শুক্রবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

অনেক প্রশ্ন রেখে যাচ্ছে ২০২৩

মেজর নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ (অব.) পিএইচডি

অনেক প্রশ্ন রেখে যাচ্ছে ২০২৩

প্রিয় পাঠক যখন এ লেখাটি পড়বেন তার দুই দিনের মধ্যে কালের আবর্তে হারিয়ে যাবে ২০২৩ সাল এবং উদিত হবে ২০২৪ সালের নতুন সূর্য। যেসব বছরের শেষে জোড় সংখ্যা, সেসব বছরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বরাবরই জয়লাভ করে। উদাহরণ হিসেবে ১৯৭০, ১৯৯৬, ২০০৮, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের কথা বলা যায়। এ পাঁচটি বছরের নির্বাচনে জয় পেয়েছিল দলটি। ব্যতিক্রম ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ নির্বাচন, শেষে বেজোড় সংখ্যা থাকা এ বছরে আওয়ামী লীগ ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯৩ আসন পেয়েছিল। অন্যদিকে ১৯৯১ ও ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে পরাজয় মানতে হয়েছে। এর মধ্যে ১৯৯১ সালে ছিল ক্ষমতায় ফিরে আসার সংগ্রাম আর ২০০১ সালে ছিল ক্ষমতা ধরে রাখার লড়াই। তবে ২০১৪ এবং ২০১৮ সালে এ ধরনের জয়-পরাজয়ের কোনো শংকায় পড়তে হয়নি আওয়ামী লীগকে। বেশ নিরাপদে নৌকা তীরে ভিড়েছে।

বিএনপির একজন নেতা কিছু দিন আগে এক রাজনৈতিক সভায় বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ ২০১৪ ও ২০১৮ সালে দুবার ছক্কা মেরেছে। তাদের আর ছক্কা মারতে দেওয়া হবে না। আর লুডু খেলায় তিনবার ছক্কার অর্থ ‘পক্কা’ বা ‘শূন্য থেকে শুরু’। আওয়ামী লীগ আবার ২০১৪ বা ২০১৮ সালের মতো ছক্কা মারতে গেলে এবার পক্কা হবে বলে সতর্ক করেন এ নেতা। বর্তমানে সেই নেতা জেলে আর নিশ্চিত জয়ের পথে আওয়ামী লীগ। দলের নিশ্চিত বিজয়ের এ ধারণা পাওয়া যায় নির্বাচনে অংশ নেওয়া দল ও নেতাদের দিকে তাকিয়ে। এদের মধ্যে আছেন সরাসরি নৌকা নিয়ে মাঠে নামা আওয়ামী লীগের (৩০০-৩২=) ২৬৮ প্রার্থী। এর মধ্যে আইনি জটিলতায় দু-একজন হয়তো মাঠে নেই বা থাকবেন না। এ প্রার্থীদের সঙ্গে থাকবেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত জাতীয় পার্টির ২৬ জন, যাদের প্রতীক লাঙল। এ জাতীয় পার্টির দুই শতাধিক নেতা আছেন যারা লাঙল নিয়ে নির্বাচন করলেও তাদের প্রতি আওয়ামী লীগের সমর্থন নেই। জাতীয় পার্টি এখন যেন আপন ভাই আর সৎ ভাইয়ের এক সংসার। জাতীয় পার্টি যেন এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে দামি দল, যাদের অন্য দল আসন ছাড়লেও তারা কোনো আসন স্বেচ্ছায় ছাড়ে না। তাই তো তারা দাম্ভিকতার সঙ্গে বলতে পারে, আওয়ামী লীগ কেন ২৬ আসন ছেড়েছে তা তারাই জানে, জাতীয় পার্টি জানে না। তবে তাদের এ দাম্ভিকতা নির্বাচনের পর কতটুকু থাকবে সেই প্রশ্ন উৎসুক জনতার।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ আরও ছয় আসনে নৌকার মাঝি এনেছে অন্য দল থেকে। এর মধ্যে তিনজন জাসদ (ইনু), দুজন ওয়ার্কার্স পার্টি (রাশেদ খান মেনন) ও একজন জাতীয় পার্টি (মঞ্জু) থেকে এসেছেন। এর বাইরে জাসদ (ইনু) ও ওয়ার্কার্স পার্টির (মেনন) বেশ কজন লড়বেন তাদের দলীয় প্রতীক যথাক্রমে মশাল ও হাতুড়ি হাতে। এ ক্ষেত্রে একই সংসারে আপন ভাই আর দেবরের মধ্য কে আপন আর কে পর, সেই প্রশ্ন উঠেছে। আরও প্রশ্ন উঠেছে, এ ছয়টি আসনে নৌকার বিরুদ্ধে আওয়ামী সমর্থনে স্বতন্ত্র প্রার্থী কেন?

