মঙ্গলবার, ২ জানুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

ইংরেজি নববর্ষ ও দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

ইংরেজি নববর্ষ ও দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন

২০২৪-এ আমরা পা রাখলাম। পরম করুণাময় আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, তিনি যেন ক্ষুধা জরা দুর্যোগ দুর্বিপাক থেকে নতুন বছর আলোয় আলোয় উদ্ভাসিত করেন। সব কালিমা সব মলিনতা ধুয়ে-মুছে যাক। ২০২৪ হোক আমাদের জন্য শ্রেষ্ঠ বছর। সেই কবে জন্মেছিলাম ব্রিটিশ ভারতে ইংরেজদের চলে যাওয়ার সময়। দেখতে দেখতে জীবন শেষ হয়ে এলো। আজ কদিন বড় বেশি মা-বাবার কথা মনে পড়ছে। কেন মনে পড়ছে বলতে পারব না। ঘুরেফিরেই কেন যেন ক্ষণে ক্ষণে মা এসে বুকের ভিতর হৃদয় মাঝে নাড়াচাড়া করেন। তাই ৩১ ডিসেম্বর ৩টায় গিয়েছিলাম বাবা-মার কবরে। মাঝেমধ্যেই যাই কবর জিয়ারত করি বেশ ভালো লাগে। দেহমন শীতল হয়ে আসে। কিন্তু ৩১ ডিসেম্বর মনে হয় একটু বেশি ভালো লেগেছে। সমস্ত অন্তরাত্মা জুড়িয়ে গেছে কবর জিয়ারত করে মোনাজাতে। সামনে একটা নির্বাচন, বাবা-মার দোয়া শ্রেষ্ঠ দোয়া। তাই গিয়েছিলাম তাদের কবরে। যাদের মাধ্যমে জগৎ দেখেছি, জগতের আলো দেখেছি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছি পরম দয়ালু আল্লাহ আমার বাবা-মাসহ সব আত্মীয়স্বজন এবং তামাম দুনিয়ার সবাইকে তিনি যেন বেহেশতবাসী করেন। সেখান থেকে দুই-তিন কিলোমিটারের মাঝে বল্লা করোনেশন হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজ। বাবাও ওই স্কুলে পড়েছেন। এই নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী বড়ভাই লতিফ সিদ্দিকীর ট্রাক মার্কার এক নির্বাচনি সভায় গিয়েছিলাম। এ যাবৎকাল বল্লা করোনেশন হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজ মাঠে অমন স্বতঃস্ফূর্ত লোকসমাগম দেখিনি। বল্লা একটি ঐতিহাসিক জায়গা। বহু বছর শাড়ি ও অন্যান্য কাপড় তৈরি হয়। বিপুল সম্পদশালী গ্রাম। পুরো না হোক অর্ধেক উপজেলা তাদের কিনে ফেলতে কখনো টাকায় টান পড়ার কথা না। মুক্তিযুদ্ধেও বল্লায় প্রথম যুদ্ধ হয়েছিল। সেখানে আমরা বিজয়ী হয়েছিলাম। আল্লাহ রসুলের দয়ায় জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও আমরা বিজয়ী হব- এমনটাই আমার আশা। ২০২৪-এর ১ জানুয়ারি নতুন বছরে ঘুম থেকে উঠেই শুনলাম বোন শেখ হাসিনা টাঙ্গাইলে ভিডিও কনফারেন্সে ভাষণ দেবেন। সে নিয়ে পৌর উদ্যানে মিটিংয়ের ব্যবস্থা। নিশ্চয়ই নির্বাচনি নীতিমালায় বেলা ২টার আগে মাইকে প্রচার নিষিদ্ধ। কিন্তু সকাল ৯টা থেকেই বিপুল বিক্রমে প্রচার চলছে। এই হলো নির্বাচনি আইনকানুন বিধিনিষেধ। আমার মনে করিয়ে দেওয়ার কথা তাই পাঠকের সামনে তুলে ধরলাম।

