শুক্রবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

বুজুর্গ হওয়ার বড় শর্ত গুনাহমুক্ত জীবন

আল্লামা মাহ্‌মূদুল হাসান

বুজুর্গ হওয়ার বড় শর্ত গুনাহমুক্ত জীবন

মুহাজেরে মক্কী (রহ.) একজনের কাছে মুরিদ হয়েছিলেন। কিন্তু মুরিদ হওয়ার পরও তাঁর মনে শান্তি ছিল না। কীসের এক পিপাসায় যেন সর্বদা হয়রান থাকতেন। বর্তমানে অনেকে মুরিদ হয় শুধু চামচারী করার জন্য, হালুয়া খাওয়ার জন্য।  বস্তুত যারা এরকম মনোভাব নিয়ে মুরিদ হবে তাদের পরিণাম খুবই খারাপ। পীর-মুরিদের সম্পর্ক হলো আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক করার একটি মাধ্যম। এ মাধ্যম যদি হয় স্বার্থ হাসিলের উসিলা, তাহলে এর পরিণতি হবে খুবই দুঃখজনক।

মুহাজেরে মক্কী (রহ.) ঘোর পিপাসাগ্রস্ত ছিলেন। কিন্তু এ পিপাসা পানি দিয়ে নিবারণ করার পিপাসা নয়। যেমন শরীরের পিপাসা পানি ছাড়া মেটানো সম্ভব নয়। পানির পিপাসা শরবত দিয়ে মিটবে না, তা পানি দিয়েই নিবারণ করতে হয়। হজরত মক্কী (রহ.)-এর মাঝে যে পিপাসা বিরাজ করছিল তা ছিল আল্লাহ ও তাঁর রসুলের প্রেমের পিপাসা। এ পিপাসা সত্যিই বড় কষ্টের পিপাসা, যাদের মাঝে এ পিপাসা আসেনি তারা কী করে এর মর্ম বুঝবে?

মক্কী (রহ.) রাতদিন পিপাসায় ছটফট করতেন। এরই মধ্যে এক দিন রাতে স্বপ্নে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাক্ষাৎ হলো। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, কীসের যন্ত্রণায় তুমি এত পেরেশান? আমার কাছে খুলে বল। হজরত মক্কী (রহ.) তাঁর মনের আকুতি এভাবে ব্যক্ত করলেন, ইয়া রসুলুল্লাহ! আপনি আমার শরীরের আত্মা, আপনি ছাড়া আমার জীবন অচল, একটি মুহূর্তও আপনাকে ছাড়া বেঁচে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়! রসুল তাঁর এ আকুতি শুনে পাশে দাঁড়ানো একজন লোককে দেখিয়ে বললেন, তুমি যদি আমার ভালোবাসায় সিক্ত হতে চাও তাহলে এর ছোহবত গ্রহণ কর। ঘুমের সফর শেষ হলো, স্বপ্ন ভেঙে গেল। এখন তিনি আরও বেশি অস্থির। এটা কী দেখলাম? কোথায় পাব সেই শাইখকে? কোথাও তো এমন কোনো লোক নজরে আসছে না! তিনি স্বপ্নে দেখা লোকটির আকৃতি মানুষকে বলে দিলেন এবং সন্ধান চাইলেন। অস্থির হয়ে খুঁজতে শুরু করলেন। কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না, কেউ বলতেও পারছে না! তবুও হাজী সাহেব খুঁজে চলেছেন, চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। অনেক সন্ধানের পর এক লোক বলল, এমন তো কাউকে দেখিনি, শুনিনি। তবে লোহাড়ীতে এমন একজন লোক আছে, তুমি ওখানে চলে যাও।

