বৃহস্পতিবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

অবিশ্বাস্য মেডিকেল ক্রাইম

তসলিমা নাসরিন

অবিশ্বাস্য মেডিকেল ক্রাইম

আমি ভারতীয় ডাক্তারদের এমনই বিশ্বাস করি যে বাংলাদেশের আত্মীয়স্বজন চেনা পরিচিত সবাইকে বলি অসুখ-বিসুখে ভারতে গিয়ে চিকিৎসা করতে। বাংলাদেশের বাইরে যারা আছে, তাদেরও বলি তাদের হাসপাতালে ভারতের ডাক্তার যদি পাওয়া যায়, তাকে দেখাতে। আমি নিজেও আমেরিকার হাসপাতালগুলোয় ডাক্তার দেখাতে গেলে ভারতীয় ডাক্তার আছে কি না আগে দেখি। থাকলে সাদা আমেরিকান বাদ দিয়ে ভারতীয় দেখাই। কেন আমি ভারতীয় ডাক্তার খুঁজি বিশ্বময়? এর কারণ কি আমরা একই ইতিহাস বহন করি বলে? একই উপমহাদেশের মানুষ বলে আত্মীয়তা অনুভব করি? সে তো কিছুটা বটেই, তবে আসল কারণ হলো, আমার গভীর বিশ্বাস ভারতীয় ডাক্তাররা ডাক্তার হিসেবে ভালো। তারা কঠিন প্রতিযোগিতায় জিতে চিকিৎসা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায়, কঠিন প্রতিযোগিতায় জিতে ডাক্তারি পাস করে। সুতরাং এরা ভালো না হয়ে যায় না। এই বিশ্বাসটা আমার গত বছরের শুরুর দিকেও ছিল। এরপর চুরমার হয়ে যায়।

কিছুদিন আগে উত্তর প্রদেশের এক সরকারি হাসপাতালের প্রখ্যাত হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ সমীর শরাফকে গ্রেফতার করা হয়েছে কারণ তিনি ৬০০ রোগীর শরীরে নকল এবং খারাপ পেসমেকার বসিয়েছেন। যাদের দরকার ছিল না পেসমেকারের, তাদের শরীরও কেটে ছিঁড়ে পেসমেকার বসিয়েছেন। বসিয়েছেন স্রেফ টাকার জন্য। এর মধ্যে দুশো থেকে আড়াইশো জন হয় মারা গেছে, নয়তো গুরুতর শারীরিক সমস্যায় ভুগছে। এ তো গেল সরকারি হাসপাতালের হিসাব। ডাক্তার সমীর শরাফ প্রাইভেট হাসপাতালেও বসতেন। সেখানেও হয়তো নকল পেসমেকার লাগিয়েছেন। হাসপাতালের দেওয়া টার্গেট পূরণ করেছেন।

আরেকটি খবরে দেখলাম ভারতের ৪৪% অস্ত্রোপচার প্রতারণার অস্ত্রোপচার। সার্জারির দরকার না থাকলেও সার্জারি করা হয়। ভারতে ৫৫% হার্টের সার্জারি, ৪৮% জরায়ুর সার্জারি, ৪৭% ক্যান্সার সার্জারি, ৪৮% হাঁটুর প্রতিস্থাপন সার্জারি, ৪৭% সিজারিয়ান সেকশান সম্পূর্ণই অদরকারে করা হয়। হাসপাতালের করপোরেটাইজেশনই এই অদরকারি সার্জারিগুলো করাচ্ছে। হাসপাতালগুলো এখন যেন আর সেবার জন্য নয়, এখন আর মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য নয়। এখন যে কোনো ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের মতো, টাকা উপার্জনই যে প্রতিষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য। টাকা উপার্জন করা হয় মানুষের জীবনকে জিম্মি রেখে।