আর মাত্র পাঁচ দিন পর দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। তার তিন দিন প্রচার করা যাবে, দুই দিন কোনো প্রচার করা যাবে না। মোট কথা আর তিন দিন নির্বাচনি প্রচার। এবার খুব একটা বাইরে যাইনি। টাঙ্গাইলেই নিজের নির্বাচনি এলাকায় ব্যস্ত আছি। অনেক নতুন অভিজ্ঞতা হলো এই নির্বাচনে। মানুষ আগের চাইতে আমাকে নিয়ে উৎসাহী। কিন্তু একটা জিনিস কেন যেন বারবার মনে হয়েছে, কারও কাছেই কেমন যেন কোনো কাজের দাম নেই। সরকারি দল যাকে প্রার্থী করেছে সে আমাদেরই ছেলে। তার কথাবার্তা একেবারেই লাগামহীন। তার এবং তার সহকর্মীদের বোধ-বিবেচনায় এতটুকু নেই যে, কতটুকু কী বলতে পারে, কী বলতে পারে না। আওয়ামী লীগের ক্যান্ডিডেট সত্য, তাই বলে সে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে বলতে পারে না, স্বাধীনতার বিরুদ্ধে বলতে পারে না, সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করতে পারে না। কিন্তু নানাভাবে তাই-ই করে চলেছে। এটা খুবই দুঃখের, খুবই বেদনার। মজার ব্যাপার হলো- টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগে দ্বন্দ্ব আছে বিরোধ আছে, অন্য জায়গায়ও আছে। দ্বন্দ্ব ছাড়া কোনো বড় দল নেই। বিশেষ করে প্রাক্তন এমপি জোয়াহেরুল ইসলাম আর জয়ের মধ্যে। জয় একজন থানা পর্যায়েরও নেতা না। জোয়াহেরুল ইসলাম জেলার প্রধান নেতাদের অন্যতম জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। কয়েকদিন আগে জোয়াহেরুল ইসলামের এক সমর্থক কাশিলের বাদলকে গ্রেফতার করা হয়েছিল সরকারি দলের প্রার্থী এবং উপজেলা চেয়ারম্যানের প্রভাবে। জিনিসটা খুবই খারাপ হয়েছে। জাতীয় নির্বাচনে এর প্রচণ্ড প্রভাব পড়বে, পড়েছেও। মনে হয় মঙ্গলবার বা বুধবার কাশিলের বাদলকে গ্রেফতার করেছিল। আমার খুবই খারাপ লেগেছে তার দুই বা তিন দিন আগে থেকে সে গামছার জন্য কাজ করছিল। খোটার নিচ থেকে ঘরের চাল পর্যন্ত যেখানে যাকে যা বলা যায় বলেছিলাম। বাদলকে পরের রবিবার সসম্মানে জামিন দিয়েছে। এক অসাধারণ মানুষ বাদল। আজ এক সপ্তাহ কাশিল তো বটেই সারা বাসাইলকে ওরা তোলপাড় করে ফেলেছে। এমনিতে বাসাইলে সমর্থন আছে অনেক, এবার অন্যবারের চাইতে আমাকে বেশি সমর্থন দিয়েছে। তার মধ্যে আবার এই ঘটনা মারাত্মক রেখাপাত করেছে। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী আওয়ামী মনোনয়নপ্রাপ্ত এটা খুবই সত্য। কিন্তু বাসাইল-সখীপুরের আওয়ামী লীগ নৌকার প্রার্থীর পেছনে নেই। কেমন যেন গত কয়েক বছরে মানুষের ভোটের ব্যাপারটা একেবারে এলোমেলো করে ফেলা হয়েছে। আমি চেয়েছিলাম সুষ্ঠু স্বাভাবিক ভোট হোক। সরকারি দলের প্রার্থীরা জোর-জবরদস্তি করলে নেত্রীর বদনাম হবে। আর না করলে দু-একজন ছাড়া অন্য সব প্রার্থী জিতবে। জানি না আমার বোনকে কে কী বোঝায়। বর্তমানে যে আবহাওয়ার সৃষ্টি হয়েছে জাতীয় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তার সম্মান রক্ষা করতে হলে বিপুল ভোট কাস্ট হওয়া দরকার। সেটাই হবে তার জন্য সম্মানজনক। কিন্তু এখন পর্যন্ত তার কোনো আলামত দেখা যাচ্ছে না। নৌকার মনোনীত প্রার্থীরা অনেকেই মনে করছে দেশ উচ্ছনে যাক, সমুদ্রে তলিয়ে যাক, সে একা শুধু জিততে পারলেই হলো। সেটা ভোটে হোক আর বিনা ভোটে ঘোষণা দিয়েই হোক। বড় কষ্ট লাগে এসবের সঙ্গে কখনো পরিচয় ছিল না। নতুন পরিচিত হয়ে সত্যিই অনেকটা বিব্রতবোধ করি। জানি না আর মাত্র এই পাঁচ দিন কেমন যাবে। ভালো যাবে এটাই প্রত্যাশা করি। কদিন আগে রাতে ছিলাম কালিয়ানে। তার আগে কালিয়াপাড়া ঘোনারচালা। আরও আগে ফুলকী রাজ্জাকের বাড়ি। নাইকানবাড়ীও ছিলাম এক রাত। রাতগুলো বড় ভালো গেছে। সকালগুলো অসাধারণ। শত শত নারী-পুরুষ-শিশুর কলতানে সকালটা চমৎকার হৃদয়গ্রাহী হয়ে ওঠে। প্রায় ২৫-২৬ বছর পর আতিকুর রহমান সবুজদের সিকদারপাড়া গিয়েছিলাম। কামরুল, নোবেল, দিদার আমার খুবই প্রিয় কর্মী। কামরুল কিছুটা ঝিমিয়ে পড়েছিল। নোবেল একেবারে বুলেটের মতো। প্রায় ২৫ বছর পর ওদের বাড়ি গিয়েছিলাম। একটা বউ এত আয়োজন করতে পারে আর এত সুস্বাদু খাবার ভাবাই যায় না। সকালে তিন-চার শ নানা ধরনের লোকজন সমাগম হয়েছিল। কি যে মজা লেগেছে বলে বোঝাতে পারব না। মুক্তিযুদ্ধের সময় কালিয়ান প্রাইমারি স্কুলের ভাঙাচোরা ঘরের সামনের মাঠে এক বিকালে বসেছিলাম। সে গ্রামে তখন পাকিস্তান বিমান বাহিনীর এক পাইলট ছিল। সন্ধ্যায় যখন সূর্য ডোবে ডোবে সেই সময় একটু দূরে কয়েকজন আগন্তুককে দেখেছিলাম। খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, তারা মুক্তিবাহিনীতে ভর্তি হতে এসেছে। সেখানে যেমন নুরুল ইসলাম, মোয়াজ্জেম হোসেন, ব্রিগেডিয়ার ফজলুর রহমান ছিলেন, ছিলেন কমান্ডার মোকাদ্দেছ, ছাত্রনেতা দাউদ খান, সোহরাব আলী খান আরজু, আলী হোসেন, আবুল কালাম বীর বিক্রমসহ কয়েকজন। কালিয়ান থেকে তাদের নিয়ে বহেরাতৈল গিয়েছিলাম। তারপরই আস্তে আস্তে আমরা সবল সতেজ হয়েছিলাম, রুখে দাঁড়িয়েছিলাম হানাদারদের বিরুদ্ধে।