বিবাহ করার পর হতে শুরু হলো অসহনীয় যন্ত্রণা

লোহাড়ীর সেই বুজুর্গ ছিলেন একজন কারি। শুধু কোরআন পড়তে পারতেন। তিনি শেষ বয়সে বিবাহ করেছিলেন। তার গ্রামে একজন মহিলা ছিল, তাকে কেউই বিবাহ করতে রাজি হতো না। কারণ তার চরিত্র ছিল মারাত্মক খারাপ। কথায় কথায় মানুষকে গালাগাল করত। কিন্তু আল্লাহর নির্দেশে লোহাড়ীর পীরসাহেব তাকে বিবাহ করলেন। বিবাহ করার পর হতে শুরু হলো অসহনীয় যন্ত্রণা। যখনই লোহাড়ী সাহেব ঘরে যেতেন সামান্য কোনো কারণেই তাঁকে শুনতে হতো অশোভনীয় ও অকথ্য গালি। কিন্তু তিনি ছিলেন ধৈর্যের পাহাড়, কিছু বলতেন না। সকাল-বিকাল গিয়ে বাজারসদাই দিয়ে আসতেন। ঘরে থাকতে পারতেন না। মাদরাসায় থাকতেন। তার মুরিদান ছিল হাজার হাজার। এক দিন এক মুরিদ লোহাড়ী সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে তাঁর বাড়িতে গেলে পীরসাহেবের স্ত্রী যথারীতি রাক্ষুস চেহারা নিয়ে বের হয়ে দেখল, পীরসাহেব নয়, অপরিচিত লোক। কর্কশ ভাষায় জিজ্ঞেস করল, কী চান এখানে? মুরিদ উত্তর দিল, আমার পীরসাহেবের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। এ কথা শোনার পর স্ত্রী বলল, এখানে কোনো পীর-টির থাকে না। ও আবার পীর নাকি? সে তো আস্ত একটা শয়তান। মহিলার এমন আচরণে মুরিদ অতিষ্ঠ হয়ে ফিরে এলো। রাস্তায় গিয়ে কাঁদতে শুরু করল আর মনে মনে বলল, এ মহিলা আমার সঙ্গে যে আচরণ করেছে, না জানি আমার পীরের সঙ্গে কেমন জল্লাদি আচরণ করে! লোকটি পীরসাহেবকে হন্যে হয়ে খুঁজছিল। একজন তার এ অবস্থা দেখে বলল, তোমার পীর অমুক জঙ্গলে আছেন, তুমি সেখানে গেলে তাকে পাবে। কথামতো লোকটি জঙ্গলে গিয়ে দেখে, পীরসাহেব জঙ্গলের বাঘের সরদার। একটি বড় বাঘের পিঠে সওয়ার হয়ে আছেন আর তার আশপাশে বহু বাঘ অবস্থান করছে। লোকটি ভয়ে ভয়ে পীরসাহেবের কাছে গিয়ে সমস্ত ঘটনা কেঁদে কেঁদে খুলে বলল। পীরসাহেব বললেন, ‘এক দিনের গালমন্দে তুমি কেঁদে দিলে? আমি আজ কয়েক বছর হলো দুবেলা করে গালমন্দ শুনি। তার এ পরিস্থিতির ওপর ধৈর্য ধারণ করার কারণেই আল্লাহপাক আমার জন্য বাঘকে অনুগত বানিয়ে দিয়েছেন।’

যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য দুঃখ-কষ্ট সহ্য করে, দুনিয়ার সমস্ত বস্তুকে আল্লাহ তার অধীন করে দেন।

অন্তরে এক নূর অনুভব করলেন

যাহোক ওই ব্যক্তির কথামতো মুহাজেরে মক্কী (রহ.) লোহাড়ীর দিকে যাত্রা শুরু করলেন। তিনি কেমন যেন অন্তরে এক নূর অনুভব করলেন। যতই অগ্রসর হচ্ছেন, ততই যেন নূর আরও বেশি দীপ্তিমান হতে লাগল। যাত্রার গতি আরও বহু গুণে বাড়িয়ে দিলেন। তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ না করা পর্যন্ত যেন দুনিয়ার সমস্ত শান্তি বিদায় নিয়েছে। যাত্রাপথে কোথাও বিশ্রাম নেননি। খাওয়া-দাওয়া আরও আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। প্রায় নিকটে পৌঁছে গেছেন। আর একমুহূর্ত সময় তিনি অতিবাহিত করতে পারছেন না, পাগলের মতো দৌড় দিলেন।

কারও কাছে জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজন হয়নি

অন্যদিকে লোহাড়ীতে নূর মুহাম্মদ জানজানবী (রহ.)-এরও কাশফ হয়ে যায়। তাঁরও কয়েকদিন ধরে ভালো লাগছে না। শুধু মক্তবের বারান্দা দিয়ে ঘোরাফেরা করেন, আর কী যেন খোঁজেন অস্থির হয়ে। হঠাৎ একসময়ে হাজী সাহেব উপস্থিত। নূর মুহাম্মদ জানজানবীকে দেখামাত্রই কী এক আকর্ষণ যে পেয়ে বসেছে! তিনি বেহুঁশ হয়ে পড়ে গেলেন। কারও কাছে জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজন হয়নি যে, নূর মুহাম্মদ জানজানবী কে? তিনি তো তাঁকে স্বপ্নে দেখেছেন। তাই এখন বাস্তব জগতে দেখামাত্রই স্বপ্নের চিত্র দুই চোখের সামনে ভেসে উঠল। হুঁশ এলে জানজানবী (রহ.) প্রথমে কথা বললেন, স্বপ্নের ওপর এত আস্থা কেন? কথা শ্রবণে তিনি আবার জ্ঞানহারা হলেন। স্বপ্নের ব্যাপার তিনি কী করে জানলেন? এত দিন কোন জগতে ছিলাম? এটা তো দেখি অন্য জগৎ। পুনরায় জ্ঞান ফিরে এলে দুজনের মাঝে আলোচনা হলো এবং বাইআত হলেন। এমন আরও অনেক ঘটনাই আছে যে, তিনি সমস্যায় পড়লে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই তাঁকে সমাধান দিতেন।

আমাদের অনেকের প্রশ্ন

আমাদের অনেকের প্রশ্ন যে, ‘কারি, হাফেজ, মুয়াজ্জিন কী করে বুজুর্গ হতে পারেন? অথচ বড় বড় আলেমরা বুজুর্গ হতে পারেন না’।

বুজুর্গ হওয়ার জন্য ইলম খুব বেশি শর্ত নয়। আমাদের সমাজে মধ্যম শ্রেণির আলেমরা বুজুর্গ হয়ে যান বড় আলেমদের আগে। কারণ বড় বড় মুহাদ্দিস, মুফতি সাহেবরা ইলমের গরিমার কারণে অন্যের কাছে যেতে লজ্জাবোধ করেন। ফলে তারা বুজুর্গির লাইনে পেছনে থাকেন। আর যদি যান তাহলে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে যান। অথচ যুবক বয়সের আমল আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয়। যুবকরা ইচ্ছা করলে সহজেই বুজুর্গ হতে পারে। আমাদের দেশের ইমাম-মুয়াজ্জিনদের বয়স সাধারণত ত্রিশ থেকে পঞ্চাশের ভিতরে হয়। তাই তাদের জন্য বুজুর্গ হতে কোনো অসুবিধার কারণ নেই। সহজেই তারা বুজুর্গ হতে পারে যদি একটু চেষ্টা-সাধনা করে। ছোহবত ছাড়া শুধু ইলম দ্বারা আল্লাহকে পাওয়া অসম্ভব। আজকের আলোচনার শুরুতে বলেছিলাম ছোহবতের কথা। ছোহবত ছাড়া শুধু ইলম দ্বারা আল্লাহকে পাওয়া অসম্ভব। তাই দেখা যায়, কাফিয়া পর্যন্ত পড়া মক্কী (রহ.)-এর ছোহবত অবলম্বন করেছেন হজরত হুসাইন আহমদ মাদানী (রহ.) নানুতুবী (রহ.) থানভী (রহ.)-এর মতো বিশ্ববিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ। মুহাজেরে মক্কী (রহ.)-এর ছোহবত অবলম্বন করে তারা তাদের ইলমকে মর্যাদা দান করেছেন। সারা দুনিয়ায় আজ তাদের নাম একবাক্যে উচ্চারিত হয়। ইতিহাসের সোনালি পাতায় আজ তাঁরা চির অমর হয়ে আছেন। পবিত্র কোরআনে আল্লাহপাক বলেছেন, ‘তোমরা সত্যবাদীদের সঙ্গে থাক।’ এখন আপনি-আমি যদি বলি যে, সেই ধরনের সত্যবাদী আল্লাহর ওলি বর্তমানে কোথাও নেই; তাহলে কোরআনের কথা মিথ্যা হবে। কারণ আল্লাহর বাণী থেকে যেহেতু বোঝা যায় যে, খাঁটি ওলি-বুজুুর্গ কেয়ামত পর্যন্ত থাকবে। সন্ত্রাসী-চোর যেমন অন্য সন্ত্রাসী-চোরকে চেনে, তেমনি আল্লাহওয়ালা ব্যক্তিগণ অন্য আল্লাহওয়ালাকে চেনেন। আপনি যদি আল্লাহওয়ালা হতে পারেন তাহলে আপনিও মারফতের চোখ দ্বারা অন্য আল্লাহওয়ালা বুজুর্গকে চিনতে পারবেন, জানতে পারবেন।

