিক ‘মুজিব : একটি জাতির রূপকার’ মুক্তি পেয়েছে। বাংলাদেশ-ভারত যৌথ প্রযোজনায় বায়োপিক নির্মাণে দক্ষ ও অভিজ্ঞ ওপার বাংলার প্রখ্যাত পরিচালক শ্যাম বেনেগাল ছবিটি নির্মাণ করেছেন। পরিচালক তার জহুরী চোখ দিয়ে পাত্র-পাত্রী নির্বাচন করেছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব চরিত্রে অভিনেতা আরেফিন শুভ ছাড়া অন্য আরও কেউ ভালো করতে পারত এ কথা কেউ বলতে পারবে না, এ আমি হলফ করে বলতে পারি। বলিষ্ঠ কণ্ঠ, দীর্ঘকায়, লম্বা হাতের চওড়া পাঞ্জা ছাড়া বঙ্গবন্ধু চরিত্র রূপায়ণ সম্ভব ছিল না। বঙ্গমাতাসহ প্রতিটি ঐতিহাসিক চরিত্রের বিপরীতে অভিনেতা-অভিনেত্রী নির্বাচন যথার্থ হয়েছে।

বাঙালি আবারও কেঁদেছে শেষ দৃশ্যের নৃশংসতম ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের চিত্রায়ণে। নতুন প্রজন্ম জেনেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার রূপকার মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা ও মহান নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের সঙ্গে কী হয়েছিল সেদিন। আমি ছবিটি দুবার দেখেছি। শেষ দৃশ্যের ভয়াবহতার কথা মনে থাকায় শুরু থেকেই বিমর্ষ চিত্তে ছবিটি আমার মতো সবাই দেখেছে। আবেগাপ্লুত মন নিয়ে ভেজা চোখে দর্শকরা বের হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর জীবন ও রাজনীতিভিত্তিক বায়োপিক নির্মাণ যে কত কঠিন তা আবারও সবাই অনুধাবন করেছে। ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টে অলৌকিকভাবে বেঁচে যাওয়া বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যাকে ও চিত্রপরিচালক শ্যাম বেনেগালসহ সব কলাকুশলীকে।

১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধুকন্যাদের জীবনের ওপর বয়ে যাওয়া ঝড়ের চিত্র আমরা কিছুটা পেয়েছি ‘ডটারস টেল’ এ দুই কন্যার জবানিতে, যা ছিল মহাসাগর তলদেশে হিমশৈলের অগ্রভাগ মাত্র। আমি বঙ্গবন্ধুকন্যার সঙ্গে কাজ করাকালীন বিভিন্ন সময় কৌতূহলে কিছু জানার জন্য প্রসঙ্গ উঠিয়ে চুপ থাকতাম। কিন্তু সব সময় দেখেছি বঙ্গবন্ধু কন্যাদ্বয় সযতনে কষ্টের বিষয়গুলো এড়িয়ে যেতেন। তবে বিভিন্ন সময় আনন্দময় স্মৃতিচারণায় তাঁদের চোখে-মুখে উজ্জ্বলতার দ্যুতি ছড়িয়ে কথা বলতে দেখেছি। এতে মনে হয়েছে যে তাঁদের আনন্দের স্মৃতিময় সময়টা তাঁরা ১৯৭৫ সালের জুলাই মাসে আটকে রেখেছেন। এ মাসেই পরিবারটি সব সদস্য মিলে বোধহয় শেষবারের মতো আনন্দ করেছিল।