আজ প্রায় ৩০ বছর আমি কালিয়ানের বাসিন্দা। স্বাধীনতার পরপরই গিরিশ সরকারের পালক ছেলে সুবল তার জায়গাজমি জোর করে আমার কাছে বিক্রি করেছিল। সেই জমি ছিল ২৫ একর। বায়নার টাকা অর্ধেকের বেশি দিয়ে দেওয়ার পর হঠাৎই বঙ্গবন্ধু নিহত হন। প্রতিবাদ-প্রতিরোধে আমি নির্বাসিত জীবনযাপন করি। দেশে ফিরলে একদিন সুবলের ছেলে চিত্তরঞ্জন সরকার কয়েকজনকে নিয়ে এসে কাঁচুমাচু হয়ে বলে, ‘কাকা, আমাগো জমিটা আপনি নিয়া নেন। চুক্তিমতো যে টাকা পাওনা আছে সেটা দিলেই হবে। না দিলেও কিছু মনে করব না। আপনি জমি না নিলে আমার বাবার আত্মা শান্তি পাবে না।’ বলেছিলাম, এখন দুর্গম গ্রামে অমন জমি নিয়ে আমি কী করব? তার এক কথা, ‘বাবা কথা দিয়েছিলেন সেটা পালন না করলে বাবার আত্মার শান্তি হবে না।’ বলেছিলাম, আত্মীয়স্বজন, ময়-মাতব্বর নিয়ে এখন জমির যে বাজারদর সে দরেই আমাকে রেজিস্ট্রি করে দিও। জমি ছিল ২৫ একর। আমাকে রেজিস্ট্রি করে দিয়েছে ১২ একর কয়েক শতাংশ। বাকিটা আগেই সুবলের ছেলে চিত্ত বিক্রি করে ফেলেছিল। সেই গ্রাম কালিয়ান। ব্রিটিশ ভারতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে সুবলের বাবা গিরিশ সরকারের বাড়িতে এক দুর্দান্ত ডাকাতি হয়েছিল। সাত মহিষের গাড়ি টাকা নিয়েছিল ডাকাতরা। তখন ১০ টাকায় এক পাখি জমি পাওয়া যেত। এখন সে জমির দাম ৩০ লাখ। সেই গ্রাম কালিয়ানের আমি বাসিন্দা। বহেরাতৈলের কালিয়ানের নামেই আমার গেজেট হয়। আমি কালিয়ানের ভোটার। কালিয়ানের প্রার্থী হিসেবে আমার গ্রামবাসী বিপুল ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করবে এতে কোনো সন্দেহ নেই।

