শিরোনাম
মঙ্গলবার, ২ জানুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

পর্দার পেছনটা ঠিক আয়নার মতো

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী

পর্দার পেছনটা ঠিক আয়নার মতো

১. পর্দার আড়ালে থাকাটাই ভালো। পর্দার আড়ালে থাকলে অন্তত পর্দার বাইরের খেলাগুলো দেখা যায়। জীবনের অনেকটা সময় তো পেরিয়ে এলাম, কখনো মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়েছি, আঘাত পেয়েও মুখে হাসি ধরে রেখে বুঝিয়েছি, কিছুই হয়নি আমার, তখন ভেবেছিলাম হয়তো আমি কষ্ট পেলে মানুষ কষ্ট পাবে। এখন বুঝি মানুষ ঠিকই বুঝেছিল,  আমি আঘাত পেয়েছি, আমার হাসিটা অভিনয়, আমার কষ্টে তাদের মনের ভিতরের চাপা উৎকণ্ঠা নিয়ে হাসিটা ছিল বাস্তবতার। তখন সেটা দেখতে পাইনি, বরং এখন পর্দার আড়ালে গিয়ে সেই মুখগুলো আবার নতুন করে দেখতে পাচ্ছি।  যদিও সেটা সময়ের গণনায় অতীত, অথচ অভিজ্ঞতার গণনায় বর্তমান।

পর্দার বাইরে থেকে মানুষকে দেখেছি, কিন্তু চিনতে পারিনি। এখন পর্দার ভিতরে চলে গেছি, অথচ মানুষদের না দেখেও তাদের ভিতরটা পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছি। একদিন তারা দর্শক ছিল, এখন আমি দর্শক হয়ে গেছি। তবে দর্শক হয়ে তারা নিজেদের ভিতরের মানুষটাকে হারালেও আমি নিজের ভিতরের মানুষটাকে লালন করছি। চারপাশে এত মানুষ, অথচ মানুষের ভিতরের মানুষটাই নেই। পর্দার পেছনটা ঠিক আয়নার মতো, টিকে থাকতে পারে না, বারবার ভেঙে যায়, ঠিক যেমনটা ভেঙে ভেঙে টুকরো টুকরো হওয়া মানুষের মনের মতো, সেটা আর অখন্ডিত নেই, অনেকটাই খন্ডিত।

আসলে মঞ্চের পর্দাটা উঠে গেলে মঞ্চের বাইরের দর্শকরা নাটকটাই উপভোগ করে, আনন্দে উদ্বেলিত হয়, আবেগ মথিত হয়, অথচ মঞ্চের পেছনের গল্পগুলো অদেখাই থেকে যায়। বাস্তব জীবনের ঘটনাগুলোও এমন, সবাই দর্শক সেজে নিজের পাওনাটা বুঝে নেয়, অথচ সেই বুঝে নেওয়ার খেলায় কে পুড়ল, কে মরল, কে হারিয়ে গেল তার খবর কেউ রাখে না। মুনতাসির ফ্যান্টাসি নাটকটা থিয়েটারে বসে দেখেছিলাম। তখন বয়স অনেক কম ছিল, অনেক কিছুই মনে নেই। তখন নাটকটার কিছু না বুঝলেও, যতদূর মনে পড়ছে হুমায়ূন ফরীদি অভিনয় করতে গিয়ে তার ফুলে-ফেঁপে ওঠা পেটের ভিতর টিভি, ফ্রিজ, টাকা-পয়সাসহ আরও অনেক ভোগ্যপণ্য যখন একটার পর একটা ঢুকাচ্ছিলেন, তখন আনন্দে হেসেছিলাম।

এখন বুঝি তখন হেসে ভুল করেছিলাম, সেটা একটা প্রতীকী অথচ খুব ভয়ংকর মেসেজ ছিল। একটা ভোগবাদী মানুষ নিজের স্বার্থের কারণে সাধারণ মানুষদের সম্পদ কুক্ষিগত করতেই এমনটা করেছিল, যেটার বাস্তবচিত্র প্রতিদিনের পত্রিকার পাতায় এখন আমরা পাচ্ছি। এটা কোনো হাসির বিষয় ছিল না, যদিও দর্শক সারির সে সময়ের বড় বড় মানুষেরাও সেই অভিনয় দেখে হেসেছিল। এখন বুঝি মানুষ নিজের ভিতর সেই ভোগবাদী মানুষটাকে চিন্তা করে হেসেছিল এই ভেবে যে, তারা কত সাধারণ মানুষদের বোকা বানিয়ে নিজেদের সেই মানুষটার মতো শোষক বানিয়েছিল।