সম্প্রতি দুটি বই পড়েছি। একটি ড. শফিক সিদ্দিকের লেখা ‘দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায়’, অপরটি ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া রচিত ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ’। এ বই দুটি প্রায় দুষ্প্রাপ্য। সেখানে গুরুত্বপূর্ণ অনেক ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়। আমার মনে দাগ কেটেছে এমন দু-একটি ঘটনা আজ আমি এ লেখায় উল্লেখ করব। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর পেশাদার ডিপ্লোম্যাট হুমায়ুন রশিদ চৌধুরীর ভাবনা ছিল ভারত ছাড়া অন্য কোনো দেশে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যাকে নিরাপদে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব নয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ব্যতীত কাউকে বিশ্বাস করার মতো পরিবেশ ছিল না। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয়ে থাকাকালীন বঙ্গবন্ধুকন্যাদের একমাত্র চিন্তা ছিল বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার কীভাবে করা যায়। বঙ্গবন্ধুকন্যাদের ভারতের দিল্লিতে ও লন্ডনে অবস্থানকালীন সময়টা নিদারুণ অর্থকষ্টের মধ্যে কেটেছিল। এর মধ্যেই জীবন বহমান, তাই পারিবারিকভাবে নির্বাচিত ড. শফিক সিদ্দিকের সঙ্গে শেখ রেহানার বিবাহ সংসার, সন্তান লালন-পালনের পাশাপাশি দুই বোনের জীবনের একমাত্র ব্রত ছিল বাবার হত্যার বিচার করা। এ বিষয়ে তাদের যোগ্য সারথি ছিলেন ড. ওয়াজেদ মিয়া ও ড. শফিক সিদ্দিক। ওই কঠিন দুঃসময়ের চিত্র তাঁরা দিনক্ষণসহ পুস্তক আকারে প্রকাশ করেছেন। লিখেছেন দুই বোনের দুঃসহ যন্ত্রণার কথা।

১৯৭৯ সালের শেষের দিকে ঢাকা ইউনিভার্সিটির প্রাক্তন উপাচার্য প্রফেসর আবদুল মতিন চৌধুরী লন্ডনে এলে শেখ রেহানা স্বামীসহ তাঁর খোকা চাচাকে সঙ্গে নিয়ে দেখা করেন, মতিন স্যার ১৯৭৮ সালে ঢাকায় বঙ্গবন্ধু পরিষদ গঠনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী দেশের প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ, শিল্পী, সাহিত্যিক ও গুণীজনদের এক মঞ্চে নিয়ে আসেন। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর এ বলিষ্ঠ পদক্ষেপ তখন দেশে-বিদেশে অভিনন্দিত হয়েছিল। মতিন স্যার সম্পাদিত বঙ্গবন্ধু পরিষদ কর্তৃক প্রকাশিত বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা সমগ্র ‘বাংলাদেশের সমাজ বিপ্লবে বঙ্গবন্ধুর দর্শন’ তিনি শেখ রেহানাকে উপহার দেন। এ সাক্ষাৎ শেষে ফেরার পথে লন্ডনে বঙ্গবন্ধু পরিষদ শাখা গঠন করলে কেমন হয় ভাবনার পরিপ্রেক্ষিতে ইউরোপে বঙ্গবন্ধু পরিষদ গঠন করার উদ্যোগ গ্রহণ করা যায়। বঙ্গবন্ধুর অনুসারীদের এক মঞ্চে আনার কাজটি তখন থেকেই শুরু হয়।