পরদিন গিয়েছিলাম কাউলজানী। চমৎকার নির্বাচনি সভা হয়েছে। এ যাবৎকাল অমন স্বতঃস্ফূর্ত সভা কাউলজানীতে দ্বিতীয়টি হয়নি। কল্পনাতীত সাড়া উৎসাহ। কাউলজানী ছিল এক সময়ের খুবই বর্ধিষ্ণু গ্রাম। নামকরা কাউলজানীর আমজাদ খাঁর এক খাসি একাই খাওয়ার গল্প আমরা ছেলেবেলায় বইয়ে পড়েছি। কাউলজানীর ঘরে ঘরে আমার জানাশোনা। পশ্চিমে বাদিয়াজান বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মতিয়ারের বাড়ি, পুবে বংশাই নদীর গা ঘেঁষে গিলাবাড়ি। উত্তর-দক্ষিণ বিস্তীর্ণ এলাকা। উত্তরে কালিহাতী, দক্ষিণে বাসাইল সদর ইউনিয়ন। চমৎকার এক জায়গা। শেখ শাজাহানসহ কয়েকজন মিলে একটি কলেজ করার উদ্যোগ নিয়েছিল। কলেজের পাঁচ একর জায়গা এখনো বিরান পড়ে আছে। দাঁড়িয়ে আছে ঘরের কয়েকটি খুঁটি আর আমরা যে গাছ বুনেছিলাম সেই গাছগুলো। পাশে মোস্তফাদের বাড়িতে যখন রাতে ছিলাম তখন বারবার মনে হচ্ছিল, এ যেন নানা-নানির বাড়ি এসেছি। শেষ বয়সে কলেজটা করতে পারলে কেমন হয়।

দেশের রাজনীতিক পরিমণ্ডল নিখুঁত নেই, খুঁতে খুঁতে বিপর্যস্ত রাজনীতি। সংসদ সদস্যের পদ কত বড় কত ব্যাপ্তি তার। কিন্তু সেখানে অনেকেই সরকারি দলের প্রার্থী যাদের রাজনীতির ‘র’ সঙ্গে সম্পর্ক নেই। বড় খারাপ লাগে। কিন্তু তেমন কিছু করতে পারি না। চেয়েছিলাম ব্যাপক উৎসবমুখর আনন্দঘন পরিবেশে নির্বাচন হোক। কিছু কিছু জায়গা ছাড়া অনেক ক্ষেত্রেই তেমন উৎসব নেই। টাঙ্গাইল একটি শান্তিপূর্ণ এলাকা। বৃহত্তর ময়মনসিংহ হাজার বছরের শিক্ষাদীক্ষা সংস্কৃতিতে সবার সেরা। এক সময় বৃহত্তর ময়মনসিংহ ছিল সারা ভারতবর্ষের পথপ্রদর্শক। এ তো বিশ্ববিদিত বাঙালিরা আজ যা ভাবে সমগ্র ভারত ভাবে আগামীকাল বা এক দিন পরে আর দুনিয়া ভাবে তারও এক দিন পর। টাঙ্গাইলে ২-৪টা মারামারি কাটাকাটি কমবেশি হয়েছে। তারপরও পরিবেশ অনেকটাই ভালো ছিল। তবে গোপালপুরের এক ওসির কারণে সমস্ত নির্বাচনটাই প্রশ্নবিদ্ধ হবে। আমি সেখানকার প্রার্থী না। আমি যেখানে অনিয়ম দেখেছি সারা জীবন তা প্রতিকার প্রতিবাদ করেছি। সেদিক থেকে নির্বাচন কমিশনসহ সবাইকে বলেছি, গোপালপুরের ওসিকে ক্লোজ করেন, ঘরে বন্ধ করেন। একজনের জন্য নির্বাচন প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে না। আজ পাঁচ দিন যায় সে ওসি দাঙ্গাবাজি করে চলেছে। দেখা যাক, গত বছর মাঝামাঝি নির্বাচন কমিশনে গিয়েছিলাম। তারা আমাদের কথা দিয়েছিলেন নির্বাচনে কোনো কারচুপি হবে না, কাউকে ফেভার করা হবে না। কমিশনের আশ্বাসে আমরা বাসাইল পৌরসভার নির্বাচন করেছিলাম। তারপর সখীপুরের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন। ভোটাররা ভোট দিয়েছে, আমরা খুশি হয়েছি। সে কারণেই এ দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের অংশগ্রহণ। না হলে আমরাও হয়তো ভোট বর্জনের দলে থাকতাম। নির্বাচন কমিশনকে বলছি, আর এক ঘণ্টাও নয়, গোপালপুরের ওসি এই লাঠিয়ালটাকে ঘরে আবদ্ধ করুন। ওসি সাহেব আপনাকেও বলে রাখি, আপনার খোঁটার জোর যেখানেই থাকুক আপনি খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। সময় থাকতে সাবধান হয়ে যান।

গত পরশু আমার এক সহকর্মী মুক্তিযুদ্ধে একসময় একমাত্র সঙ্গী সিলেটের ফারুক আহমেদের স্ত্রী নাহার ইহলোক ত্যাগ করেছে। আমি মোটেই জানতাম না ফারুকের স্ত্রী স্মৃতির বোন নাহারের কোনো অসুখ-বিসুখ ছিল। মৃত্যু সংবাদ শুনে বুকটা ভারী হয়ে উঠেছে। ফারুক আর নাহারের বিয়ে আমার কাছে পছন্দনীয় ছিল না। হঠাৎই যখন শুনেছিলাম, আমি বিস্মিত ও ব্যথিত হয়েছিলাম। ছয়-সাত মাস ওদের সঙ্গে যোগাযোগ ছেড়ে দিয়েছিলাম। কেন যেন আমার মনে হয়েছিল মেয়েটা তেমন লেখাপড়া করেনি, গায়ের রং ভীষণ কালো। আমি তো বাইরে থেকে ওর গায়ের রং দেখেছি, ফারুক নিশ্চয়ই ওর ভিতরের আলো আবিষ্কার করেছিল। ওদের বিবাহিত জীবন সুখের এবং আনন্দের ছিল। ফারুকের মৃত্যুর পর স্বামীর হত্যার বিচারের জন্য সে যে ভূমিকা রেখেছিল সাধারণভাবে অনেক মহিলা তেমন রাখতে পারে না। আল্লাহ ফারুকের স্ত্রী নাহারকে বেহেশতবাসী করুন। আমিন।

বড় বেশি খারাপ লাগে অতীতকে আমরা যখন মুছে ফেলার চেষ্টা করি, অস্বীকার করি, এড়িয়ে যাই। আজকাল কত বড় বড় নেতা হয়েছে, কত তাদের শক্তি-সামর্থ্য। কিন্তু বঙ্গবন্ধু যেদিন নিহত হন সেদিন এদের কেউ ছিল না। আমি ঢাকা থেকে এক কাপড়ে সীমান্তে গিয়েছিলাম। খবর পেয়েই ফারুকসহ অন্যরা ছুটে গিয়েছিল। যতদিন প্রতিরোধ চলেছে ততদিন সে হিমালয়ের মতো ঋজু সোজা করে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ছিল। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে ফারুকের ভূমিকা ছিল অবিস্মরণীয়। তখন ছাত্ররাজনীতি করতাম। শত শত হাজারো ছাত্রছাত্রী ছিল আমাদের আশপাশে। কোনোখানে যেতে পারতাম না, খেতে পারতাম না, থাকতে পারতাম না ছাত্রছাত্রীদের ভিড়ে। কেউ ১০ জনের খাবার ব্যবস্থা করলে সেখানে ৫০-১০০ জন গিয়ে হাজির হতো। এভাবেই চলছিল ’৭১-এর মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত। এপ্রিলে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী সাটিয়াচরার যুদ্ধের মধ্য দিয়ে টাঙ্গাইল দখল করে। আমি চলে যাই গহিন জঙ্গলে সখীপুরের পাহাড়ি এলাকায়। আস্তে আস্তে সবাই চলে যায়। একমাত্র এই ফারুকই ছিল আমার সঙ্গে। আজও মনে পড়ে বংশাই নদীর পুবপাড়ে মরিচাতে এক বটগাছের নিচে আমি বিমর্ষ বসেছিলাম। তখন একমাত্র ফারুক আমার সাথী। আমি তন্ময় হয়ে কী যেন ভাবছিলাম। তেমন কিছুই খেয়াল ছিল না। হঠাৎই পিঠে ছোট্ট একটি হাত, ‘বজ্র ভাই, চিন্তা কইরেন না, আমি আছি আপনার সঙ্গে।’ ১৬-১৭ বছরের একটি ছেলের সেই হাত সেই স্পর্শ আমার কাছে সারা পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষের স্পর্শ মনে হয়েছিল। আর পেছন ফিরে দেখতে হয়নি। অনেক কষ্ট পেয়েছি, দুঃখ পেয়েছি, খেতে পারিনি, ঘুমাতে পারিনি। কিন্তু থেমে থাকিনি। বিজয় রথ এগিয়ে চলেছে দুর্বার গতিতে। সেই ফারুকের স্ত্রী আমার থেকে না হলেও ১৫ বছরের ছোট। পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে গেল। আল্লাহ তাকে সব ভুলত্রুটি মাফ করে বেহেশতবাসী করুন।

আবার নির্বাচন সম্পর্কে দু-এক কথা বলি। মনে হয় ফারুকের স্ত্রী নাহারের জানাজায় শরিক হতে সাবেক কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক টাঙ্গাইল এসেছিল। আমিও কি কাজে যেন টাঙ্গাইল এসেছিলাম। হঠাৎই দেখলাম, আমার বাসার পাশ দিয়ে পতাকা উড়িয়ে যাচ্ছে, সঙ্গে পুলিশ স্কট। বিস্মিত হলাম এ আবার কেমন? নির্বাচনি প্রচারের প্রায় শেষ পর্যায় এখন তো কারও পতাকা উড়িয়ে চলার কথা নয়, পুলিশের স্কটও থাকার কথা না। তাহলে তো কোনোমতেই লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড হয়নি। কী করে এদের বুঝাব? আইন ঠিক থাকলে এক সময় না এক সময় এসবের জবাব দিতে হবে। মহান ভারতের মহান নেত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী সংসদ সদস্যপদ হারিয়ে ছিলেন, প্রধানমন্ত্রিত্ব হারিয়েছিলেন। ইঞ্জিনিয়ার সরকারি গাড়ি নিয়ে নির্বাচনি সভামঞ্চ তৈরিতে সাহায্য করেছিলেন। শুধু এটুকু প্রমাণ হওয়ার কারণে পৃথিবীর বিখ্যাত একজন রাজনীতিবিদ আমাদের স্বাধীনতার ধাত্রীসম শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী সর্বস্ব হারিয়েছিলেন। বুঝতে পারলাম না, নির্বাচন কমিশন এসব কী করছে? তাদের আদৌ কোনো নিয়ন্ত্রণ আছে কি নেই বোঝার কোনো উপায় নেই। নির্বাচনের আগে আর লেখার সময় পাব না। নির্বাচনের পরে নিশ্চয়ই দুই কথা লিখব। কিন্তু আগে বলছি, নিরপেক্ষ সুন্দর নির্বাচন হলে, ভোট কেন্দ্রে বিপুল ভোটার উপস্থিত হলে এবং তারা সাধ্যমতো নিজের ইচ্ছায় তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারলে সেটা যেমন গণতন্ত্রের জন্য তেমনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য সম্মান বয়ে আনবে।

লেখক : রাজনীতিক

www.ksjleague.com

সর্বশেষ খবর