রবিবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

আইপিআরএসে মাছ চাষে বিদ্যুৎ খরচ অর্ধেকে এনেছে চীন

শাইখ সিরাজ

আইপিআরএসে মাছ চাষে বিদ্যুৎ খরচ অর্ধেকে এনেছে চীন

এ সময়টাকে আমূল পাল্টে দিয়েছে প্রযুক্তির বিকাশ। বিশেষ করে কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার উৎপাদন ব্যবস্থায় এনেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। ফসল কৃষির পাশাপাশি মৎস্য, পোলট্রি এবং গবাদি প্রাণী লালনপালন ব্যবস্থাপনাকে এনেছে শিল্পের কাতারে। মাছ চাষের সর্বাধুনিক একটি প্রযুক্তি ইন-পন্ড রেসওয়ে সিস্টেম বা আইপিআরএস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে উদ্ভাবিত হয়েছে। মাছ চাষের ক্ষেত্রে পুকুরের পরিবেশ, বর্জ্য সমস্যা এবং অক্সিজেন ও খাদ্যের সুষম বণ্টনের একটি প্রযুক্তিগত ব্যবস্থাপনা। এর মাধ্যমে আধুনিক যন্ত্রপাতি, বিদ্যুৎ ও কৌশল ব্যবহার করে স্বল্প জায়গায় অনেক বেশি পরিমাণে মাছ চাষ হচ্ছে। পরিবেশের ক্ষতি না করে গুণগত মান বজায় রেখে অধিক ঘনত্বের মাছ উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে বলে সারা পৃথিবীতেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে আইপিআরএস। আমেরিকায় উদ্ভব হলেও চীন আইপিআরএসকে অনেকটাই সহজলভ্য করে তুলেছে। স্বল্পমূল্যের যন্ত্র তৈরিতে চীনের সুখ্যাতি আগে থেকেই। গত অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে চীনের সাংহাইয়ে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল চীনের মাছ চাষের আধুনিক প্রযুক্তি সম্পর্কে ধারণা নিতে। সেখানে সাক্ষাৎ হয় টাইগার নামের এক তরুণ উদ্যোক্তার সঙ্গে। সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ সরবরাহের মাধ্যমে অ্যারেটর বা ব্লোয়ার সচল রাখতে হয় বলে আইপিআরএসের বড় একটি খরচ বিদ্যুৎ খাতে। উদ্যোক্তা টাইগার তার আইপিআরএসে ব্যবহার করছেন বিশেষ ধরনের মোটর। টাইগার আমাকে বিশেষ এ মোটর সম্পর্কে ধারণা দিতে নিয়ে গেলেন চীনের প্রকৌশলী স্টিভেনের কাছে। স্টিভেন বললেন, ‘কম সময়ে অধিক উৎপাদন করতে চাইলে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করতেই হবে। কিন্তু প্রযুক্তির একটিই সমস্যা। সেটি হলো বিদ্যুৎ। বিদ্যুৎ বা জ্বালানি ছাড়া কোনো যন্ত্রই কাজ করবে না। আইপিআরএস হচ্ছে মাছ চাষের আধুনিক প্রযুক্তি। আমরা চীনসহ সারা বিশ্বে ১ হাজারের ওপর আইপিআরএস প্রযুক্তির খামার স্থাপন করে দিয়েছি। বেশ ভালো মাছ উৎপাদন হচ্ছে সেগুলোতে। কিন্তু খামারিদের একটিই প্রশ্ন, বিদ্যুৎ খরচ কীভাবে কমানো যায়? এ সমস্যা সমাধানের জন্য আমরা কাজ করেছি পুরো দুটি বছর। শেষে আমরা সফল হয়েছি। আইপিআরএসে মাছ চাষের দুটি চ্যালেঞ্জ। এক. বিদ্যুতের সাহায্যে সব সময় কৃত্রিম প্রবাহ চালু রাখা। দুই. বিশ্বব্যাপী বিদ্যুতের দাম বছর বছর বেড়ে যাচ্ছে। আমরা এই দুই চ্যালেঞ্জকে একটি যন্ত্রের মাধ্যমে সমাধান করতে চেয়েছি। অবিরত বিদ্যুৎ প্রবাহ চালু রাখা কী করে সম্ভব? যে কোনো কারণেই জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ বন্ধ থাকতে পারে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। তখন কী হবে? নির্দিষ্ট সময়ের পর অ্যারেটার না চললে, অক্সিজেন প্রবাহ বন্ধ থাকলে মাছ তো সব মরে যাবে! এ জন্য আমরা এক ধরনের ডিসি মোটর তৈরি করেছি যাতে বিদ্যুতের খরচ কমে আসবে অভাবনীয়ভাবে। আর এটি একই সঙ্গে বিদ্যুৎ, ব্যাটারি কিংবা সৌরবিদ্যুতেও চালাতে পারবে। সবচেয়ে বড় কথা নতুন ব্লোয়ারটি আগের ব্লোয়ারের মতোই কাজ করবে কিন্তু বিদ্যুৎ খরচ হবে আগের চেয়ে অর্ধেক। আগে একটি মোটরে বিদ্যুৎ খরচ হতো ঘণ্টায় ২.২ কিলোওয়াট। সেই একটি মোটরের বদলে এখন ২টি ডিসি মোটর ব্যবহার করতে হবে। এতে প্রতিটিতে ঘণ্টায় ০.৫ কিলোওয়াট করে দুটিতে খরচ হবে ১ কিলোওয়াট। আবার এর ভিতরে একটি চিপ বসানো আছে। যেটি মোবাইল ফোনেই চালু অথবা বন্ধ করা যায়। স্মার্ট টেকনোলজি।