জাতীয় চার নেতার অন্যতম মরহুম সৈয়দ নজরুল ইসলামের ছেলে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম আইডিয়াটি সমর্থন করলেন। তিনি তখন লন্ডনে বাকশালের জয়েন্ট সেক্রেটারি। সেই থেকে ইউরোপে বাকশাল ও মূল ধারার আওয়ামী লীগ একত্র হতে শুরু করে। মতিন স্যারের লন্ডনে উপস্থিতিটাই মূলত তাঁদের বঙ্গবন্ধু পরিষদ গঠনে উৎসাহিত করেছিল। যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ ও বাকশালকে এক মঞ্চে আনতে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, গাউস খান, সুলতান শরীফসহ (সবার নাম উল্লেখ করতে না পারায় দুঃখিত) সবাই আন্তরিক সহযোগিতা দেন। অবশেষে ১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭৯ সালে লন্ডনের কনওয়ে হলে মিসেস রাজিয়া মতিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সর্ব ইউরোপীয় বঙ্গবন্ধু পরিষদের প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়। গাফ্ফার চৌধুরী সম্পাদিত ‘বাংলার ডাক’ পত্রিকায় ফলাও করে খবরটি ‘শুভ সূচনা’ নামে একটি সম্পাদকীয়তে প্রকাশিত হয়। নেপথ্যে থাকা শেখ রেহানা সভায় উপস্থিত না হয়ে প্রমাণ করলেন নেপথ্যে থাকাই তাঁর পছন্দ। ১৯৮০ সালের ২০ জানুয়ারি কনওয়ে হলে বঙ্গবন্ধু পরিষদের প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। পৃষ্ঠপোষক পদে নির্বাচিত হলেন ব্রিটেনে হাউস অব লর্ডসের অন্যতম সদস্য লর্ড ব্রকওয়ে এবং অপর পৃষ্ঠপোষক হলেন শেখ হাসিনা। সভাপতি পদে স্যার টমাস উইলিয়ামসের নাম প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। এ নামটি প্রস্তাবের পেছনে শেখ রেহানা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুর পক্ষে আইনি লড়াই করেছিলেন স্মরণ করে নামটি মনে করিয়ে দেন। স্যার টমাস উইলিয়ামসের সম্মতি আনার জন্য অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে দেখা হলে উনি আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বলেন, তিনি নিজেও বঙ্গবন্ধুর অনুরাগী এবং ইউরোপীয় বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতি হওয়ার প্রস্তাব উনি সানন্দে গ্রহণ করেন। এ খবরে দেশে-বিদেশে বঙ্গবন্ধু অনুসারীরা সবাই ভীষণ আনন্দিত হন। ঠিক হয় প্রাথমিক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ১৭ মার্চ, মৃত্যুদিবস ১৫ আগস্ট ও জেলহত্যা দিবস ৩ নভেম্বর, তা ছাড়া স্বাধীনতা দিবস ২৬ মার্চ, বিজয় দিবস ১৬ ডিসেম্বর, ভাষাশহীদ দিবস ২১ ফেব্রুয়ারি জাতীয় দিবসগুলো যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করবে। ১৯৭৯ সালেই সুইডেন বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতি আ. রাজ্জাকের সভাপতিত্বে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রকাশ্য বিচার চেয়ে বক্তব্য দেন শেখ রেহানা।

১৭ মার্চ ১৯৮০ সাল সন্ধ্যা ৬টার সময় হাউস অব কমন্সের কমিটি রুমে স্যার টমাস উইলিয়ামসের সভাপতিত্বে বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আলোচনা সভা হয়। শত শত নেতা-কর্মীসহ কয়েকজন ব্রিটিশ এমপির উপস্থিতিতে সভাপতির সুন্দর বক্তব্যে সবাই অনুপ্রাণিত বোধ করেন। তিনি বলেন, “শেখ মুজিবের সঙ্গে আমার যখন প্রথম দেখা হয় তখন তিনি আমাকে বলেছিলেন যে, তাঁর আরাধ্য কাজ অসমাপ্ত রেখে তিনি মারা যাবেন এ কথা তিনি বিশ্বাস করতেন না। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে এবং যতদিন বাংলাদেশ বিশ্বের ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকবে, ততদিন তাঁর মৃত্যু নেই। তাঁর দৈহিক মৃত্যু তাঁর নিজ পরিবারের জন্য ছিল বেদনাদায়ক। তাঁর বন্ধুদের জন্য ছিল দুঃখজনক; কিন্তু তার চেয়ে বেশি বেদনার ও দুঃখের ছিল বাংলাদেশের জন্য। যে বাংলাদেশ তাঁর মৃত্যুতে গভীর দুঃখ-দুর্দশায় নিমজ্জিত হয়েছিল। কিন্তু দুঃখ-দুর্দশা হলো একটি জাতির জাগরণের অংশ। এ কথা বঙ্গবন্ধুর বেলায় সত্য যে, তিনি যে আন্দোলন শুরু করেছিলেন সে আন্দোলনের বীজ শহীদের রক্ত এবং আত্মত্যাগ দিয়ে সূচিত হয়েছিল। আমি মনে করি বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু নেই, কেননা আজকের এ দুঃখ-দুর্দশার মধ্যেও বাংলাদেশ আবার যখন জেগে উঠবে, জাতিসত্তার পূর্ণতা পাবে, তখন তাঁর আত্মা আমাদের মাঝে ফিরে এসে বলবে, ‘তোমরা যদি আমার স্মৃতিচিহ্ন চাও তবে তোমাদের চারিদিকে তাকাও’।’’

বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ জাগরণে একাত্মতা প্রকাশ করেন প্রাক্তন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ, লিবারেল পার্টির চিফ হুইপ এলেন বিথ, লিবারেল পার্টির প্রাক্তন নেতা জো গ্রিমন্ড এবং বাংলাদেশে প্রতিনিধিত্বকারী দলের অন্যতম নেতা জন হান্ট। আজকে যারা শেখ হাসিনার চেয়ারের পাশে মাটিতে বসে কথা বলা ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকের ছবি দেখেছেন তারা মনে করে দেখেন বঙ্গবন্ধুর গাড়ির দরজা খুলে দিয়েছিলেন তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ। পাকিস্তানের কারাগার থেকে বের হয়ে তিনি যখন লন্ডনে ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে আসেন, তখন দৌড়ে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর গাড়ির দরজা নিজে খুলে দেন। ইংল্যান্ড পার্লামেন্টে এ ব্যাপারে তাদের প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাব আনা হলে তিনি জবাবে বলেছিলেন, শেখ মুজিব কেবল একটি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান নন, তিনি নিজে তাঁর জাতিকে স্বাধীন করার স্বপ্ন দেখিয়েছেন, সারা জাতিকে স্বপ্নে উদ্বুদ্ধ করেছেন এবং নেতৃত্ব দিয়ে সে জাতিকে স্বাধীন করে দিয়েছেন। পৃথিবীর আর কোনো বিপ্লবী নেতা নিজের এক জীবনে এ তিনটি কাজ করে যেতে পারেননি। তাই শেখ মুজিবকে এ সম্মান দেখিয়ে ইংরেজ জাতিকে তিনি সম্মানিত করেছেন, এই ছিল বহির্বিশ্বে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে মূল্যায়ন।

বিশ্বনেতাদের সঙ্গে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও সম্মানের যে সম্পর্ক বঙ্গবন্ধু গড়েছিলেন, আজ শেখ হাসিনা সেই সম্পর্ক আরও মর্যাদার ও বহু পরিধিতে বহুগুণে বৃদ্ধি করেছেন। সমস্যা হলো আমরা কিছু বাঙালি নিজেদের টেনে নিচে নামাতে ব্যস্ত আছি, বিশ্বে শেখ হাসিনার বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বিশ্ববিখ্যাত ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে স্থান পান শেখ হাসিনা। বাংলাদেশ আজ উন্নত বিশ্বের কাতারে দাঁড়ানোর অবকাঠামোগত সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে।

আজকের নতুন প্রজন্ম শেখ হাসিনার দীর্ঘ ২১ বছরের সংগ্রামের ইতিহাস হয়তো জানে না। ১৯৮০ সালের এপ্রিল মাসে শেখ হাসিনা লন্ডন থেকে দিল্লি আসেন। দীর্ঘ সাড়ে ছয় মাস লন্ডনে অবস্থান করেন। উনি লন্ডনে এসেছিলেন সন্তানসম্ভবা বোন শেখ রেহানার পাশে থাকার জন্য। পাশাপাশি উদ্দেশ্য ছিল বঙ্গবন্ধুর নেতা-কর্মীদের সংগঠিত করা এবং বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের জন্য বিশ্ব জনমত গড়ে তোলা। বঙ্গবন্ধুর পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ১৯৮০ সালের ১৬ আগস্ট লন্ডনস্থ ইয়র্ক হলে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বক্তৃতা করেন। ইয়র্ক হলটির ধারণক্ষমতা হাজারের ওপর, যাতে তিল ধারণের জায়গা ছিল না। ১৯৭৫-এর পর এটাই শেখ হাসিনার প্রথম মিটিং। এর আগে ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকীতে বক্তাদের বক্তব্য সম্পাদন করে ও ব্রিটিশ নেতৃবৃন্দের বাণী সংগ্রহ করে ‘এ ট্রিবিউট টু শেখ মুজিব’ নামে গ্রন্থটি প্রকাশ করার উদ্যোগ নেন আবদুল মতিন সাহেব, সেদিন যা বিলি করা হয়।

সেদিন শেখ হাসিনা বাংলাদেশের সামরিক সরকারের অগণতান্ত্রিক কার্যকলাপ, ইতিহাস বিকৃতি, রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি সুপরিকল্পিতভাবে বিনষ্ট করা এবং স্বাধীনতাবিরোধীদের রাজনৈতিক পুনর্বাসনের বিষয়ে বক্তব্য রাখলেন। শেখ হাসিনা ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বরের হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিতে গিয়ে আবেগ আপ্লুত কণ্ঠে বলেন, “আমি বাংলার জনসাধারণের কাছে, বিশ্ব মানবতার কাছে বিচার চাই- কেন আমরা মা-বাবার স্নেহবঞ্চিত, কেন আজ আমি ভাইহারা, আমি আপনাদের কাছে বিচার চাই, বিচার চাই বিশ্ববাসীর কাছে, এত খুনের বিচার হয়, তবে এ হত্যাকাণ্ডের বিচার কেন হচ্ছে না, হত্যাকারীরা প্রকাশ্য দিবালোকে দেশে-বিদেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এ হত্যাকারীরা কেবল বাংলাদেশের জনগণের জন্য হুমকিস্বরূপ তা নয়, সমগ্র বিশ্বের গণতন্ত্রকামী দেশপ্রেমিকদের জন্যও হুমকিস্বরূপ। এ সভায় তিনি স্যার টমাস উইলিয়ামসকে ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বরের হত্যাকাণ্ড তদন্তের জন্য অনুরোধ জানান। পরবর্তীতে ১৯৮০ সালের ১৩-১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে শেখ হাসিনাকে সভাপতি নির্বাচন করা হয়। এর পরের ইতিহাস সবারই জানা। আজ বাংলাদেশ বিশ্বে মর্যাদার সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছে। যে কোনো সফলতার স্বীকৃতিতে বঙ্গবন্ধুকন্যা অশ্রুচাপা চোখে বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে আফসোস করেন ‘আব্বা যদি একটু দেখে যেতে পারতেন’!” তাঁরা পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নয়, বিচার চেয়েছেন নিয়মতান্ত্রিক বিচারিক প্রক্রিয়ায়। শোককে শক্তিতে রূপান্তর করে বাংলার যে দুঃখী মানুষ শেখ মুজিবকে ভালোবেসে সমর্থন দিয়েছেন, যারা ছিল বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির প্রেরণা তাদের ভাগ্য পরিবর্তনে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা।