এখন শোষকের সংখ্যা আরও বেড়েছে, শোষিতের সংখ্যা তার চেয়ে আরও অনেকগুণ বেড়েছে। শোষকরা এখন সমাজের কাছে নায়ক, সত্যবাদীরা খলনায়ক, শোষিতরা আমার আপনার মতো নাম না জানা আমজনতা।

২. মানুষ তার নিজের পৃথিবীটা ক্রমাগত হারাচ্ছে, অথচ মানুষ বুঝছে না নিজের পৃথিবীতে বুক ফুলিয়ে চলার মধ্যে যতটা সুখ, যে পৃথিবী তার নয় সে পৃথিবীতে হয়তো সোনায় মোড়ানো রাজপ্রাসাদ আছে, রাজ্য আছে, ছড়ানো ছিটানো ক্ষমতার আস্বাদন আছে; কিন্তু সে নিজেই নেই। যেখানে মানুষ নিজেই নেই, সেখানে সুখ নেই, যেটা আছে সেটা অন্যের কাছে ধার করা সুখ। খুব কাছে বা দূরে থেকে দাঁড়িয়ে ধার করা সুখকে মহাসুখ মনে হতে পারে অথচ এমন সুখ খুব ভঙ্গুর ও ক্ষণস্থায়ী হয়। যারা বলে আমি সুখী তারা সুখী নয়, সুখ যখন অধরাই থেকে যায় তখন মানুষ সুখী হয়, সেই সুখ প্রচার করার প্রয়োজন হয় না। মানুষ সুখকে তার মতো করে বিচার করে, এ বিচার করতে গিয়ে মানুষ নিজের সুখকে অন্যের সঙ্গে তুলনা করতে গিয়ে নিরাশ হয়। অথচ মানুষ নিজের যতটুকু আছে যদি তা নিয়ে জীবনকে এগিয়ে নিতে পারত, তবে তার মতো সুখী হয়তো পৃথিবীতে আর কেউ থাকত না।

মানুষের চোখটা সব সময় ওপরের দিকেই থাকে। অথচ চোখটা যদি নিচের দিকে থাকত তবে মানুষ বুঝতে পারত পৃথিবীতে সে যতটা সুখী তার চেয়ে অনেক মানুষই অসুখী। ওপরের দিকের সুখটা ফাঁপা বেলুনের মতো, ফুলতে ফুলতে একসময় ফেটে গিয়ে চুপসে যায়, আর একদম নিচের দিকে যে সুখটা থাকে সেখানে জীবনের বাস্তবতা থাকে, নির্মমতা থাকে, ঘাত-প্রতিঘাত থাকে, কিন্তু সব হারিয়েও নিজের সর্বস্বান্ত হওয়াটা বুঝতে না পারায় একটা দুর্বোধ্য সুখ থাকে।

যে লোকটার মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই, সেই লোকটা রাস্তার ওপরে অযতেœ পড়ে থাকা একটা সিমেন্টের ঢালাই করা পাইপের ভিতর রাত কাটিয়ে ভাবে, আহা, আজকের দিনটা রাজার মতোই কাটালাম। অথচ এ পাইপটাই একদিন মাটির নিচে বসানো হবে, যেটা দিয়ে পানি বা বর্জ্য নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা হবে, অথচ কেউ হয়তো জানবেই না এ পাইপটাই একজন মানুষের এক রাতের রাজপ্রাসাদ হয়ে উঠেছিল। যে লোকটা এটাকে রাজপ্রাসাদ বানিয়ে পরম সুখ লাভ করেছিল, সে-ও এটার কখনো খোঁজ রাখবে না। কারণ নিশ্চিত সুখের চেয়ে অনিশ্চিত সুখ অনেক বেশি দামি। সুখ মনে রাখলে কষ্ট বাড়ে, সুখ ভুলে গেলে আনন্দ বাড়ে। পতিত সুখ মনে রাখলে বোঝা হয়ে যায়, মানুষকে অতীতের জন্য কাঁদায়।

