বুধবার, ২৭ ডিসেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

সমীকরণ : ’৫২-র ৭১ এবং ’৭১-র ৫২ বছর

ড. এম মেসবাহউদ্দিন সরকার

সমীকরণ : ’৫২-র ৭১ এবং ’৭১-র ৫২ বছর

সমীকরণ হলো সংখ্যা ও প্রতীক ব্যবহারের এক ধরনের গাণিতিক বিবৃতি, যেখানে দুটি পক্ষের সমান বা আনুপাতিক ভারসাম্যের হিসাব দেখানো হয়।  গাণিতিকভাবে এই ফর্মুলা ব্যবহার এবং প্রমাণ করা যত সহজ, গণতান্ত্রিক এবং রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠা করা ততই কঠিন। তবে বাঙালির ইতিহাসে ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ মানুষের অধিকার ও স্বাধিকার আদায়ের সবচেয়ে বড় দুটি অর্জনে আছে এক চমৎকার গাণিতিক সমীকরণ। সেটি হচ্ছে ২০২৪ সালে ’৫২-এর ৭১ বছর আর ’৭১-এর ৫২ বছর। আছে গণিতের মতোই অনেক সমতা এবং অর্জন। যেমন- বাংলা ভাষা আজ দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। ইন্টারনেট এবং প্রযুক্তির কল্যাণে বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে আজ বাংলা ভাষা ব্যবহৃত হচ্ছে অনায়াসে। একইভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে বাঙালি জাতি আজ বিশ্ব-দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা, প্রযুক্তি ও অবকাঠামা ইত্যাদি খাতে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বিস্ময়। দৃষ্টিনন্দন বিমানবন্দর, পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, বঙ্গবন্ধু টানেল, ৪-জি-৫-জি মোবাইল টেকনোলজি, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট এবং ডিজিটাল বাংলাদেশের সফল জার্নি শেষে স্মার্ট বাংলাদেশে উপনীত হওয়ার এক বিস্ময়কর সমীকরণে এগোচ্ছে বাংলাদেশ, যা সত্যিকার অর্থে ’৫২ এবং ’৭১-এর চেতনাকে ধারণ করে চলেছে।

তবু ভাষা আন্দোলনের ৭১ বছর এবং স্বাধীনতার ৫২ বছর আমাদের প্রাপ্তি এবং অপ্রাপ্তির সমীকরণে যেমন বেশকিছু চমৎকার মিল আছে, তেমনি আছে অমিলও। যেমন ভাষা আন্দোলনের ৭১ বছরেও স্বীকৃতি পাননি বাগেরহাটের চারণ কবি সামসুদ্দিন শেখ। ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনও করিলিরে বাঙ্গালী, তোরা ঢাকা শহর রক্তেই ভাসায়লী’ এ গানের রচয়িতা তিনি। ’৫২-এর ২১ ফেব্রুয়ারি রাতে ঢাকায় বসে এই গান রচনা করেন, যা সে সময় ‘রাষ্ট্রভাষা’ নামে ভাষা আন্দোলনের প্রথম গান হিসেবে অনেকেই মনে করেন। তাঁর এই গান অমর হয়ে থাকলেও রাষ্ট্রীয়ভাবে ভাষাসৈনিক হিসেবে তিনি আজও কোনো স্বীকৃতি পাননি। নাম না-জানা এরকম আরও ভাষাসৈনিক আছেন কি না তা খতিয়ে দেখা দরকার। একইভাবে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের অন্যতম ঐতিহাসিক প্রতীক শহীদ মিনারও নেই অনেক প্রতিষ্ঠানে। গণমাধ্যম থেকে জানা যায়, শুধু বরিশালে ৩১১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার নেই। সারা বাংলাদেশে এই সংখ্যা কত তা খুব সহজেই অনুমেয়। স্থায়ী শহীদ মিনার না থাকায় প্রতি বছর এসব প্রতিষ্ঠানে বাঁশ-কাঠ ও কাগজ দিয়ে অস্থায়ী শহীদ মিনার বানিয়ে শহীদদের উদ্দেশে তারা শ্রদ্ধা নিবেদন করে। ফলে ভাষা আন্দোলনের ৭১ বছর আর স্বাধীনতার ৫২ বছর পরও অনেক শিক্ষার্থী ভাষা শহীদদের আত্মত্যাগের সঠিক ইতিহাস জানতে পারছে না। অথচ ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন এবং ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ ছিল একই সমীকরণের শুরু ও শেষের ধাপ।