যত না ডাক্তার এবং নার্স প্রাইভেট হাসপাতালগুলোয় আছে, আজকাল তারও চেয়ে বেশি আছে হাসপাতাল-ব্যবসায় মুনাফা বাড়ানোর লোক। সার্জনদের বিরাট অঙ্কের বেতন দেওয়া হয় এই শর্তে যে সার্জনরা প্রচুর সার্জারি করবেন এবং বিরাট অঙ্কের টাকা হাসপাতালকে পাইয়ে দেবেন। সেই সার্জারিগুলোকে যে দরকারি সার্জারি হতে হবে, এমন কোনো শর্ত দেওয়া হয় না। ডাক্তারদের সৎ এবং নীতিবান হওয়ার কোনো শর্ত থাকে না। উন্নত মানের চিকিৎসা এবং সেবার কোনো শর্ত থাকে না, যে শর্তটি থাকে, সেটি কেবলই আমি তোমাকে এক্স টাকা দেব, তুমি আমাকে ওয়াই টাকা দেবে। কোনো কোনো বড় সার্জনকে মাসে এক কোটি টাকাও বেতন দেওয়া হয় হাসপাতাল থেকে, অঢেল টাকার বিজনেস দিতে পারেন সেই সার্জন। এখানে বিজনেস অর্থ কিন্তু সার্জারি।

মেডিকেল কলেজ থেকে বের হওয়া নতুন ডাক্তারদের সৎ থাকার শপথ নিতে হয়। এই শপথকে বলে হিপোক্রেটিসের শপথ। প্রাচীন গ্রিসের চিকিৎসক হিপোক্রেটিসের নামে এই শপথ রচিত হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকে। শপথ মূলত এ-ই যে, ‘কোনো রোগীর কোনো ক্ষতি করব না, রোগীর উপকারের জন্য সকল ব্যবস্থার প্রয়োগ করব। অন্য চিকিৎসককে নিজের পরিবার ভাববো, তাদের নিঃস্বার্থভাবে চিকিৎসা এবং সেবা দেব।’ আমি যখন হোঁচট খেয়ে হাঁটুতে ব্যথা পেয়ে অ্যাপোলো ইন্দ্রপ্রস্থে যাই, আমি তো ডাক্তার, একই সঙ্গে সেদিন রোগীও ছিলাম। অ্যাপোলো ইন্দ্রপ্রস্থের ডাক্তার ইয়াতিন্দার খারবান্দা শুধু হাসপাতালের টার্গেট পূরণ করতে গিয়ে, শুধু টাকার জন্য, আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই তড়িঘড়ি আমার সুস্থ হিপ জয়েন্ট কেটে বাদ দিয়ে বাজে কোয়ালিটির ইমপ্লান্ট লাগিয়ে আমার সর্বনাশ করলেন। ডাক্তার হওয়ার সময় হিপোক্রেটিসের যে শপথ নিয়েছিলেন, বেমালুম ভুলে গেলেন।

ভারতীয় ডাক্তারদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা এত বেশি ছিল যে আমি কোনো দিন বিশ্বাস করিনি তারা কোনো অন্যায় করতে পারেন। তারা যে জেনেশুনে টাকার জন্য রোগীর ক্ষতি করতে পারেন, তা আমার জীবনে ভয়ংকর অভিজ্ঞতাটি না ঘটলে আমি হয়তো বিশ্বাস করতাম না। নিজে ডাক্তার বলে ডাক্তারদের পক্ষ নিয়েছি সব সময়। অনেক সময় খবর শুনেছি ভুল চিকিৎসা করেছে এই অভিযোগ এনে রোগীর লোকেরা ডাক্তারদের পেটাচ্ছে, ভেবেছি নিশ্চয়ই রোগীর লোকেরা ভুল করছে, চিকিৎসা শাস্ত্র সম্পর্কে তাদের জ্ঞান নেই, সুতরাং তারা আবেগের বশবর্তী হয়ে অজ্ঞানতাবশত ডাক্তারদের দোষী সাব্যস্ত করছে। ডাক্তাররা ইচ্ছে করে ভুল চিকিৎসা করবেন, এ আমার কল্পনার বাইরে ছিল। কোনো কোনো ডাক্তারের হয়তো দক্ষতা কম, তাদের কিছু ভুল হতেই পারে, ভুল করে মপ বা কাঁচি পেটের ভিতরে রেখেই পেট সেলাই করে দিতে পারেন। কিন্তু ইচ্ছে করে কোনো ডাক্তার এই ভুলটি নিশ্চয়ই করবে না। কারও কোনো সার্জারি দরকার না থাকলেও সার্জারি করবেন, এ আমি বিশ্বাস করিনি এতকাল। নিজের জীবনে এই চরম অন্যায়টি ঘটেছে বলেই আমি জানি সার্জারির দরকার না থাকলেও সার্জারি হয়। অ্যাপোলো ইন্দ্রপ্রস্থের মতো নামিদামি হাসপাতালেই হয়।