আমি জানতে চাইলাম, আগের একটি এসি মোটরের জায়গায় এখন দুটি ডিসি মোটর ব্যবহার করতে হবে। বিদ্যুৎ খরচ না হয় কমল, কিন্তু দুটি মোটর কিনতে তো বেশি খরচ হবে! টাইগার জানালেন, এই মোটরগুলো এসি মোটরের তুলনায় দাম কম। তারপর সারা বছর যে পরিমাণ বিদ্যুৎ খরচ বাঁচানো যায়, সে তুলনায় এ খরচ খুব একটা বেশি নয়। বাংলাদেশে প্রথম আইপিআরএস স্থাপন করেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের আকবর হোসেন। তিনি তুলে ধরেছিলেন আইপিআরএসে মাছ চাষের সমূহ সম্ভাবনার কথা। পাশাপাশি বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের কথাও তিনি তুলে ধরেন। বলেছিলেন, বিদ্যুৎ খরচটা অনেক ক্ষেত্রে উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে দেয়। এ সময়ে দেশের অনেক উদ্যোক্তাই যুক্ত হচ্ছেন আইপিআরএসের মাছ চাষে। সে ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ সাশ্রয় করে উৎপাদন খরচ কমাতে পারলে উৎপাদক ও ভোক্তা দুই শ্রেণিই লাভবান হবেন। উদ্যোক্তা টাইগার বলছেন, এই রিজেনারেটিভ ডিসি মোটর উৎপাদন খরচ কমিয়ে এনেছে দারুণভাবে। টাইগারের কাছে জানতে চাই, আইপিআরএসের সম্ভাবনা কতটুকু? মাছ চাষের ক্ষেত্রে এটি আসলে কতটা প্রভাব ফেলতে পারে? টাইগার বলেন, যদি সত্যিকার অর্থেই খাদ্য নিরাপত্তা ও ‘নিরাপদ খাদ্য’ দুটিকে একসঙ্গে ভাবতে চাইলে প্রযুক্তির ব্যবহার না করে সেটা দুঃসাধ্য একটি ব্যাপার হবে। শুধু প্রকৃতির ওপর নির্ভর করেই বেশি উৎপাদন সম্ভব নয়। বিশাল জনসংখ্যাকে না খাইয়ে রাখার মতো চ্যালেঞ্জ নেওয়ার সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে অবশ্যই প্রযুক্তির মাধ্যমে উৎপাদনে আসতে হবে। আমরা দেখেছি বেশি পরিমাণে মাছ চাষ করতে গিয়ে ফসলি জমিতে পুকুর হয়েছে, বছরের পর বছর পরিবেশের কতটা ক্ষতি হয়েছে। এর একটি বিজ্ঞানসম্মত সমাধান আইপিআরএস। আইপিআরএসের বড় একটি প্রতিবন্ধকতা ছিল বিদ্যুতের খরচ। সেটিকে কমিয়ে আনার জন্য আমি এখানে ডিসি মোটর ব্যবহার করছি। বিদ্যুৎ খরচ একেবারে অর্ধেকে নেমে এসেছে।