ফিরে আসি আগের প্রসঙ্গে- ‘শেখ মুজিব : একটি জাতির রূপকার’ বায়োপিক দেখে সব দর্শকের একটিই মন্তব্য ছিল- শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা এ ছবির শেষ দৃশ্য কীভাবে সহ্য করলেন! এ ভাবনা আমার মনেও এসেছে। এর চেয়ে বেশি নিষ্ঠুর ঘটনা মনে হয়েছে আমার যে, শেখ হাসিনাকে তাঁর বাবার গুলিবিদ্ধ ছবি ১০ হাজার পাউন্ড দিয়ে কিনতে হয়েছিল। ঘটনাটি এমন যে, ১৯৮২ সালের নভেম্বর মাসের শেষ দিকে ‘সানডে টাইমস’ পত্রিকার সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাস ড. সিদ্দিককে ফোন করে দেখা করতে চান। অ্যান্থনি মাসকারেনহাস মুক্তিযুদ্ধের সময় সানডে টাইমস পত্রিকায় বাংলাদেশের গণহত্যা এবং পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের ওপর বেশ কটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে লন্ডনে বাঙালি মহল ও বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষের কাছে বিশেষ পরিচিতি পেয়েছিলেন। তিনি বঙ্গবন্ধু সরকার কর্তৃক পুরস্কৃত হয়েছিলেন জানা যায়। নির্দিষ্ট দিনে তাঁরা একটি রেস্টুরেন্টে মিলিত হন। উনি জানালেন, ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের পরপর বঙ্গবন্ধুর মৃতদেহের দুটি ফটো উনার কাছে আছে। এ ফটোগুলো তিনি খুনি ফারুক-রশীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছেন এবং এও জানালেন যে, ফারুক-রশীদ বঙ্গবন্ধু হত্যার পরপরই যখন লন্ডনে এসে টেলিভিশনে ইন্টারভিউ দিয়ে সদম্ভে ঘোষণা করেছিল তারা বঙ্গবন্ধু হত্যার মূল নায়ক, সেই সময় তিনি এ ছবি দুটি তাদের কাছ থেকে সংগ্রহ করেন। এরপর তার আর্থিক অনটনের কথা বলে উনি ১০ হাজার পাউন্ড পেলে এ ছবি দুটো দিয়ে দিতে পারেন বলে জানান। এ আর্থিক লেনদেনের বিষয়ে তিনি শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলতে চান। ড. সিদ্দিক বাসায় ফিরে শেখ হাসিনার কাছে সব খুলে বললেন। তাঁরা দুজনে ঠিক করলেন শেখ রেহানাকে এ বিষয়ে কিছুই জানানো হবে না। কারণ এ মর্মান্তিক দৃশ্য শেখ রেহানা সহ্য করতে পারবেন না। নির্দিষ্ট দিনে অ্যান্থনি মাসকারেনহাস একটি বড় খাম নিয়ে শেখ রেহানার বাসায় উপস্থিত হলেন। অ্যান্থনি মাসকারেনহাস কিছুক্ষণ কথা বলার পরই খামটি খুলে বঙ্গবন্ধু মৃত অবস্থায় সিঁড়ির ওপর পড়ে আছেন এরকম দুটো দৃশ্যের ফটো দেখান। পরনে তাঁর পাঞ্জাবি ও লুঙ্গি, পাশেই ধূমপানের জন্য ব্যবহৃত পাইপটি পড়ে আছে। সাদা পাঞ্জাবির অনেকটাজুড়ে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ লেগে আছে। বঙ্গবন্ধু চক্ষুমুদ্রিত অবস্থায় চিরনিদ্রায় শায়িত। এ ছবি দুটো দেখার সঙ্গে সঙ্গে শেখ হাসিনার চেহারা আমূল পরিবর্তন হয়ে যায়। ছবি দুটো খামে করে উনি দোতলায় উনার বেডরুমে চলে যান। অ্যান্থনি মাসকারেনহাস বললেন, ‘নিশ্চয়ই তিনি বাবার এই ছবি দেখে খুব বেশি আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েছেন। ড. সিদ্দিক উনাকে বসিয়ে রেখে ওপরে গিয়ে দেখলেন, ওই ছবির দিকে তাকিয়ে শেখ হাসিনা অঝোর ধারায় কেঁদে চলেছেন। শেখ হাসিনা একটু পরে খামটি নিয়ে নিচে এসে বসলেন, অ্যান্থনি মাসকারেনহাসকে বললেন, ‘আপনি বোধ হয় জানেন না ১০ হাজার পাউন্ড দেওয়ার সংগতি আমার নাই’। লন্ডন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা মিলেও এত টাকা জোগাড় করতে পারবে না। কিছু টাকা কমানোর অনুরোধ করেন। অ্যান্থনি মাসকারেনহাস কিছুটা কমাতে রাজি হলেন এবং প্রয়োজনে টাকাটা কিস্তিতে পেতে রাজি হলেন। অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের উপস্থিতিতেই এ ফটো ক্রয়ের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহের জন্য যুক্তরাজ্যের আওয়ামী লীগকে দায়িত্ব দিলেন শেখ হাসিনা।

কবি নির্মলেন্দু গুণের কবিতা ‘সেই রাত্রির কল্পকাহিনী’র দুটি চরণ দিয়ে শেষ করছি আজকের লেখা :

‘তোমার পা একবারও টলে উঠলো না, চোখ কাঁপলো না।

তোমার বুক প্রসারিত হলো অভ্যুত্থানের গুলির অপচয়’

বন্ধ করতে, কেননা তুমি তো জানো, এক-একটি গুলির মূল্য

একজন কৃষকের এক বেলার অন্নের চেয়ে বেশি’।

লেখক : সচিব, কৃষি মন্ত্রণালয়

সর্বশেষ খবর