কেউ আমার পরিচয় না জানতে চাইলে আমি আগ বাড়িয়ে নিজের পরিচয় দিই না। সেই রাতেও আমি ডাক্তারকে পরিচয় দিইনি। সাধারণত ডাক্তাররা আমার নাম শুনলে আমাকে চেনেন, আমি ডাক্তার তা না জানলেও আমি যে লেখক তা জানেন। ভেবেছিলাম ইয়াতিন্দার খারবান্দা আমার নাম শুনে আমাকে চিনতে পেরেছেন, আমাকে তিনি সবচেয়ে বেস্ট ট্রিটমেন্ট দেবেন। কিন্তু তিনি যে চেনেননি আমাকে, তিনি যে আমাকে ফাঁদে ফেলার ফন্দি আঁটছেন, তা আমি কী করে বুঝব!

তিনি যখন বললেন আমার হিপ বোন ভেঙেছে, আমি তাকে বিশ্বাস করলাম। যদিও আমার হিপে কোনো ব্যথা বেদনা নেই, আমি বিশ্বাস করলাম। আমি অতি সরল সোজা সত্যি-বলা মানুষ, বললাম আমি কিন্তু একা, আমার কোনো আত্মীয় আমার সঙ্গে নেই। আমার শুধু এক বোন আছে, থাকে বিদেশে। ব্যস, হয়ে গেল। আমার অসহায়তাকে তিনি আমার সঙ্গে প্রতারণা করার জন্য সম্বল করলেন। আমি যে ভারতে বাস করি তিনি জানেন না, ভেবেছিলেন বাংলাদেশের গাঁও গেরাম থেকে কোনো অশিক্ষিত মেয়েমানুষ প্রচুর টাকা পয়সা জোগাড় করে অ্যাপোলোর মতো হাসপাতালে এসেছি। ধোঁকা দেওয়ার জন্য, সুস্থ হাড়গোড় কড়াত দিয়ে কেটে বাদ দিয়ে আমাকে পঙ্গু বানানোর জন্য আমি ছিলাম তাদের উপযুক্ত শিকার। সার্জন বুঝে গেলেন আমাকে ভয় দেখিয়ে তিনি তার কাজ হাসিল করে ফেলতে পারেন। আমার সঙ্গে একজন গিয়েছিল হাসপাতালে, সে ছিল নীরব দর্শক। ডাক্তারকে কোনো প্রশ্ন সে করেনি। খারবান্দা আরও বুঝে গেলেন, তিনি যা ইচ্ছে তাই করতে পারেন, নীরব দর্শক টুঁ শব্দ করবে না। আমাকে তিনি এক্সরে দেখালেন না, কোথায় কোনো হাড় ভেঙেছে বললেন না, দেখালেন না, সিটিস্ক্যান দেখালেন না। আমাকে ছুঁয়ে দেখলেন না, হিপ জয়েন্টে ফ্র্যাকচার হয়েছে কি না দেখার জন্য পা নেড়েচেড়ে দেখতে হয়, ওটিই করলেন না। শুধু বললেন আমার দুটো অপশন, হিপ রিপ্লেসমেন্ট এবং ইন্টারন্যাল ফিক্সেশান, স্ক্রু লাগিয়ে ভাঙা হাড় জোড়া দেবেন। আমি ফিক্সেশান বেছে নিলাম। রাত ১টায় হাসপাতালে রুম পেলাম। কিন্তু সকাল সাড়ে ৯টায় খারবান্দা হাজির। তিনি রূঢ় কণ্ঠে জানিয়ে দিলেন তিনি ফিক্সেশান করবেন না, তিনি শুধু হিপ রিপ্লেসমেন্ট করবেন। আমাকে তিনি ছুড়ে দিলেন মাঝ সমুদ্রে, আমি অতলে তলিয়ে যাচ্ছি, আর ভাবছি ভাঙা হিপ নিয়ে আমি সাঁতার কাটব কী করে!

তখন ভীষণ অসহায় অবস্থা। সারা দিনের না-খাওয়া, সারা রাতের না-ঘুমোনো, প্রচণ্ড জলপিপাসা, হতাশা, জলে ভাসা, আমি বোধ ঘাবড়ে গেলাম। চোখে অন্ধকার দেখলাম। বললাম আমি সেকেন্ড অপিনিয়ন চাই। তিনি বললেন, তিনি নিয়েছেন সেকেন্ড, থার্ড, ফোর্থ অপিনিয়ন, আমার নেবার দরকার নেই। ধমকে ধমকে বলতে লাগলেন হিপ রিপ্লেস না করলে আমার না কি টিস্যু ড্যামেজ হয়ে যাবে। সব যে মিথ্যে কথা ছিল, তখন বুঝিনি। খারবান্দার পাতা ফাঁদে পা দিলাম। কেউ জানলো না দেখলো না আমার সুস্থ হিপ কেটে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে। বসিয়ে দেওয়া হয়েছে খারাপ কোয়ালিটির সস্তা ইমপ্লান্ট। বেছে নেওয়ার জন্য আমাকে দেখানো হয়নি কোনো ইমপ্লান্ট। জীবন বদলে দেওয়া এক মেজর সার্জারি আধ ঘণ্টার সিদ্ধান্তে তিনি করে নিলেন, তার একক সিদ্ধান্তে। আমার বন্ধু-বান্ধব আর শুভাকাক্সক্ষীরা আমাকে দেখতে আসার অনেক আগেই। তাড়াহুড়ো করেছেন, পাখি আবার হাতের মুঠো থেকে উড়ে না যায়। খারবান্দা বলেছিলেন, আমার না কি অস্টিওপরোসিস, হাড়ের ক্ষয় রোগ, সে কারণে হিপের হাড় ভেঙেছে। ওঁকে আমি শতভাগ বিশ্বাস করেছিলাম। একবারও আমার মনে উদয় হয়নি যে অস্টিওপরোসিসের কোনো উপসর্গ আমার নেই। ভেবেছিলাম ডাক্তার যখন বলছেন নিশ্চয়ই তিনি সত্যি বলছেন। কিন্তু কী করে তিনি জানলেন আমার অস্টিওপরোসিস? অস্টিওপরোসিস তো দেখতে হয় বোন ডেন্সিটি টেস্ট করে। আমার সেই টেস্ট তিনি তো করেননি। সার্জারির আরও কয়েক সপ্তাহ পর মাহাজান ইমেজ সেন্টার থেকে বোন ডেন্সিটি টেস্ট করিয়ে দেখেছি আমার হাড়ে অস্টিওপরোসিসের চিহ্ন মাত্র নেই। আমার হাড়গোড় সব শক্ত পোক্ত। তিনি মিথ্যে বলেছিলেন। সার্জারির পরও অনর্গল মিথ্যে বলে গেছেন, আমার হাড় নাকি ‘খোকলা’ হয়ে গেছে। বলেছিলেন সার্জারির পরদিন আমি হেঁটে বাড়ি ফিরতে পারবো। আজ আট মাস হয়ে গেল, এখনও ভালো করে হাঁটতে পারি না। বলেছিলেন সমস্ত কাজ করতে পারবো, মিথ্যে কথা। দৈনন্দিন হাজারো কাজই হিপ রিপ্লেসমেন্ট হলে করা যায় না। বলেছিলেন ইমপ্লান্ট চিরকাল টিকবে, এও মিথ্যে কথা। আমাকে তিনি বলেননি ইমপ্লান্ট যে ধীরে ধীরে ক্ষয় হয়ে অকেজো হয়ে যাবে এক সময়। কেন বলেননি? আমি যদি সার্জারিতে রাজি না হই। ছলেবলে কৌশলে তিনি হিপ রিপ্লেসমেন্ট সার্জারি করিয়ে ছাড়লেন।