মাটিতে দাঁড়িয়ে আকাশে উড়তে উড়তে ওপরে ওঠা মানুষ দেখতে এখন ভালোই লাগে। না, ঠিক ভালো লাগা নয়, বরং ওদের ওপরে উঠতে গিয়ে ভাসমান সুখ কাড়াকাড়ির লড়াই দেখে মনে হয়, সুখ যেন খাঁচায় বন্দি পাখি, যেখানে কোনো অভাব নেই, কিন্তু নিজে না থাকার অভাবটাই বেশি থাকে। খাঁচার ভিতরেই যেন সব সুখ অথচ যে পাখিটা আকাশে উড়েই চলেছে, তার খাঁচার মতো কোনো ঘর নেই, অভাব পূরণের কিছুই নেই অথচ নিজের একটা পৃথিবী আছে, যে পৃথিবীতে অনিশ্চয়তা সবচেয়ে বেশি, কিন্তু চ্যালেঞ্জ নিয়ে নিজেকে নিজের মতো করে এগিয়ে নেওয়ার সাহস ও সম্ভাবনাও অনেক বেশি।

৩. চুপ করে থাকা মানুষদের আমরা ভালো মানুষ হিসেবে বিবেচনা করছি। সমাজ তাদের নাম দিয়েছে অতিশয় ভদ্র মানুষ, যারা কারও সঙ্গেও নেই, পাছেও নেই। সমাজের অন্য মানুষেরা কোথায় আছে না আছে এটা তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ না হলেও তারা নিজেরা সেভ জোনে আছে ভেবে এ মানুষগুলো সব সময় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। কেউ কেউ চুপ থাকা এ সংস্কৃতিকে বাহবা দিয়ে এসব মানুষকে সারা জীবন বোবা মানুষ বানিয়ে রাখার মোটিভেশন দিচ্ছে। এ কৌশল অবলম্বন করে বিরাট একটা শ্রেণিকে যদি সমাজের মূল স্রোত থেকে বাইরে রাখা যায় তবে মন্দ কি? চুপ থেকে যদি ভালো মানুষের স্বীকৃতি খুব সহজে পাওয়া যায়, এই ভেবে সমাজের প্রায় বেশির ভাগ মানুষ মুখে তালা দিয়ে রেখেছে। অথচ এদের সমাজের সবচেয়ে দুর্বল শ্রেণি বলে কেউ কেউ ভাবলেও এরাই সমাজ ধ্বংসের মূল কারিগর হিসেবে কাজ করছে। এদের চুপ থাকা অন্যায়-অবিচারকে প্রশ্রয় দেওয়াতে ভূমিকা রাখছে, সমাজের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি করছে। এদের এমন মনোভাবের কারণে মানুষের পক্ষে, সমাজের পক্ষে, দেশের পক্ষে একদিন কথা বলার কোনো মানুষ পাওয়া যাবে না। চুপ থাকা মানুষরা নিজেদের স্বার্থকেই বেশি প্রাধান্য দেয়। চুপ থেকে ভালো মানুষের সংজ্ঞায় নিজেদের ফেলে তারা এ সুবিধা নিতে বিন্দুমাত্র ছাড় দেয় না। এ শ্রেণির বাইরে আরও দুটো শ্রেণি আছে। খুব সহজ করে বললে ১. উচিত কথা বলার মানুষ এবং ২. সুবিধাবাদী মানুষ। এর বাইরেও আগাছা, পরগাছা, পরজীবী মানুষ তো আছেই। উচিত কথা বলার মানুষের সংখ্যা আমাদের সমাজে ক্রমশ কমতে কমতে ক্ষয়িষ্ণু হয়ে এসেছে।

চুপ থাকা মানুষদের নীরবতা সুবিধাবাদী মানুষদের অন্যায়কে আরও সহজ করে দিচ্ছে। এদের পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ ভূমিকায় সুবিধাবাদী মানুষের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে।

চুপ থেকে দুই পক্ষকেই খুশি রাখা মানুষদের ভালো মানুষ বলাটা কতটা যৌক্তিক সেটাও ভাববার বিষয়। মনে রাখতে হবে, নিউট্রাল গিয়ারে কখনো গাড়ি চলে না। চুপ থেকে নিরপেক্ষতার অভিনয় সুবিধাবাদিতার চেয়েও ভয়ংকর। অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে দুজনই সমান অপরাধী।

নীরব থাকা অনেকটা নীরব ঘাতকের মতো। সুবিধাবাদী ও চুপ থাকা মানুষের সংখ্যা একত্রে অনেক বেশি হওয়ায় উচিত কথা বলার মানুষেরা কোণঠাসা হয়ে আছে। সব জায়গায় তারা হারছে, মার খাচ্ছে। ঘুরে দাঁড়াতে চুপ থাকা মানুষদের তথাকথিত ভালো মানুষের মুখোশটা খুলে মুখটাকে বের করে আনা খুব বেশি প্রয়োজন। মনে রাখতে হবে, ভালো মানুষ সেজে ভালো থাকা আর প্রকৃত ভালো মানুষ হওয়া এক কথা নয়। নিজে ভালো থাকা মানে ভালো থাকা নয়, সবাইকে নিয়ে ভালো থাকাই ভালো থাকা।

