শনিবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

পরনিন্দা ইসলামে গুনাহের কাজ

মুফতি মোহাম্মদ এহছানুল হক মুজাদ্দেদী

পরনিন্দা ইসলামে গুনাহের কাজ

কবিরা গুনাহের অন্যতম পরনিন্দা করা। যাকে আরবিতে গিবত বলা হয়। বাংলায় এর আভিধানিক অর্থ  পরনিন্দা। ইমাম গাজ্জালি মুকাশাফাতুল কুলুবে বলেছেন, কারও অনুপস্থিতিতে তার এমন কোনো দোষ-ত্রুটি নিয়ে সমালোচনা করা, যা শুনলে সে আঘাত পাবে।  হোক তা মুখে আলোচনার মাধ্যমে অথবা ইশারা-ইঙ্গিতে, কলমের খোঁচা কিংবা ভিন্ন কোনো উপায়ে। গিবত বা পরনিন্দা করা ইসলামে কবিরা গুনাহ তথা বড় পাপ।  আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা পরনিন্দা কর না। তোমাদের কেউ কি আপন মৃত ভাইয়ের গোস্ত খেতে পছন্দ করবে? অথচ তোমরা তা খুবই ঘৃণা কর। আল্লাহকে ভয় কর, নিশ্চয়ই আল্লাহ তওবা কবুলকারী দয়ালু।’ (সুরা হুজুরাত-১২)। অন্য আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘প্রত্যেক পশ্চাতে ও সম্মুখে পরনিন্দাকারীর জন্য ধ্বংস হোক।’ (সুরা হুমাজাহ-১)।

পরনিন্দার কারণে স্বামী-স্ত্রী, ভাই বোন, পরিবারে, সমাজে ঝগড়া, কলহ-বিবাদ লেগেই থাকে। ভুল বুঝে অনেকে অনেকের ক্ষতিসাধন করে। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরনিন্দা, পরচর্চা না করার জন্য আমাদের সাবধান করেছেন। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত। প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, তোমরা কি জানো, গিবত কাকে বলে? সাহাবায়ে কেরামগণ বললেন, আল্লাহতায়ালা ও তাঁর রসুলই ভালো জানেন। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা কোনো মুসলমান ভাই সম্পর্কে এমন কথা বলো না, যা শুনলে তার খারাপ লাগবে। জিজ্ঞাসা করা হলো, যদি ভাইয়ের মধ্যে সে দোষ থাকে, যা আমি বললাম। তবুও কি গিবত হবে? নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যা তুমি বলছ সেই দোষ যদি তোমার ভাইয়ের মধ্যে থাকে, তাহলেও গিবত হবে। আর যদি সে ত্রুটি না থাকে, তবে তুমি তার প্রতি অপবাদ দিলে (সহিহ মুসলিম)।

গিবতের গুনাহ খুবই ভয়াবহ। কেননা গিবত হলো বান্দার হক। গিবতের অপরাধ বান্দা ক্ষমা না করা পর্যন্ত মহান আল্লাহতায়ালাও ক্ষমা করেন না। হাদিস শরিফে পরনিন্দা গিবত করাকে জেনা ব্যভিচার থেকেও মারাত্মক বড় গুনাহ বলা হয়েছে। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, গিবত জেনা থেকেও মারাত্মক। সাহাবারা আরজ করলেন এটা কীভাবে? নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, মানুষ ব্যভিচার করার পর তওবা করে আর আল্লাহতায়ালা দয়া করে ক্ষমাও করে দেন, কিন্তু নিন্দাকারীকে আল্লাহতায়ালা কখনো ক্ষমা করেন না, যতক্ষণ যার নিন্দা করা হয়েছে, সে ক্ষমা না করে (তাবারানি, মুজামুল আওসাত)। আমাদের মনে রাখতে হবে, তিন শ্রেণির মানুষের দোয়া মহান আল্লাহর দরবারে কবুল হয় না। ১. হারামখোর। ২. গিবতকারী। ৩. কৃপণ ও হিংসুক ব্যক্তির (তাফসিরে কুরতুবি)।

পরনিন্দার দুটি স্তর রয়েছে। গিবত ও তুহমত (অপবাদ)। একবার রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (সাহাবিদের) জিজ্ঞাসা করেন, তোমরা কি জান গিবত কাকে বলে? তারা উত্তরে বলেন, আল্লাহ ও তাঁর রসুলই ভালো জানেন। তখন তিনি বলেন, গিবত হলো তোমার ভাই সম্পর্কে এমন কোনো কথা বলা, যা শুনলে সে অপছন্দ করবে। সাহাবারা জানতে চাইলেন, হে আল্লাহর রসুল! যদি সত্যিই তার মধ্যে সেই দোষ থাকে তাহলেও কি গিবত হবে? রসুল (সা.) বলেন, যদি সত্যিই তার মধ্যে সেই দোষ থাকে, তবে তা গিবত হবে। আর যদি তার মধ্যে সেই দোষ না থাকে, তবে তা তুহমত (অপবাদ) হবে। যা গিবত থেকেও মারাত্মক গুনাহ (মুসলিম)। যখন কোনো ব্যক্তি আপনার সঙ্গে বসে অন্যের গিবত করবে, তখন তাকে থামতে বলুন, আল্লাহর হুকুমের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তাকে সাবধান করুন। আর তাতেও যদি কাজ না হয়, তবে সেখান থেকে সরে আসুন। মহানবী হজরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘পরনিন্দাকারী জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না’ (বুখারি ও মুসলিম)।

আল্লাহতায়ালা আমাদের  হেফাজতে সালামতে রাখুন। গিবতের গুনাহ থেকে মুক্তির উপায় হলো- অন্যায়ভাবে যার গিবত করেছে তার জন্য মন থেকে দোয়া করা। হজরত হুজায়ফা (রা.) বলেছেন, ‘গিবতের কাফফারা হচ্ছে যার গিবত করা হয়েছে তার জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া’ (বাহজাতুল মাজালিস, ইবনু আবদিল বার)। তবে জুলুম, অন্যায়কে ধরিয়ে দিলে, প্রতিবাদ করলে ইসলামে এটা গিবত হবে না। দুনিয়া আখেরাতে পরনিন্দার পরিণাম অত্যন্ত ভয়াবহ। তাই আসুন, চলার পথে মসজিদ-মাদরাসায়, হাটে-বাজারে, পরিবারে, ব্যবসায়িক কার্যক্রমে আমরা পরনিন্দা থেকে বেঁচে থাকি। পরনিন্দা, পরচর্চা না করে আমরা নিজেরা মহান আল্লাহতায়ালার ইবাদতে সর্বদা মশগুল থাকি। মহান আল্লাহতায়ালা প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উসিলায় আমাদের তৌফিক দান করুন।  নেক আমলের সঙ্গে, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায়কারী, পরোপকারী হিসেবে আমাদের সবাইকে কবুল করুন। আমিন।

♦ লেখক : বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ ইমাম, খতিব, মনিপুর বায়তুল আশরাফ (মাইকওয়ালা) জামে মসজিদ, মিরপুর-২, ঢাকা

সর্বশেষ খবর