এর বাইরে আওয়ামী লীগের নৌকা পাওয়ার জন্য যারা আবেদন করেছিলেন তাদের একটা অংশ দলীয় নির্দেশ ও পৃষ্ঠপোষকতায় স্বতন্ত্র হয়ে লড়ছেন। এদের অধিকাংশই ঈগল কিংবা ট্রাক বেছে নিলেন কার ইশারায় সেটাও প্রশ্ন। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, দলীয় সবুজ সংকেত যদি না-ও মিলত, এমনকি উল্টো নিষেধ করলেও তাদের অনেকেই নির্বাচনে নৌকার বিরুদ্ধে লড়তেন। আর তাদের লুফে নিতেন স্থানীয় কিছু মানুষ ও আওয়ামীবিরোধী শক্তি। এ জন্য অনেককে বহিষ্কারও হতে হতো। তবে এবার নৌকা যেন বিপরীত স্রোতে। নৌকার চাওয়া, এ স্বতন্ত্ররাও বিপুল ভোটারের উপস্থিতি ঘটিয়ে নির্বাচনে থাকুক। বিরোধী দলবিহীন হলেও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হয়েছে তা প্রমাণ করাই এ উদ্যোগের উদ্দেশ্য, তা প্রকাশ্যে বলছেন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। এ যেন একই সংসারে দুই পুত্র, যে সংসারে বেশি টাকা ঢালে সে-ই ভালো। এতকিছুর পরেও নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি কেমন হবে এ প্রশ্নের উদ্রেক করেছে সাম্প্রতিককালে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ও সহিংসতার ঘটনা।

২০২৩ সালের ২৩ জুলাই কম্বোডিয়ার সাধারণ নির্বাচনের কথা বর্তমান প্রেক্ষাপটে আলোচনায় এসেছে বারবার। এ নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল ৮৪.৫৯ শতাংশ। হুন সেনের ক্ষমতাসীন কম্বোডিয়ান পিপলস পার্টি (সিপিপি); ভোটের ৮২.৩০ শতাংশ ও ১২৫টি আসনের মধ্যে ১২০টি আসন লাভ করে। এর আগে ২০২২ সালের ১৫ মে ২৫টি প্রভিন্সে অনুষ্ঠিত স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনের ফলাফলের ভিত্তিতে ক্ষমতাসীন দল এ মর্মে মূল্যায়ন করে যে, এমন পরিস্থিতিতে ২০২৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় নির্বাচনে তারা (ক্ষমতাসীন সিপিপি) ১০৪ আসন পাবে, যা মোট ১২৫টি আসনের ৮৪.২ শতাংশ। অন্যদিকে তাদের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ক্যান্ডেল লাইট পার্টি জিতবে ২১ আসনে, যা মোট আসনের ১৬.৮ শতাংশ। কিন্তু নাটকীয়ভাবে তেমনটি ঘটার রাস্তা বন্ধ হয়ে যায় ২০২৩ সালের ১৫ মে, অর্থাৎ ২০২২ সালের স্থানীয় নির্বাচনের এক বছর পর এবং ২০২৩ সালের সাধারণ নির্বাচনের দুই মাস আগে। এসময় যথাযথভাবে নথিপত্র জমা প্রদান না করার অজুহাতে কম্বোডিয়ার নির্বাচন কমিশন ক্যান্ডেল লাইট পার্টির নিবন্ধন বাতিল করে। ফলে ভোটের মাঠে থাকে ২২১ আসন পাওয়া ক্ষমতাসীন সিপিপি এবং চার আসন পায় ১৯৮১ সালে প্রতিষ্ঠিত ন্যাশনাল ইউনাইটেড ফ্রন্ট ফর এন ইনডিপেন্ডেন্ট, নেচারাল, পিসফুল অ্যান্ড কো-অপারেটিভ কম্বোডিয়া যা স্থানীয়ভাবে ফানসিনপ্যাক নামে অধিক পরিচিত। তাই বারবার উঠে আসছে একটি প্রশ্ন- বাংলাদেশেও কি কম্বোডিয়ার মতো কিছু ঘটছে?

কম্বোডিয়ায় ২৩ জুলাই ২০২৩ তারিখের নির্বাচনের পরদিনই আমেরিকার স্টেট ডিপার্টমেন্টের বহুল আলোচিত মুখপাত্র মাথিও মিলার ঘোষণা করেন, কম্বোডিয়ায় অনুষ্ঠিত এ নির্বাচন অবাধ ও যথাযথ (ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার) হয়নি। এ কারণে আমেরিকা গণতন্ত্রকে নস্যাৎ করেছে এমন ব্যক্তিদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে এবং বিদেশি সাহায্যপুষ্ট বেশকিছু প্রকল্পে সহায়তা প্রদান স্থগিত করে। এক মাসের মধ্যে ৩৮ বছরের শাসক হুনছেন পদত্যাগ করেন এবং তার পুত্র হুন মানেদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। তাই তো প্রশ্ন জেগেছে আমেরিকার মনে আসলে কী আছে?

বাংলাদেশে আসন্ন দ্বাদশ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ লড়ছে ২৬৮ আসন পাওয়ার লক্ষ্যে। জিতে আসাদের পরিচয় হবে সরাসরি আওয়ামী লীগ এমপি রূপে। কিন্তু যারা এ ক্ষেত্রে পরাজিত হবে তাদের নিয়ে বেশকিছু প্রশ্ন উত্থাপিত হবে। কারণ বিএনপি, জামায়াত বা আওয়ামী বিরোধীদের কাছে তারা হারবে না, তারা হারবে আওয়ামী লীগেরই অপেক্ষাকৃত বেশি জনপ্রিয় ও তৃণমূলে গ্রহণযোগ্য স্বতন্ত্র অথবা আওয়ামী লীগ সমর্থিত সমমনা দলের প্রার্থীদের কাছে। এর ফলে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক বিশেষত মনোনয়ন বোর্ডের স্বচ্ছতা, প্রজ্ঞা ও মনোনয়ন প্রক্রিয়া হয়তো বড় প্রশ্নের সম্মুখীন হবে। দীর্ঘদিন ধরে গণমাধ্যম বলেছে, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা, বেসরকারি জরিপ প্রতিষ্ঠান, যুব ও ছাত্র সংগঠন এবং দলীয় প্রধানের ব্যক্তিগত স্টাফদের মাধ্যমে পরিচালিত জরিপের সব রিপোর্টের ভিত্তিতে সঠিক প্রার্থী নির্বাচন করা হবে। তৃণমূলের গ্রহণযোগ্যতা প্রতিফলিত হবে প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে। এখন নিজ দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে দলীয় মনোনয়নপ্রাপ্তদের হার প্রমাণ করবে এসব ছিল কথার কথা বা সান্ত্বনা মাত্র। আরও প্রশ্ন উঠবে, এসব জরিপের পেছনে কত অর্থ, মেধা ও শ্রম জড়িত ছিল এবং তা কে কীভাবে ব্যয় করেছে। আবার মাঠে থাকা জাতীয় পার্টি, জাসদ (ইনু), ওয়ার্কার্স পার্টি (মেনন) ও জেপি (মঞ্জু)-এর ৩২ জন প্রার্থীর আসন থেকে নৌকা সরানো হয়েছে। সেখানকার দুটি আসনে প্রথম থেকেই আওয়ামী লীগের প্রার্থীর নাম ঘোষণা করা হয়নি। বাকি ৩০টিতে ৩০ জন নৌকার মাঝি ছিল, যারা মনোনয়ন পেয়ে মাঠে নামলেও নদীর জল ও চোখের জল এক করে দলীয় নির্দেশে নিজেদের নৌকা সরিয়েছেন অন্যান্য নৌকা ঘাটে ভিড়ার সুযোগ দিতে। এ ৩২ জনের কেউ যদি এখন স্বতন্ত্রদের সঙ্গেই হেরে যায়, তবে তাদের গ্রহণযোগ্যতা, মানমর্যাদা ও ভবিষ্যৎ কোন তলানিতে ঠেকবে সেটাও বিরাট প্রশ্ন? তাদের অনেকেরই হয়তো রাজনীতি অঙ্গনে মুখ দেখানোর উপায় থাকবে না। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ কোন ধরনের দল আর কোন ধরনের নেতাদের নিয়ে জোটের রাজনীতি করে এবং জোটের অতিথি পাখিদের গ্রহণযোগ্যতা ও মানমর্যাদা কোন পর্যায়ের বা কোন শ্রেণি, সে প্রশ্নও উঠবে। এমনিতেও বলা হয়, জোটে এমন নেতারাও আছেন, যাদের একটি সাধারণ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, এমনকি মেম্বার হওয়ারও যোগ্যতা নেই। এখন জোটভুক্ত ৩২ জন প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোট এ কথাটি সঠিক বা ভুল প্রমাণিত করবে কী- সেই প্রশ্নও সামনে এসেছে।

এবারের নির্বাচনে কোনো প্রকার কারসাজি বা অনিয়ম করার বড় রকম মাশুল গুনতে হবে খোদ আওয়ামী লীগকেই। কোনো কারণে আওয়ামী লীগের অথবা জোটের কেউ নির্বাচনে হারলেই অনিয়মের অভিযোগ আনবেন- এটাই স্বাভাবিক। আর যারা এ অভিযোগটা আনবেন তারা স্বতন্ত্র হলেও আওয়ামী লীগেরই কেউ অথবা স্বতন্ত্রের কাছে যারা হারবেন তারাও আওয়ামী লীগ ও জোটের মনোনয়ন পাওয়া প্রার্থী। সুতরাং তারা যা বলছেন তা আওয়ামী লীগের বা জোটের দলীয় মানুষের বক্তব্য বলেই প্রচারিত হবে না, কোনো বিরোধী দলের বক্তব্য নয়।

সুতরাং গণমাধ্যম ও বিশ্ববাসী বিশেষত যারা বাংলাদেশের ওপরে কোনো প্রকার নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য মুখিয়ে আছে, তাদের কাছে এ বক্তব্য একটি মোক্ষম অস্ত্র হয়ে ধরা দেবে না তো?

নির্বাচন-পরবর্তী সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের আগাম বার্তা দিয়েছে চীনের রাষ্ট্রদূত। প্রতিবেশী ভারত ও রাশিয়া অনতিবিলম্বে সমর্থন দেবে বলে আশা করা যায়। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আনুগত্যের ঘাটতি পড়ার কোনো সম্ভাবনা দৃশ্যমান নয়। সে ক্ষেত্রে রাজপথে বিরোধী দলের কৌশল কী হবে, তাদের আটক নেতা-কর্মীদের কী ভবিষ্যৎ কিংবা ২০০৮, ২০১৪, ২০১৮ সালের চারটি নির্বাচনের নির্বাচন সামনে পেয়েও দলকে নেওয়ার মতো আন্দোলন গড়ে তুলতে ব্যর্থতার দায়ে কেউ নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়াবেন কি? এমন অনেক অজানা প্রশ্ন রেখেই বিদায় নেবে ২০২৩। তাই অনেকের মতো আমারও প্রশ্ন, কেমন যাবে ২০২৪ সাল?

লেখক : গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট

Email: [email protected]

সর্বশেষ খবর