সোমবার, ২৫ ডিসেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

টেলিভিশনের জন্য একটি নীতিমালা প্রয়োজন

ফরিদুর রেজা সাগর

টেলিভিশনের জন্য একটি নীতিমালা প্রয়োজন

মূল ব্যাপারটা আসে বিজ্ঞাপন থেকে। বাংলাদেশ টেলিভিশনেও বিজ্ঞাপন থেকে আয় হতো। সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে ভর্তুকি অথবা বিশেষ অনুদান এ ধরনের টাকা বাংলাদেশ টেলিভিশনে আসত। কিন্তু মূল আয়টা ছিল বিজ্ঞাপন থেকে। এ বিজ্ঞাপনের ব্যাপারে টেলিভিশনের নিজস্ব একটি নীতিমালা ছিল। বিজ্ঞাপন বিভাগের প্রধান ইসহারুল হক আল্লাহর রহমতে এখনো আমাদের মাঝে রয়েছেন। এ মানুষটি কীভাবে যে নীতিমালা তৈরি করেছিলেন তা আজ আমাদের কাছে বিরাট বিস্ময়। টিনজাত গুঁড়া দুধের বিজ্ঞাপন যাবে কিন্তু সেখানে সুন্দর করে লেখা থাকবে মায়ের দুধের বিকল্প নয়।  যে কোনো বিজ্ঞাপনে ‘পণ্য’কে বলা যাবে না ‘এটাই সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ’ অথবা সবচেয়ে সেরা।

যে কোনো বিজ্ঞাপন দিয়েই বলা যাবে না তারটাই একমাত্র দামি। অর্থাৎ চটকদার বিজ্ঞাপন দেখে মানুষ যাতে কোনোভাবেই বিভ্রান্ত না হয় সে ব্যাপারে বাংলাদেশ টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ ছিল অত্যন্ত সচেতন। আরেকটি ব্যাপারে তারা খুবই সচেতন ছিল যে, বাংলাদেশের বিজ্ঞাপন বাংলাদেশের মডেল দিয়ে তৈরি করতে হবে। যেন আমাদের দেশের শিল্পীরা কাজ করতে পারে। এ ব্যাপারেও তাদের কঠিন নীতিমালা ছিল। কারণ বিদেশি মডেল ব্যবহার করলে আলাদা টাকা দিতে হতো। বাংলাদেশের বাইরের কোনো প্রডাক্ট হলে আলাদা টাকা দিতে হতো। এরকম নানা নীতিমালায় বন্দি ছিল টেলিভিশনের বিজ্ঞাপন জগৎ। এত নীতিমালায় আবদ্ধ থাকার পরও টেলিভিশনে এত বিজ্ঞাপন আসত যে বাংলাদেশ টেলিভিশন বাধ্য হয়েছিল সøট করে দিতে। অর্থাৎ এ অনুষ্ঠানের পর বিজ্ঞাপন প্রচার হবে এতক্ষণ ‘নির্দিষ্ট মিনিট’-এ অর্থাৎ এ অনুষ্ঠানে এই পরিমাণ বা এত মিনিটের বিজ্ঞাপন যাবে এরকম একটা ব্যাপার ছিল। নির্ধারিত সময়ের বেশি বিজ্ঞাপন যাবে না। যারা বিজ্ঞাপন দিতেন তাদের এরকম একটা ধারণা সবসময়ই ছিল। আজ থেকে ৩০-৪০ বছর আগের এই বিজ্ঞাপনের দিকে যদি আমরা তাকাই টেলিভিশনের পর্দা ছিল বিজ্ঞাপনময় এবং সেই বিজ্ঞাপনগুলো ছিল অনুষ্ঠানের মতো রুচিশীল। তাছাড়া সেই বিজ্ঞাপনের সময় কেউ রিমোট ঘুরিয়ে অন্য কোনো চ্যানেলও দেখতেন না বা টেলিভিশন বন্ধ করে দিতেন না। তখনকার সময়ের বিজ্ঞাপনগুলো ছিল অসম্ভব জনপ্রিয়।