আমাদের সমাজে মানুষদের মূল সমস্যা হচ্ছে তারা বাস্তবের নায়ক-ভিলেনদের চিনতে পারছে না। ভিলেনকে ভাবছে নায়ক, নায়ককে ভাবছে ভিলেন। এটা বাড়তে থাকলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এর বোঝা টানতে হবে। সমাজের সবাই সুবিধাবাদী হয়ে গেলে সমাজটাকেই একদিন নিলামে তুলে বিক্রি করার মতো অবস্থা তৈরি হতে পারে। সমাজ বিক্রি হলে মানুষ দাস হয়ে যায় আর দাসত্বের চেয়ে বড় কলঙ্ক আর কিছু নেই।

৪. জীবনে অনেক কিছু হারাতে হারাতে মানুষ বেড়ে ওঠে। এ হারানোর যাত্রায় নতুন অনেক কিছুই মানুষ পায় হয়তো, তবে যা হারিয়ে যায় তার অনেক কিছুই আর চাইলেও ফিরে পাওয়া যায় না। শৈশবের দুরন্ত দিনগুলো হারিয়ে যায়। শৈশব হারিয়ে যায়। মা-বাবার আদর, ভালোবাসা, শাসন, বারণগুলো হারিয়ে যায়। পুরনো ইট-পাথরের স্কুলের জীবনটা হারিয়ে যায়। ছুটির ঘণ্টাটা কান পেতে শোনার ব্যাকুলতা হারিয়ে যায়। শৈশবের চেনা-অচেনা বন্ধুরা হারিয়ে যায়। নিজের ভিতরের অবুঝ মনের ছেলে মানুষটা হারিয়ে যায়। ছেলেবেলার ছেলেখেলাগুলো হারিয়ে যায়। বায়োস্কোপ দেখার আনন্দটা হারিয়ে যায়। মেলায় ঘুরে ঘুরে মুড়ি-মুড়কি খেতে খেতে বিস্ময় জাগানিয়া সার্কাস দেখার অনুভূতিটা হারিয়ে যায়। খোলা আঙিনায় এদিক-ওদিক দৌড়ে দৌড়ে বৃষ্টিতে ভেজার আবেগটা হারিয়ে যায়। বছরের শুরুতে নতুন বইয়ের গন্ধ নেওয়ার মনটা হারিয়ে যায়।  আগের বছরের ক্যালেন্ডারের পাতাগুলো খুলে খুলে নতুন বইয়ের ওপর মলাট লাগানোর স্মৃতিগুলো হারিয়ে যায়। ঠাকুরমার ঝুলি পড়তে পড়তে নিজেকে রাজকুমার ভাবার কল্পনাটা হারিয়ে যায়। একটা ছোট মনের নিষ্পাপ স্বপ্ন, ছোট ছোট সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার গল্পগুলো হারিয়ে যায়।

এমন করে একটা সময় হারিয়ে যায়। খুব অদ্ভুত হয় সময় হারানোর বিষয়টা। মানুষ যে সময়টা হারায়, মানুষ সে সময়টার প্রেমে পড়ে যায়। তখন সে প্রেমটা মানুষের কাছে প্রেম মনে হয় না, যখন সেই সময়টা পেরিয়ে আরেকটা সময় আসে তখন সেটা প্রেম হয়ে যায়। কিন্তু তাতে কী লাভ! তখন যে সেই প্রেম আর ধরা যায় না, অধরাই থেকে যায়। রবীন্দ্রনাথের ‘মরীচিকা’ প্রেমের কবিতা নয়, তারপরও বিড়বিড় করে বলি, যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই, যাহা পাই তাহা চাই না।  গাছের পাতাগুলো তখনো ঝরে পড়ত, এখনো ঝরে পড়ে। তখন পাতা ঝরেপড়া দেখলে গাছের জন্য বুকটা হু হু করে কেঁদে উঠত, এখন আর কাঁদতে পারি না। এখন যে বড় হয়ে গেছি। ছোট থাকলে কারণে-অকারণে কাঁদা যায়, বড় হলে কাঁদা যায় না। মানুষ ছোট থাকলে স্বাধীন থাকে, বড় হলে পরাধীন হয়ে যায়।

লেখক : শিক্ষাবিদ, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর

সর্বশেষ খবর