আমি ভেবেছিলাম আমার বোধহয় সত্যিই হাড় ভেঙেছিল, আমার বোধহয় সত্যিই ভালো চিকিৎসা হয়েছে। কিন্তু সার্জারির চার দিন পর আকস্মিকভাবে হাতে পেলাম এক্সরে রিপোর্ট, সিনিয়র রেডিওলজিস্ট ডাক্তার বলরাম সিং গিল এবং শ্রেয়া সিক্রির রিপোর্ট : কোনো ফ্র্যাকচার নেই। আমি তখন খারবান্দার চাতুরী সব বুঝতে পারি, কিন্তু ততক্ষণে আমার জীবনের সর্বনাশ তিনি করে ফেলেছেন। আমার শরীরের কাঠামোকেই তিনি ভেঙে দিয়েছেন, শুধু ৮ লাখ টাকার জন্য। আমার কাছ থেকে এক্সরে রিপোর্ট ছিনিয়ে নিতে হাসপাতালের ডিরেক্টর ২০ জন ডাক্তার আর ম্যানেজমেন্টের লোক নিয়ে আমার রুমে আসেন। না, আমি দিইনি সেই রিপোর্ট। আমার চেয়ে তো শতগুণ চালাক তারা। ডিসচার্জ নিয়ে চলে এসেছি, আর থাকিনি ওই হাসপাতালে। কিন্তু ওঁরা সব ফেব্রিকেট করে দিয়েছেন, জাল রিপোর্ট দিয়েছে। ডিসচার্জ সামারির ক থেকে চন্দ্রবিন্দু পর্যন্ত সবটাই মিথ্যে। রিপোর্টই শুধু ফেব্রিকেট করেনি, এক্সরেও ফেব্রিকেট করেছে। সে কারণেই এক্সরে প্লেটে আমার ভুল জন্মতারিখ লেখা। যে এক্সরে প্লেট আমাকে দেওয়া হয়েছে, সেটায় ইম্প্যাক্টেড ফ্র্যাকচার স্পষ্ট। এটাই যদি প্রথম এক্সরে হয়, কেন তাহলে এই এক্সরের রিপোর্টে রেডিওলজিস্ট লিখেছেন কোনো ফ্র্যাকচার নেই? আমি মামলা করলে যেন তারা ফেঁসে না যান, তার জন্য ব্যাকডেটে সমস্ত কাগজপত্রে মিথ্যে কথা লিখে দিয়েছেন, ডকুমেন্টস বদলে দিয়েছেন। কত বড় মেডিকেল ক্রাইম ঘটে গেল একটা নামকরা হাসপাতালে। আমার সুস্থ সুন্দর জীবনটাকে নষ্ট করে দিয়েছেন খারবান্দা, নিশ্চিতই আমার আয়ু অনেক কমিয়ে দিয়েছেন।

ধরা যাক আমার হিপের হাড় ভেঙেছে। যে ইম্প্যাক্টেড ফ্র্যাকচার এক্সরেতে দেখানোর ব্যবস্থা হয়েছে, সেটার চিকিৎসা কিন্তু কিছুতেই হিপ রিপ্লেসমেন্ট নয়। সেটার ট্রিটমেন্ট হলো, রেস্ট। রেস্টেই ওই হাড় জোড়া লেগে যায়। যদি এক-দু মাসে জোড়া না লাগে, তাহলে নটা স্ক্রু দিয়ে জোড়া লাগিয়ে দেওয়া হয়। ব্যস। আমি অ্যাপোলো ইন্দ্রপ্রস্থে অনেক বার গেছি ছোটখাটো জ্বর কাশি নিয়ে। আমি জানি সব ডাক্তার ওখানে খারবান্দার মতো ক্রিমিনাল নয়। তবে কিছু ডাক্তার তো মুখোশ পরাই ছিলেন। খারবান্দা যেমন ছিলেন। খারবান্দা যখন ক্ষেপে উঠেছেন আমার হিপ রিপ্লেসমেন্ট করার জন্য এবং আমাকে ভাববার সময় না দেওয়ার জন্য, তখন অ্যাপোলোরই এক বাঙালি ডাক্তার অলয় মুখার্জির শরণাপন্ন হলে তিনি খারবান্দার খাদে আরও আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলেন। এসবে শুনেছি পারসেন্টেজ জোটে। অলয় মুখার্জিরও নিশ্চয়ই জুটেছিল। বাঙালি হলেই যে আমার শুভাকাক্সক্ষী হয় না, তা যে আমার আরও কত যুগ যাবে বুঝতে!