সেসময়ে বিজ্ঞাপনে নতুন ধারা এনেছিলেন আফজাল হোসেন, সাইদুল আনাম টুটুল, তারিক আনাম খানসহ এমনি একঝাঁক তরুণ নির্মাতা। পরবর্তীতে আরও কয়েকজন তরুণ যুক্ত হলেন- মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, পিপলু খান এমনি করে আরও অনেকেই এ বিজ্ঞাপন ধারার পরিবর্তন এনেছেন। অমিতাভ রেজার কথা তো বলতেই হবে। যে ছেলেটি মারা গেলেন আহসান নেওয়াজ বাবু, আনোয়ার হোসেন বুলুর কথা। অসম্ভব সুন্দর চিত্রায়ণ করতেন। কদিন আগে পুরনো বিজ্ঞাপন দেখতে গিয়ে দেখলাম যে বেশির ভাগ বিজ্ঞাপনগুলোই জিঙ্গেলনির্ভর। অর্থাৎ বিজ্ঞাপনে গান থাকে। ছোট্ট ৩০ সেকেন্ডের গান। কিন্তু কী সুমধুর। সেই গানগুলো দিয়ে সাজানো বিজ্ঞাপন সহজেই মানুষের মনে দাগ কাটে। এখন বিজ্ঞাপন থেকে জিঙ্গেল চলে গেছে, বিজ্ঞাপনের মান ও বিজ্ঞাপন কীভাবে যাচ্ছে, কতটুটু যাচ্ছে সেই আলোচনা আজ অর্থাৎ টেলিভিশনের জন্মদিনে আমি যেতে চাই না। টেলিভিশন বেড়েছে অনেক গুণ। এখন টেরেস্টোরিয়াল টেলিভিশনসহ প্রায় চল্লিশটি টেলিভিশন পৃথিবীজুড়ে বাঙালি দর্শকরা দেখতে পাচ্ছেন। কিন্তু টেলিভিশনের সেই বিজ্ঞাপনের কোয়ালিটি কোথায়, কোয়ানটিটি কোথায়? সেই দিনগুলো কোথায় যখন টেলিভিশনের বিজ্ঞাপনে সুন্দর জিঙ্গেল থাকত? আর সবচেয়ে বড় কথা, বিজ্ঞাপন কমে গেছে অসম্ভব হারে। তখন টেলিভিশনে যত বিজ্ঞাপন প্রচারিত হতো সেগুলো প্রচারের জন্য পরিশোধ করতে হতো নির্ধারিত টাকা। কেননা বাংলাদেশ টেলিভিশনের কোনো ক্ষমতা ছিল না এ টাকা (মূল্য হারে) কমানোর। সেটা বা সেই অবস্থান এখন কোথায়? এখন টাকার ‘মূল্য হার’ বা হিসাবের কোনো ঠিক নেই। বিজ্ঞাপন সংখ্যা অত্যন্ত কম। কয়েকটা প্রতিষ্ঠান ছাড়া কেউ আর বিজ্ঞাপন করেন না। অথচ দেশে যারা বিজ্ঞাপন বেশি করতেন, ফোন কোম্পানির কথা বাদ দিলাম, কারণ তখন ফোন কোম্পানি ছিল না। তার বাইরে সাবান, দুধ, চায়ের দুধ, শাড়ি এমনকি আমার মনে আছে মানিকগঞ্জ থেকে একটা মাথা ঠান্ডা রাখার তেল তৈরি হতো- কদুর তেল, সেটারও বিজ্ঞাপন হতো টেলিভিশনে। মিল্লাতের প্রডাক্টগুলো যেভাবে পথের ধারে বিক্রি হতো সেই প্রডাক্টের বিজ্ঞাপনও চলে যেত টেলিভিশন পর্দায়। অর্থাৎ যিনি তার পণ্য বিক্রি করার ইচ্ছা পোষণ করেছেন তিনি প্রথমেই ক্রেতাদের কাছে যেতে চেয়েছেন। তাদের লক্ষ্যই ছিল ক্রেতা। টেলিভিশনই ছিল তার পণ্য ক্রেতাদের দোরগোড়ায় পৌঁছানোর প্রধান মাধ্যম।

সেখানে আজকে কী অবস্থায় দাঁড়িয়েছে টেলিভিশন? এত এত পণ্য কিন্তু সেই হারে বিজ্ঞাপন নেই। কখনো ঝোঁক বুঝে সিমেন্টের বিজ্ঞাপন আসে কিন্তু সেটা অন্য ফরমেটে, অন্য দামে, অন্যভাবে। আমাদের দেশে সব জিনিসের দাম বাড়ে কিন্তু বিজ্ঞাপনের দাম বাড়ে না। বরং দিন দিন বিজ্ঞাপনের দাম কমছে। বিজ্ঞাপন শিল্পের দাম তো বাড়েইনি এমনকি পরিমাণও বাড়েনি। ৪০টি টেলিভিশনে যে বিজ্ঞাপন খুব বেশি দেখা যাবে সেটা কী পরিমাণ বেড়েছে সেরকম কোনো সমীক্ষা বা গবেষণা বা তথ্য পাওয়া যাবে না!

যদি এভাবে চলতে থাকে, বিজ্ঞাপনের হার ও দাম যদি কমতে থাকে তাহলে টেলিভিশনের অনুষ্ঠানের মান উন্নয়নের পথ দুরূহ হয়ে উঠবে। এই যে ৪০টি টেলিভিশন নিয়ে আমরা এত গর্ব করি অহংকার করি সেটা থাকবে না।  টেলিভিশনকে ভালো থাকার জন্য সচল রাখার জন্য আমাদের অবশ্যই নতুন করে ভাবতে হবে। নতুন করে আয়ের কথা ভাবতে হবে। ক্যাবল অপারেটর বন্ধুদের কাছ থেকে হোক, ক্যাবলের টাকার বাইরে হোক বা আসন্ন নতুন নতুন প্রযুক্তি থেকে হোক, বিজ্ঞাপন থেকে টেলিভিশন কর্তৃপক্ষের ঘরে টাকা ঢুকতেই হবে। না হলে এ মুহূর্তে টেলিভিশন চালানো কঠিন। আজকে যখন বাংলা টেলিভিশনের প্রায় ৬০ বছর পালিত হচ্ছে তখন এটা আমরা আশা করতেই পারি ডিজিটাল যুগে, উন্নতির যুগে ২০৪১ সালে যখন আমরা মধ্যম আয়ের  দেশ হব তার আগে আমাদের টেলিভিশনের পর্দায় আয় কীভাবে হবে সে ব্যাপারে একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রয়োজন। এ নীতিমালা আমাদের টেলিভিশনের মানকে উন্নত করতে বিশেষ সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।  

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব

সর্বশেষ খবর