আর একটি বিষয় হচ্ছে, চীনে দিনের বেলায় বিদ্যুতের দাম বেশি। রাতে কম। তাই টাইগাররা রাতের বিদ্যুৎ ব্যাটারিতে সঞ্চয় করে দিনে চালাচ্ছে। টাইগারের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি, তারা আইপিআরএসে মাছ চাষের একটি বড় প্রকল্প হাতে নিয়েছে। সেটির কাজ চলছে। গত দুই বছরে পুরো চীনের প্রায় ১ হাজারের মতো আইপিআরএস স্থাপন হয়েছে। শুধু আইপিআরএসেই নয়, অক্সিজেন সরবরাহ বা অ্যারেটর কিন্তু সাধারণ পুকুরে মাছ চাষের ক্ষেত্রেও ব্যবহার হয়। বিদ্যুৎ খরচ কমাতে তারাও এ মোটর ব্যবহার করতে পারেন। এর মাধ্যমে যে শুধু বিদ্যুৎ খরচ কম হচ্ছে তা শুধু নয়। একই সঙ্গে রিচার্জেবল ব্যাটারি বা আইপিএস, সৌর বিদ্যুৎ এমনকি উইন্ডমিলের বিদ্যুৎ ব্যবহার করা যায়। যন্ত্রটি এমনভাবে প্রোগ্রাম করা যে, পাওয়ার গ্রিড না পেলে সেটি ব্যাটারির বিদ্যুৎ ব্যবহার করবে, যদি সেটিও না পায় তবে সৌরবিদ্যুৎ বা উইন্ডমিল থেকে পাওয়া বিদ্যুৎ সে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিতে পারে। টাইগার জানালেন সৌর বিদ্যুৎ ও উইন্ডমিল ব্যবহার করে বিদ্যুৎ খরচ একেবারে শতকরা ৯০ ভাগ কমিয়ে এনেছে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের আকবর হোসেনও আইপিআরএসের যন্ত্র নিয়েছেন টাইগারের প্রতিষ্ঠান থেকে। ফোনে টাইগারের সঙ্গে কথা বলিয়ে দিই আকবর হোসেনের সঙ্গে। আকবর বলেন, যদি বিদ্যুৎ খরচ কমিয়ে ফেলা যায় তবে এটি আমাদের দেশে খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠবে। আকবর সাহেবের প্রতিবেদন ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’-এ প্রচারের পর অনেক লোক তার প্রকল্পটি দেখতে গিয়েছে। অনেকেই ইতোমধ্যে আইপিআরএসে মাছ চাষ শুরু করতে যাচ্ছে। বিদ্যুৎ খরচ কমিয়ে আনা গেলে আরও ব্যাপকহারে এর ব্যবহার বাড়তে পারে। আমাদের দেশে জায়গার তুলনায় জনসংখ্যা বেশি। ফলে আমাদের আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে কম জায়গায় বেশি উৎপাদনের দিকে যেতে হবে। আইপিআরএস পদ্ধতিতে মাছ চাষ শুরুতে বেশ ব্যয়বহুল। সবার জন্য এ প্রযুক্তি নয়। তবে অল্প জায়গায় গুণগতমানের অধিক মাছ চাষের জন্য এটি একটি আদর্শ পদ্ধতি। নদীমাতৃক বাংলাদেশে নদী-নালা, খাল, বিলসহ-উন্মুক্ত প্রাকৃতিক জলাশয় থাকলেও এসব থেকে মাছের উৎপাদন আগের তুলনায় অনেক কমে এসেছে। অন্যদিকে বর্ধিত জনসংখ্যার মুখে পুষ্টিকর খাদ্য তুলে দেওয়া এখনো আমাদের মূল চ্যালেঞ্জ। এসব বিবেচনায় এ ধরনের আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে আমাদের উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হবে। আবার অনেক ঝুঁকিতে থাকা মাছের প্রজাতিও রক্ষা করা যাবে। ফলে আমাদের দেশীয় প্রেক্ষাপটে নতুন প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা যেমন জরুরি, জরুরি প্রায়োগিক দিক থেকে এর সার্বিক বিচার-বিশ্লেষণও।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব

[email protected]

সর্বশেষ খবর