আট মাস হয়ে গেছে, এখনও হাসপাতালের ওই ঘটনা আমার কাছে দুঃস্বপ্নের মতো। আমি আর আগের মতো সুস্থ স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারছি না। আমার ওয়ার্কআউট বন্ধ। আমার সুস্থতার ইতি ঘটে গেছে। যে কোনো সময় এই ইমপ্লান্ট ভেঙে যাবে, আমার আর হুইল চেয়ার ছাড়া গতি থাকবে না। তাছাড়া ওয়ার্কআউট বন্ধ থাকায় আমার ডায়বেটিস আর ব্লাড প্রেশারের কমপ্লিকেশান বাড়বে, আর আমার মৃত্যু হবে। জিহাদিরা গত তিরিশ বছরে যে কাজটা করতে পারেনি, আমাকে হত্যা করতে পারেনি, সেটা কোথাকার এক খারবান্দা ঘটিয়ে ফেললেন। জিহাদিরা এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় খারবান্দাকে নিয়ে উৎসব করে। তার গলায় মালা পরায়। তাদের চিরশত্রুকে খারবান্দাই একরকম কতল করতে পেরেছে। শারীরিক এবং মানসিকভাবে শক্ত সমর্থ আমিটার মৃত্যু ঘটে গেছে। ভারতের ডাক্তারদের ওপর যে আমার অগাধ আস্থা ছিল, সেটা নেই। হিপোক্রেটিসের শপথ মেনে চলেন ডাক্তাররা, রোগীর কোনো অনিষ্ট করেন না, রোগীকে মিথ্যে বলেন না, রোগীর সঙ্গে প্রতারণা করেন না, তাদের সর্বনাশ করেন না-এ আর আমি বিশ্বাস করি না। হাসপাতালের করপোরেটাইজেশান হয়ে যাওয়ার পর ডাক্তার আর ডাক্তার নয়, তারা রোগীদের রক্তচোষা জোঁক হয়ে গিয়েছে। নোবল প্রফেশনের কী কুৎসিত অধঃপতন! মানুষ মরে গেলেও আইসিইউতে ভেন্টিলেটরে রেখে দেওয়া হয় খরচটা বেশি দেখিয়ে বেশি টাকা আদায় করার জন্য। আমি যে বেঁচে ফিরেছি হাসপাতাল থেকে, এ-ই হয়তো বেশি।

আরেকটি খবর তো বলাই হয়নি। দিল্লির গ্রেটার কৈলাশ এলাকায় আছে আগরওয়াল মেডিকেল সেন্টার। এই সেন্টারে ফেইক ডাক্তারেরা বছরের পর বছর ডাক্তারি করছেন। একের পর এক রোগী মারছেন। লোক ঠকিয়ে এত টাকা রোজগার করেছেন ফেইক ডাক্তারেরা যে মার্সিডিজ আর বিএমডব্লু গাড়ি কিনেছেন নিজেদের জন্য, ক্লিনিকের আরও শাখা খোলার জন্য দিল্লির অভিজাত এলাকায় আরও জমিও কিনেছেন। এই ক্লিনিকে সার্জারি করতেন নীরাজ আগরওয়াল, সাধারণ একজন এম বি বি এস ডাক্তার, সার্জারিতে যার কোনো পড়াশোনাও নেই, অভিজ্ঞতাও নেই। অ্যাসিস্ট্যান্ট সার্জন হিসেবে কাজ করতেন ১২ ক্লাস অবধি পড়া দুজন লোক। কিছুদিন হলো ওই ক্লিনিক থেকে চারজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং ক্লিনিক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এরকম ফেইক ডাক্তারদের ক্লিনিক নাকি খোদ দিল্লি শহরেই আরও অনেক আছে। গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। এগুলোকে হরর কাহিনি বলবো নাকি ক্রাইম থ্রিলার বলবো, বুঝতে পারছি না।

সর্বশেষ খবরটি বলি, অ্যাপোলো ইন্দ্রপ্রস্থ নামের বিখ্যাত হাসপাতালটি কিডনি পাচারের সঙ্গে যুক্ত। খবরটি প্রকাশ করেছে যুক্তরাজ্যের টেলেগ্রাফ পত্রিকা। ভারতীয় মিডিয়া সাধারণত প্রাইভেট হাসপাতালগুলোর অপরাধ ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখে, কারণ এই হাসপাতালগুলো মোটা অঙ্কের টাকার বিজ্ঞাপন দেয় মিডিয়াকে। মিয়ানমারের গরিবদের কাছ থেকে সস্তায় কিডনি কিনে সেই কিডনি ভারতের ধনী লোকদের কাছে বিক্রি করছে দিল্লির অ্যাপোলো, অথচ কিডনি কেনাবেচা ভারতে এবং মিয়ানমারে- দুটো দেশেই নিষিদ্ধ। এই সেই অ্যাপোলো, যে অ্যাপোলো জেনেশুনে আমার জীবনের সর্বনাশ করেছে।

লেখক : নির্বাসিত লেখিকা

সর্বশেষ খবর