বুজুর্গ চেনার কয়েকটি জাহেরি আলামত

হজরত থানভী (রহ.) বলেছেন, বুজুর্গ চেনার কয়েকটি জাহেরি আলামত আছে। যেমন- (১) যার কাছে হাক্কানি আলেমরা বেশি আসা-যাওয়া করে। (২) সব ধরনের সুন্নতের পাবন্দি যে করে। জুনাইদ বাগদাদী (রহ.) খবর পেলেন, ওমুক জায়গাতে আল্লাহর একজন ওলি এসেছেন। পরে তিনি তাঁর সাক্ষাতের জন্য গিয়ে তাঁকে কেবলার দিকে থুতু ফেলতে দেখলেন। অথচ যারা আল্লাহর ওলি হন তারা  কেবলার দিকে থুতু নিক্ষেপের মতো কাজও করেন না। সে মতে কথিত এই বড় ওলি যে প্রকৃত ওলি নন তা বাগদাদী (রহ.) বোঝে নিলেন। (৩) শরিয়তের এই পরিমাণ ইলমের অধিকারী হওয়া যার মাধ্যমে ইবাদত, মুয়ামালাত ইত্যাদি শরয়ি বিধিবিধান সঠিকভাবে পালন করা যায়। হজরত থানভী (রহ.) বলেছেন, প্রতিটি মানুষের জন্য কমপক্ষে জালালাইন পর্যন্ত লেখাপড়া করা একান্ত প্রয়োজন। আগের দিনের বুজুর্গরা সামান্য কিছু লেখাপড়া করতেন। হেদায়া-জালালাইন পড়ে বুখারি শরিফ পড়াতে পারতেন। কিন্তু বর্তমানে বুখারি পড়ে শরহেজামি পড়াতে পারে না। এ হলো বর্তমান যুগের আলেম ও বুজুর্গদের অবস্থা।

বুজুর্গ হওয়ার সবচেয়ে বড় শর্ত

বুজুর্গ হওয়ার সবচেয়ে বড় শর্ত হলো গুনাহমুক্ত জীবন বানানো। আর এটা সম্ভব হবে ছোহবতের মাধ্যমে। তবে এমন ব্যক্তির ছোহবত অবলম্বন করতে হবে যার কাছে বসলে আল্লাহ-রসুলের কথা, সাহাবাদের কথা স্মরণ হয়, দুনিয়ার প্রতি অনীহা সৃষ্টি হয়, উম্মতের প্রতি দরদ পয়দা হয়, গুনাহগারকে দেখলে ঘৃণা আসে না।  মোটকথা যাকে দেখলে অন্তরে সৃষ্টির প্রতি দয়া, আমলের প্রতি উৎসাহ এবং গুনাহর প্রতি বিতৃষ্ণা সৃষ্টি হয় এরকম গুণসম্পন্ন ব্যক্তিই প্রকৃত ওলি ও বুজুর্গ। আল্লাহপাক আমাদের প্রকৃত বুজুর্গদের ছোহবত অবলম্বন ও আল্লাহর প্রিয় বান্দা হওয়ার  তৌফিক দান করুন!

লেখক : আমির, আল হাইআতুল উলয়া ও বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ

সর্বশেষ খবর