এদিকে শহীদ কাজী মতিউর রহমান, ’৭১-এর রণাঙ্গনের অমিত সাহসী এক অকুতোভয় বীরযোদ্ধার কথা কে না জানে। ১৯৭০ সালের বরিশালের চাখারে শেরেবাংলার পুত্র এ কে ফায়জুল হকের নির্বাচনি জনসভায় তার জ্ঞানগর্ব জ্বালাময়ী বক্তব্যে মুগ্ধ হয়ে বঙ্গবন্ধু নিজের গায়ের চাদর খুলে তার গায়ে জড়িয়ে দিয়েছিলেন। সেই ছাত্রনেতা দেশ বিজয়ের মাত্র ২০ দিন আগে শত্রুদের নির্মম বুলেটে নিহত হন। অথচ গত ৫২ বছর মহান এই শহীদের কোনো স্বীকৃতি ছিল না। অবশেষে এ বছর (২০২৪) ৫ জানুয়ারি তাঁকে শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেওয়া হয় (বাংলাদেশ গেজেটের অতিরিক্ত সংখ্যার ৭ ক্রমিকে ৩৬৩৮ নম্বর গেজেট)। তবে তার মৃতদেহ খুঁজে না পাওয়ায় স্মৃতি সংরক্ষণ সম্ভব হচ্ছে না আজও। এভাবে এখনো যেমন অনেক মুক্তিযোদ্ধার ইতিহাস অজানা রয়ে গেছে, তেমনি সম্প্রতি মুক্তিযুদ্ধের তথ্যসংবলিত ‘মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ’ তৈরি করে জাতিকে ধন্য করেছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, আয়ারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রায় ১ লাখ ২৪ হাজার ৮৫৬টি সংবাদ, ফিচার, চিঠি, কনটেন্ট ইত্যাদি সংগ্রহের একটি সমৃদ্ধ ডেটাবেজ হলো এই ‘মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ’। এর বিপরীতে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রায়ই ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার খবর প্রকাশিত হয়। এদিকে অনেক মুক্তিযোদ্ধার খবর প্রকাশিত হয় যাদের বয়স ওই সময়ে সাত-আট বছর ছিল। এসব ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা মাসিক ভাতাও নিচ্ছে, যা খুবই লজ্জার এবং মুক্তিযুদ্ধের জন্য কলঙ্কজনক। এ অন্যায় চলতে দেওয়া যায় না এবং এ অসম সমীকরণের লাগাম টানা দরকার।

সর্বত্র বাংলা বছর প্রচলনটি আজও পরিপূর্ণ হয়নি গত ৭১ বছরে। এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ বিচারব্যবস্থার রায়ে। প্রফেসর সলিমুল্লাহ স্যারের মতে, প্রাথমিক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত অনেকেই শুদ্ধ বাংলা বলতে ও লিখতে পারে না। শিক্ষাজীবনে প্রতিটি ছাত্র যেসব বিষয়ে কম নম্বর পায় তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বাংলা। আর বিকৃত এবং ব্যাংলিশ উচ্চারণ এখন প্রতিদিনের অভ্যাস। কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্মার্টনেস হিসেবেও বিবেচনা করা হয়। দেশের অগণিত টেলিভিশন চ্যানেলের খবর পাঠকদের কথা শুনলেই এর স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। এসব দেখে মনে হচ্ছে, বাংলা ভাষার প্রতি দরদ দিন দিন কমে যাচ্ছে।  একইভাবে অসম্মান করা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকেও। একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যই ছিল মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম উদ্দেশ্য। কিন্তু আজ ধর্মকে ব্যবসা করে রাজনীতি হচ্ছে।

লেখক : অধ্যাপক ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, আইআইটি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর