শুক্রবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

সাধারণ মানুষকে আমলি বানানোর সহজ উপায়

আল্লামা মাহ্‌মূদুল হাসান

যখন মসজিদে আজান হয় তখন সাধারণ মানুষ তো বটেই অনেক ইমাম সাহেবও কথাবার্তায় লিপ্ত থাকেন, আজানের মতো মহামূল্যবান আমলের জবাব দেন না। ফলাফল যা হওয়ার তাই হচ্ছে। ইমামের প্রতি মুসল্লিদের ভক্তি-শ্রদ্ধা কমে যাচ্ছে কিংবা উঠে যাচ্ছে। ইমাম সাহেব যদি আজানের সময় কোনো কথা না বলে আজানের জবাব দিতে থাকেন আর মুসল্লিরা তা দেখেন, তাহলে মুসল্লিদের অন্তরে স্বাভাবিকভাবেই এর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে। ইমাম সাহেবের বলতে হবে না যে, মুসল্লি সাহেব! আজানের জবাব দেন।

পার্থিব জীবনের সময়ের মূল্য মানুষের দুনিয়া ও আখেরাতের সফলতার জন্য যে সময়টুকু প্রয়োজন আল্লাহপাক ততটুকুই তাকে দান করেন। এর চেয়ে কম বা বেশি দেন না। যে ব্যক্তি অযথা সময় নষ্ট করবে, সময় কাজে লাগাবে না সে আখেরাতের উন্নতিতে ততটুকু পিছিয়ে পড়বে। তাই সময় নষ্ট না করে সময়কে কাজে লাগানো উচিত। জীবন থেকে একটি মিনিট চলে যাওয়া মানে একটি বছর চলে যাওয়ার সমান। পূর্বেকার বুজুর্গানে দীন সময়ের যথাযথ মূল্যায়ন করতেন। অযথা সামান্য সময়ও নষ্ট করতেন না। কাজ না থাকলে সময়টাকে তারা জিকিরের হালতে ব্যয় করতেন। হজরত গাংগুহী (রহ.) প্রতিদিন এক লক্ষবার ‘আল্লাহ’ ‘আল্লাহ’ জিকির করতেন। তাদের সময়ে বরকত হতো। হজরত হারদুঈ বলতেন, হে আলেম সমাজ! তোমরা যদি বেশি ব্যস্ত থাক, তাহলে দিনে কমপক্ষে ২৪ হাজারবার আল্লাহ আল্লাহ জিকির কর। দুঃখজনক অবস্থা আমরা মনে করি, হায় আল্লাহ! এতবার পড়ার সময় কোথায়! অথচ আমাদের বহু সময় চলে যায় অনর্থক কথাবার্তা বলে কিংবা ঘুমিয়ে। আমাদের অনেক আলেম, ইমাম, মুয়াজ্জিনের অবস্থা তো এমন হয়েছে যে, সাধারণ মুসল্লি এসে তাদের ফজরে ঘুম থেকে ডেকে তোলে। এখন আপনারাই বলুন, যে ওস্তাদকে ছাত্র ঘুম থেকে জাগায়, যে ইমামকে মুসল্লি ডেকে তোলে, সেই ওস্তাদ ও ইমামের প্রতি ছাত্রের ও মুসল্লির কী ভক্তি জন্মাবে? ওস্তাদ তো নিজেই নৈতিকভাবে দুর্বল, সুতরাং তিনি ছাত্রকে এসলাহ করবেন কীভাবে? ইমাম তো নিজের আমল নিয়েই লজ্জিত, মুসল্লিকে আমলের কথা কীভাবে বলবেন? যারা সর্বদা জিকরুল্লাহর মাধ্যমে স্বীয় অন্তরকে সজীব রাখবেন তাদের অন্তর আল্লাহপাকের মারেফাত ও মহব্বতে সিক্ত হয়ে থাকবে। আল্লাহর জিকিরের মধ্যে বড়ই মধুরতা রয়েছে। যে নিয়মিত জিকির করে তার কাছে আল্লাহর জিকির দুনিয়ার বাদশাহী থেকেও শতগুণ উত্তম মনে হয়। আমাদের দেশে একদল লোক আছে যারা বলে, শুধু ‘আল্লাহ’ ‘আল্লাহ’ জিকির করা জায়েজ নেই, বরং বেদআত। কারণ, তাতে আরবি ব্যাকরণিক কোনো মুবতাদা খবর নেই। আমি বলি, যারা এসব কথা বলে তারা দাঁতবিহীন মানুষ। আর যারা দাঁতবিহীন মানুষ তারা শিশু। শিশুর কথা তো অগ্রহণযোগ্যই হয়।

যারা বলে, ‘আল্লাহ’ ‘আল্লাহ’ জিকির বেদআত, তাদের কথা অনুযায়ী ছোট বাচ্চাদের ‘আম্মা’ ‘আম্মা’ শব্দ বলাও বেদআত। কারণ, এতেও মুবতাদা খবর নেই। মা যখন ‘আম্মা’ শব্দ শোনে, তখন পাখির মতো উড়াল দিয়ে বাচ্চার কাছে চলে আসেন এবং বুকে তুলে নেন। ঠিক তদ্রƒপ কোনো বান্দা যখন অবুঝ শিশুর মতো ‘আল্লাহ’ ‘আল্লাহ’ শব্দ পড়েন তখনো সেখানে মুবতাদা- খবরের প্রয়োজন হয় না। আল্লাহর প্রেম ও মহব্বত তাদের বুকে জড়িয়ে ধরে, তাদের অন্তরে আল্লাহর প্রেমের ঢেউ খেলে ওঠে। যারা আল্লাহর পাগল হয়ে যায় তাদের জিকিরের সময় পূর্ণ বাক্যের প্রয়োজন হয় না। তারা যখন ‘আল্লাহ’ শব্দ মুখ থেকে বের করেন তখনই আল্লাহ তাদের মনের অনুভূতি বুঝে ফেলেন এবং আপন রহমতের ছায়াতলে তাদের স্থান দেন।

যারা আল্লাহর প্রিয় মাহবুব তাদের জন্য ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এর জিকির বড়ই প্রিয়। তবে যারা আল্লাহর অতি মুকাররব হয়ে যায় তাদের এত লম্বা কথা বলার ধৈর্য থাকে না। তারা প্রিয় মাহবুবের নাম সংক্ষেপে উচ্চারণ করতে ভালোবাসে। যার দরুন তারা মুবদাতা খবর ছাড়া ‘আল্লাহ’ ‘আল্লাহ’ জিকির করেন। আগুন যেমন পানির দ্বারাই ঠাণ্ডা হয়ে যায় ঠিক তেমনি যারা আল্লাহর মাহবুব হয় তাদের অন্তরের আগুন অন্য কিছু দ্বারা শীতল হয় না, একমাত্র ‘আল্লাহ’ ‘আল্লাহ’ জিকিরের দ্বারাই শীতল হয়। হাদিসে এসেছে, যারা আমার প্রেমে ডুবে পাগলপারা হয়ে যায় আমি তাদের সুন্দর বাক্যের প্রতি তাকাই না। আমি জানি এরা আমার জন্য পাগল হয়ে গেছে। এরা আগে পিছে বাদ দিয়ে যাই বলুক তা আমার কাছে ভালো লাগে।

আল্লাহর সঙ্গে বিশেষ সম্পর্কের এক ঘটনা এক বুজুর্গের কথা প্রসিদ্ধ আছে যে, উক্ত বুজুর্গের দেশের লোকেরা একবার বৃষ্টির জন্য হাহাকার করছিল। তারা বিশ্বাস করত যে, বুজুর্গ দোয়া করলে আল্লাহ বৃষ্টি দেবেন। তাই সবাই মিলে ওই বুজুর্গের কাছে আবেদন করল, হুজুর! দোয়া করুন, যাতে আল্লাহপাক বৃষ্টি দান করেন। বুজুর্গ উত্তর দিলেন, ‘আমার ও আল্লাহর মধ্যে বর্তমানে সম্পর্ক ভালো নেই। তাই আমি দোয়া করলে তিনি বৃষ্টি দেবেন না।’ এরকম কথা যদি আমি বলি, তাহলে আপনারা তো সরাসরি আমাকে কাফের ফতোয়া দিয়ে দেবেন। এ জন্যই মুফতি সাহেবদের বলা হয়েছে যে, এরকম কথা আল্লাহর ওলির ক্ষেত্রে হলে জাহেরি বাক্যের ওপর ফতোয়া না দিতে। যারা বুজুর্গ, আল্লাহর ওলি, তাদের কথার মধ্যে অনেক ইশারা থাকে। তাদের কথা সবাই বোঝে না। যাই হোক লোকেরা খুব পীড়াপীড়ি করে বলতে লাগল, আপনি যাই বলুন, আপনাকে দোয়া করতেই হবে। অগত্যা বুজুর্গ বললেন, তাহলে তোমরা একটি কাজ কর আমার একটি জামা আছে তা ধৌত করে রৌদ্রে শুকিয়ে নিয়ে আস। আমি সেই জামা পরিধান করে আল্লাহর কাছে দোয়া করব।

এটি কেমন কথা হলো! আল্লাহর সঙ্গে যার সম্পর্ক নেই তার আবার ধৌত কাপড় পরিধান করে দোয়া করার কী প্রয়োজন? যাই হোক লোকেরা তাঁর কথামতো জামা ধৌত করে যেই রোদে শুকাতে দিল সঙ্গে সঙ্গে মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। লোকেরা দৌড়ে এসে বুজুর্গ সাহেবকে সংবাদ দিল, হুজুর! বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। বুজুর্গ বললেন, দেখলে তো তোমরা, আল্লাহর সঙ্গে আমার সম্পর্ক কেমন? দীর্ঘদিন বৃষ্টি নেই, কিন্তু আজ আমি আমার জামা শুকানোর জন্য দিলাম আর তিনি বৃষ্টি দিয়ে আমার জামা ভিজিয়ে দিলেন।

আল্লাহর কুদরত বোঝা যেমন দুষ্কর তেমনি আল্লাহর ওলিদের কথা বোঝাও বড় মুশকিল। বুখারি শরিফের হাদিসে এসেছে, ‘দুনিয়ার মধ্যে এমন অনেক ওলি রয়েছেন, যাদের কথার ব্যতিক্রম আল্লাহ করেন না। কোনো সময়ে কোনো ব্যাপারে যদি তারা আল্লাহর সিদ্ধান্তের বিপরীত কসম খেয়ে বসেন তাহলেও আল্লাহপাক তাদের কথাকে (কসমকে) ঠিক রাখেন নিজের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে। আল্লাহর ওলিদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য যারা আল্লাহর ওলি হন তাদের অন্তর ও জবান থেকে সব সময় আল্লাহর নাম বের হতে থাকে অনায়াসে। মানুষের শরীরের রগ রেশা দিয়ে কী পরিমাণ রক্ত চলাচল করে তা মানুষ উপলব্ধি করতে পারে না। তদ্রƒপ আল্লাহর ওলিগণ আল্লাহর নাম প্রতিদিন হাজার ও লক্ষবার উচ্চারণ করে থাকেন, যা আমাদের স্বাভাবিক বুদ্ধিতে বুঝে আসে না, এমনকি যখন তারা কথাবার্তা ও ওয়াজ-নসিহত করতে থাকেন তখনো কলব থেকে তা অটোমেটিক উচ্চারণ হতে থাকে। মুখে পড়তে হয় না। যদি কেউ চায় যে, আল্লাহপাক তার দিকে তাকিয়ে থাকুক, তাহলে তাকে জিকির করতে হবে। কারণ কোরআন থেকে সরাসরি বোঝা যায় যে, বান্দা যখন আল্লাহকে স্মরণ করে তখন আল্লাহ তাকে স্মরণ করেন। আমার দিকে তাকাও, আমিও তাকাব।

এখন কেউ যদি প্রশ্ন করে যে, সারা দুনিয়ার ১ কোটি মানুষ একসঙ্গে জিকির করলে আল্লাহর মনোনিবেশ এদের মধ্যে কার দিকে হবে? এ প্রশ্নের উত্তর প্রয়োজন পড়ে না। কারণ মানুষ এবং আল্লাহর মধ্যে পার্থক্য তো এটাই যে, আমরা যখন কারও কথা শুনি, তখন শুধু তারটাই শুনি, অন্যেরটা শুনতে পারি না। কিন্তু আল্লাহপাক একসঙ্গে কোটি কোটি বান্দার কথা শুনতে পান। ওপরে, নিচে, অন্ধকারে যা কিছু আছে সবকিছু দেখতে পান। এটাই তাঁর ইলাহ তথা মাবুদ হওয়ার বৈশিষ্ট্য।

লেখক : আমির, আল হাইআতুল উলয়া ও বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ

সর্বশেষ খবর