শনিবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

এ দেশে ক্ষমতার ভারসাম্য : ১০০ বনাম শূন্য

মোশাররফ হোসেন মুসা

এ দেশে ক্ষমতার ভারসাম্য : ১০০ বনাম শূন্য

গণতন্ত্র আর যুক্তিবাদ একে অপরের অবিচ্ছেদ্য অংশ। যুক্তিচর্চার মাধ্যমেই মানুষ যুক্তিমূলক মানসিকতা অর্জন করে; তখন জনগণ নাগরিক শ্রেণিতে রূপান্তরিত হয়।  প্রাচীন গ্রিসে যুক্তির প্রতি ভক্তি থাকায় দার্শনিক সমাজ গড়ে উঠেছিল। সক্রেটিস, ডেমোক্রিটাস, প্লেটো, ইউক্লিড, এরিস্টটল প্রমুখ দার্শনিকরা সন্দেহবাদ, ভাববাদ ও বস্তুবাদের পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তিতর্ক করতেন। যুক্তিবাদের প্রতি সম্মান দেওয়ার কারণেই দাসপ্রথা, সামন্তবাদ, যাজকতন্ত্র ও রাজতন্ত্রের বিলুপ্তি ঘটে। একপর্যায়ে রেনেসাঁসের সৃষ্টি হয়। আমাদের ঐতিহাসিক সংগ্রামগুলোর পেছনেও যুক্তিবাদ রয়েছে। শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ মার্চে যে ভাষণ দেন সেখানেও বিভিন্ন যুক্তির কথা উঠে আসে। তিনি বলেন, ‘যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও, সে একজনও যদি হয়, তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেবো’। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী কোনো যুক্তি না মানায় আমাদেরকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নয় মাসব্যাপী সশস্ত্র যুদ্ধ করতে হয়। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস স্বাধীন বাংলার প্রথম জাতীয় সংসদেই যুক্তির কথা পরাজিত হতে দেখা যায়। ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। প্রাপ্ত ভোটের ৭৩.২০% পায় আওয়ামী লীগ। ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৯১টি আসনে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়। এর মধ্যে ১১টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। বাকি ৯ আসনের মধ্যে জাসদ একটি, মোজাফ্ফর ন্যাপ একটি, জাতীয় লীগ একটি ও স্বতন্ত্র পাঁচটি আসনে জয়লাভ করে এবং একটি আসন স্থগিত থাকে। জাসদ ২৩৭টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। প্রাপ্ত ভোটের ১ কোটি ৩৮ লাখ ভোট পায় আওয়ামী লীগ এবং ১২ লাখ ২৫ হাজার ভোট পায় জাসদ। ওই সংসদে বিরোধী আসনে মুখ্য ব্যক্তি ছিলেন আতাউর রহমান খান ও স্বতন্ত্র সদস্য আবদুল্লাহ্ সরকার। শোনা যায়, জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক বঙ্গবন্ধুকে পরামর্শ দিয়েছিলেন গোপনে হলেও জাসদকে সহযোগিতা করে বিরোধী দল হিসেবে সৃষ্টি করতে। বঙ্গবন্ধু উত্তরে বলেছিলেন, তিনি মানলেও দল মানবে না (সূত্র : আহমদ ছফা রচিত ‘যদ্যপি আমার গুরু’)। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংবিধানের চতর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বাকশাল গঠন করা হয়। এ বিষয়ে সংসদে ১১ মিনিট আলোচনা হয়। বিরোধিতা করেন তিনজন এবং একজন ওয়াকআউট করেন। অন্যদিকে সংবিধানে ৭০ অনুচ্ছেদ সংযুক্ত করে সংসদে সরকারের বিরুদ্ধে সরকারি দলের সংসদ সদস্যদের মতামত রাখার পথকে সংকুচিত করে দেওয়া হয়। গণতান্ত্রিক সংগ্রাম কোনো ব্যক্তিকে হত্যার কথা বলে না। কতিপয় বিপথগামী সৈন্য বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে দেশকে পাকিস্তানি ভাবধারায় নিয়ে যায়। জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে মুখে বহুদলীয় গণতন্ত্রের কথা বলেন কিন্তু ১৯৭৯ সালে জাতীয় সংসদে ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ’ পাস করে নৃশংস হত্যাকান্ডকে বৈধতা দেন। তৎকালীন সরকার বিভিন্ন কার্যকলাপে প্রমাণ করে- সব দলকে স্বাগত, তবে আওয়ামী লীগকে নয়। এরশাদ সরকারও একই সংস্কৃতি চালু রাখে। ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রাম লালদীঘি ময়দানে জনসভাস্থলে শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে পুলিশ নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে। এতে ঘটনাস্থলেই ২৪ জন নিহত হন। তাদের মধ্যে নয়জন নিহত হন শেখ হাসিনাকে মানববর্ম তৈরি করে রক্ষা করতে গিয়ে। এরশাদ সরকারের পতনের পর আশা করা হয়েছিল বিএনপি তিন জোটের রূপরেখা অনুযায়ী দেশ পরিচালনা করবে। কিন্তু বিএনপিও একই রাস্তায় হাঁটা শুরু করে। এখন পর্যন্ত যতগুলো জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে তন্মধ্যে ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালের নির্বাচনকে মোটামুটি নিরপেক্ষ ধরা হয়। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি ১৪০টি ও আওয়ামী লীগ ৮৮টি আসনে জয়লাভ করে এবং ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৪৬টি ও বিএনপি ১১৬টি আসনে জয়ী হয়। সংসদ দুটি বিরোধী দলের পদচারণায় প্রাণবন্ত ছিল। কিন্তু বিরোধী দলকে ছায়া সরকার হিসেবে গণ্য করা এবং বিরোধী দলও সেভাবে দায়িত্ব পালন করা- কোনোটাই দেখা যায়নি। বিরোধীদলীয় নেতার পদটি একজন পূর্ণমন্ত্রীর সমান পদমর্যাদার অধিকারী। তাঁর জন্য ঢাকার মিন্টো রোডে বিশাল একটি বাসভবন রয়েছে। বাসভবনটিতে বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাস সংযোগসহ সুরক্ষিত সীমানা প্রাচীর রয়েছে। তারপরেও বিরোধী দলীয় কোনো নেতাকে ওই বাসভবনে বসবাস করতে দেখা যায়নি। এর পেছনে রয়েছে সরকারের প্রতি অনাস্থা। ২০০১ সালের ১ অক্টোবর অষ্টম জাতীয় সংসদে বিএনপি ১৯৩টি আসন (মোট ভোটের ৪১.৪০%) এবং আওয়ামী লীগ ৬২টি আসন (মোট ভোটের ৪০.০২%) লাভ করে। বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাকে উপযুক্ত নিরাপত্তা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়নি। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট এক জনসভায় শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। ওই হামলায় ২৪ জন নিহত ও কমপক্ষে ৪০০ আহত হন। প্রতিপক্ষকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার রাজনীতি নতুন নয়, এটি মানবজাতির শুরু থেকেই রয়েছে। বিভিন্ন দেশের ইতিহাস ঘাঁটলে বিরোধী পক্ষকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার ইতিহাস পাওয়া যাবে। ধর্ম উৎপত্তির ইতিহাসেও গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্ব ও প্রতিপক্ষকে হত্যা করার ঘটনা রয়েছে। উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোর ইতিহাসে রক্তপাত রয়েছে কিন্তু পাশাপাশি ধাপে ধাপে গণতন্ত্র উন্নত হওয়ার ঘটনাও রয়েছে। সেখানে দাসপ্রথা, সামন্তবাদ, যাজকতন্ত্র, রাজতন্ত্র ইত্যাদির বিরুদ্ধে ধারাবাহিক আন্দোলন থাকায় গণতন্ত্র যুক্তিবাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। রোমানদের দ্বারা গ্রিক দখল হলেও রোমান শাসকরা গ্রিকের দর্শন বর্জন করেননি। রোমান আইনে গ্রিক দর্শনের প্রভাব লক্ষণীয়। গণতান্ত্রিক রাজনীতি মানে বিরোধী পক্ষের সঙ্গে সমঝোতা করে দেশ পরিচালনা করা।  এ দেশে জয়ী হওয়া মানে হিরো, আর পরাজিত হওয়া মানে জিরো- এ স্বৈরাচারী মানসিকতা দূর করতে হলে উপযুক্ত পদ্ধতি (মেকানিজম) বাস্তবায়ন করতে হবে। একাধিক সরকারব্যবস্থা ও ক্ষমতার বিকেন্দ্রিকরণ ছাড়াও আপাতত সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধি নির্বাচন সমাধান দিতে পারে।

লেখক : গণতন্ত্রায়ণ ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারবিষয়ক গবেষক

 

 

সর্বশেষ খবর