বৃহস্পতিবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

মানুষ পুড়িয়ে হত্যা জঘন্য অপরাধ

আবদুর রশিদ

মানুষ হত্যা ইসলামের দৃষ্টিতে মহা অপরাধ। মানুষ পুড়িয়ে মারা আরও বড় অপরাধ। রাজা নমরুদ নবী হজরত ইব্রাহিম (আ.)-কে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করতে চেয়েছিল। তার উদ্দেশ্য পূরণ হয়নি। বরং সে নিজে ধ্বংস হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় একই অপরাধ করেছে পাকিস্তানি দখলদার সৈন্যরা। তাদের পরিণাম সবার জানা। মানুষ আল্লাহর সুন্দরতম সৃষ্টি। আল্লাহ মানুষকে এ পৃথিবীতে তাঁর প্রতিনিধি বলে ঘোষণা দিয়েছেন। আল কোরআনে ইরশাদ হয়েছে- ‘আর তোমার পালনকর্তা যখন ফেরেশতাদের বললেন, আমি পৃথিবীতে একজন প্রতিনিধি বানাতে যাচ্ছি, তখন তারা বলল, তুমি কি পৃথিবীতে এমন কাউকে সৃষ্টি করবে যে দাঙ্গা-হাঙ্গামার সৃষ্টি করবে এবং রক্তপাত ঘটাবে? অথচ আমরা প্রতিনিয়ত তোমার গুণকীর্তন করছি এবং তোমার পবিত্র সত্তাকে স্মরণ করছি। তিনি বললেন, নিঃসন্দেহে আমি জানি, যা তোমরা জান না।’ সুরা বাকারা : ৩০। সৃষ্টির সেরা জীবের প্রতি ভালোবাসার কারণেই আল্লাহ মানুষকে দান করেছেন সৃষ্টিকুলের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর আকৃতি। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ইরশাদ করেন, ‘আমি সৃষ্টি করেছি মানুষকে সুন্দরতর অবয়বে।’ সুরা ত্বিন : ৪। আল্লাহর সুস্পষ্ট বাণী হচ্ছে, এ বিশ্বজগতের সবকিছু তিনি সৃষ্টি করেছেন কেবল মানুষেরই জন্য। আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘তিনিই সেই সত্তা যিনি সৃষ্টি করেছেন তোমাদের জন্য জমিনের সবকিছু।’ সুরা বাকারা : ২৯। আল্লাহ যেমন মায়া-মহব্বত করে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন, তেমন মায়া ও ভালোবাসা দিয়ে তিনি মানুষ জাতির সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছেন। একজন মানুষের জীবন, সম্পদ, মানসম্মান আল্লাহর কাছে এত দামি যে, কোরআন ও হাদিসে এসব বিষয়ের সুরক্ষা ও নিরাপত্তার ব্যাপারে অত্যন্ত কঠোর সব নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আল কোরআনে তো আল্লাহ একজন মানুষ হত্যা করাকে গোটা মানব জাতিকে হত্যার মতো জঘন্য অপরাধ বলে আখ্যায়িত করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘যে কেউ প্রাণের বিনিময়ে প্রাণ অথবা পৃথিবীতে অনর্থ সৃষ্টি করা ছাড়া কাউকে হত্যা করে সে যেন সব মানুষকেই হত্যা করল।’ সুরা মায়েদা : ৩২। অন্যদিকে একজন মানুষের জীবন রক্ষাকেও গোটা মানব জাতির জীবন রক্ষা বলে সাব্যস্ত করেছেন। ইরশাদ হয়েছে- ‘এবং যে কারও জীবন রক্ষা করে, সে যেন সবার জীবন রক্ষা করে।’ সুরা মায়েদা : ৩২। অন্যায়ভাবে যখন কোনো ব্যক্তি কোনো মানুষকে হত্যা করে তখন সে এতটাই অপাঙক্তেয় হয়ে যায় যে, সে পৃথিবীতে থাকার, মনুষ্যসমাজে বাস করার অধিকার হারায়। সে হয়ে পড়ে মানবসমাজের এক মরণঘাতী ব্যাধি, মানবসমাজ টিকে থাকার জন্য যার অপসারণ অপরিহার্য। আর অপসারণের কাজটিই হয় ঘাতকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের মাধ্যমে। কোনো ঘাতকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর মানেই অন্যান্য মানুষের নিরাপদ জীবন লাভ। কেবল মানুষের জীবনই নয়, বরং মানুষের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সুরক্ষার জন্যও আল্লাহ কোরআনে নির্দেশনা দিয়েছেন। বলা হয়েছে, ‘আমি এ গ্রন্থে তাদের প্রতি লিখে দিয়েছি যে, প্রাণের বিনিময়ে প্রাণ, চোখের বিনিময়ে চোখ, নাকের বিনিময়ে নাক, কানের বিনিময়ে কান, দাঁতের বিনিময়ে দাঁত ও জখমগুলোর বিনিময়ে সমান জখম।’ (সুরা মায়েদা : ৪৫। মানব জাতির মধ্যে যারা আল্লাহর ওপর বিশ্বাস স্থাপন করে অর্থাৎ যারা ইমানদার মুসলমান, তাদের বিনা বিচারে অন্যায়ভাবে হত্যা করার ব্যাপারে কোরআনে রয়েছে আরও কঠিন ধমকি। ইরশাদ হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি স্বেচ্ছাক্রমে মুসলমানকে হত্যা করে, তার শাস্তি জাহান্নাম, তাতেই সে চিরকাল থাকবে। আল্লাহ তার প্রতি ক্রুদ্ধ হয়েছেন, তাকে অভিসম্পাত করেছেন এবং তার জন্য ভীষণ শাস্তি প্রস্তুত রেখেছেন।’ সুরা নিসা : ৯৩।

রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘মুসলমানকে গালি দেওয়া ফাসেকি এবং তাকে হত্যা করা কুফরি।’ বুখারি, মুসলিম। কোনো ব্যক্তি তার মধ্যে ইমান থাকা অবস্থায় অন্য মোমিন মুসলমান ভাইকে হত্যা করতে পারে না। কারণ মুসলমান তো কেবল সে-ই হতে পারে, যার হাত ও মুখ থেকে অন্য মুসলমানরা নিরাপদ থাকে। যেমন এক হাদিসে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘খাঁটি মুসলমান হচ্ছে সে, যার হাত ও মুখ থেকে অন্য মুসলমান নিরাপদ থাকে।’ আরেক হাদিসে এসেছে, ‘প্রত্যেক মুসলমানের জন্য অন্য মুসলমানের জীবন, সম্পদ ও সম্মানে অন্যায় আঘাত করা হারাম।’ মুসলিম। এ ছাড়া অন্য এক হাদিসে মোমিনের পরিচয় দিতে গিয়ে বলা হয়েছে, ‘মোমিন হচ্ছে সেই ব্যক্তি, যাকে মানুষ নিজেদের জীবন ও সম্পদের ক্ষেত্রে নিরাপদ মনে করে।’ তিরমিজি। ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষ হত্যা হচ্ছে একটি জঘন্যতম অপরাধ। এর শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। অর্থাৎ নিহত ব্যক্তির বদলায় ঘাতকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা। তা ছাড়া ঘাতকের জন্য আল্লাহর রোষানলে পড়ে ধ্বংস হওয়া এবং তার লানতের শিকার হওয়ার মতো কঠোর শাস্তি তো রয়েছেই। এ ছাড়া আখেরাতে তার জন্য অপেক্ষা করছে মর্মন্তুদ শাস্তি। যারা সমাজে সন্ত্রাস চালায়, অন্য মানুষকে বিনা কারণে হত্যা করে, যানবাহন ট্রেনে আগুন লাগিয়ে মানুষকে পুড়িয়ে মারে ইসলামের দৃষ্টিতে তারা কবিরা গুনাহকারী। তাদের সর্বোচ্চ শাস্তিই প্রাপ্য। আল্লাহ অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণকারীদের জান্নাতে ঠাঁই দিন।

লেখক : ইসলামবিষয়ক গবেষক

সর্বশেষ খবর