বৃহস্পতিবার, ৪ জানুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

রাজনৈতিক অর্থনীতির টালমাটালের বছর

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

রাজনৈতিক অর্থনীতির টালমাটালের বছর

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে দ্রব্যমূল্যের ঘোড়া ছুটিয়ে, আর্থসামাজিক পরিবেশ পরিস্থিতিতে সিন্ডিকেটের প্রযোজনায় অস্থিরতা সৃষ্টি করে, আয় বৈষম্যের ব্যাপ্তি বাড়িয়ে, শ্রীমান ডলারের বিনিময় মূল্যের তেলেসমাতি টিকিয়ে, রিজার্ভের ধস নামিয়ে, স্যাংশনের আগমনী বার্তা পৌঁছিয়ে, ভূরাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের ঠান্ডা যুদ্ধের প্রকাশ ঘটিয়ে, আমজনতাকে ‘অন্যরকম নির্বাচনে’ অংশগ্রহণের/বর্জনের দ্বারা ডাকাডাকি করে ক্ষতিপূরণের লোভ দেখানোর নানাবিধ বদনাম নিয়ে দুই হাজার তেইশ চলে গেছে। চব্বিশ তারই ধারাবাহিকতায় এসেছে, সামনের তিন শ ছেষট্টি দিনের পর, আট হাজার সাত শ ঘণ্টার ঘনঘটা সাঙ্গ করে সে-ও প্রস্থান করবে, সে সময় পঁচিশ এসে পাতবে সংসার। কিন্তু এই যে নিত্য চলে যাওয়া- আসা দেখার বিষয় রেখেই যাওয়া যে কালের কপোলতলে কি রেখে গেল বা যাবে এসব পঞ্জিকাবর্ষ প্রবরেরা? সমাজ সংসার দেশ ও দুনিয়ার অভিজ্ঞতার ভান্ডারে কি জমবে বা কেমন দাঁড়াবে তার যোগ-বিয়োগের জমা খরচের জের?

নতুন যে বছরটি এসেছে তা যেন অসংখ্য চরের চোরাবালিতে স্রোতস্বিনী পদ্মার প্রাণান্তকর পরিবেশ সংহারে কুয়াশার চাদর মুড়ি দিয়ে দিনাতিপাত করতে বাধ্য করার মতো। বিগত বছরের অর্থনীতি আগামী বছরের দিনমানের হিসাব কিতাব বেহিসাবের খাতায় অলস অস্থির ও ক্রমশ কর্মহীনের হীনমন্যতায় মূক বধির হয়ে উঠছে। দুই হাজার তেইশ কেমন কেটেছে? একজন দিনমজুরের, ছাপোষা কেরানির, ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীর, হাসপাতাল ও ক্লিনিক মালিকের, ব্যবহারজীবীর, কলম সৈনিকের, সংস্কৃতিসেবীর, বড় মজুদদার সিন্ডিকেটের, স্টক মার্কেটের অর্থ লোপাটকারীর, ব্যাংকের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া ধুরন্দর সিন্ডিকেট ও ব্যবসায়ীর, মুদ্রা পাচারকারীর, অন্তিম শয্যায় শায়িত গণতন্ত্রের জন্য মায়াকান্নাকারীদের? বছরের শেষদিকে এসে জানা গেল করোনা এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব তাদের অন্যায় অন্যায্য আয়ের অগ্রযাত্রায় ‘কিছুই করতে পারেনি’ যারা ৫০ হাজার টাকায় শুধু নমিনেশন ফর্দ কিনে এক দাগে ১৬ কোটি টাকা আয়ের উৎস হতে পেরেছেন, যারা বিগত ১০ বছরের ইন অ্যান এভারেজ ১০ গুণ বেশি সম্পদের মালিক হওয়ার হলফনামা দিতে পেরেছেন। এসব কথা ভাবার অবকাশ দিয়ে নতুন বছরটি এসেছে যখন চারদিকে কুয়াশার চাদর মুড়ি দিয়ে কিম্ভূত কিমাকার ভোরের দিকে এগোচ্ছে বাংলাদেশ আর এর সমাজ। কুয়াশার ধোঁয়াটে পরিস্থিতিতে সবার চোখের ভিজিবিলিটি যথেষ্ট অস্পষ্ট। ভোর দেখে দিনের অবস্থা (morning shows the day) ঠাওর করার যে মহাজন বাক্য শিখেছিল সবাই এখন তা যেন আর খাটছে না। যাদের জন্য, যাদের দিয়ে, যারাই সেই ভোরে যেসব স্বপ্ন জাগানিয়া গান শুনিয়েছিল ভৈরবী রাগে তা যত বেলা বেড়েছে, পশ্চিমের আকাশে ঢলেছে সূর্য, সামনে অস্তাচলের পথে এসে তার বাস্তবায়নের ভিজিবিলিটি তত অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে যেন। সহজ সরল বিশ্বাসে, আস্থায় বুক  বেঁধে সবাই বারবার আর তা কেন জানি খান খান হয়ে যায় অতি চালাক ও ধড়িবাজদের ধান্দায়। বেশ কয়েক বছর ধরে সবাই শুনেছে ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়ে গেছে কোনো কোনো অতি চালাক চতুরেরা এবং এখন একে অন্যের ওপর দোষ চাপিয়ে চালাকেরা আরও বোকা সাজার ভান করছে। উন্নয়নের চমক দেখিয়ে বোঝানোর চেষ্টা চলছে যেন কিছুই হয়নি, কেউ কিছু করেনি এমন একটা ভাব ভাবনা দিয়ে পার পাইতে চাইছে। ইস্যুর পর ইস্যু তৈরি হয়ে আগেরটা বেমালুম ভুলে যাচ্ছে মানুষ। এর দোষ ওর দোষ যাই বলা হচ্ছে শেষমেশ কষ্টটা, কড়া ও চড়া সুদ ও শর্তের ঋণের বোঝাটা, দুর্নীতির বোঝাটা আমজনতার কাঁধে চাপানোর মুনশিয়ানার গ্রোথ বাড়ছে। মানুষের আয় তত্ত্ব জিডিপির জাত্যাভিমান নিয়েও অনেক ব্যাখ্যান মিলেছে। জীবনমানের নৈমিত্তিকতার উপস্থিতি  না মিললেও বিদেশি সনদে পদকে, কূট সমর্থনে প্রচার পেয়ে অর্থনীতি প্রমোশন পাচ্ছে। দ্রব্যমূল্যের রাশ টেনে ধরতে চেষ্টার কমতি ছিল না, কিন্তু কেউ কথা রাখেনি। সিন্ডিকেটের ছুড়ে দেওয়া স্পিনিং বল বরাবরই রানআউট করে দিয়েছে ক্রেতাকে, নাকাল হতে হয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকে।

প্রভূত পরিসংখ্যান, আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট ও পটভূমিতে আজ এটা স্পষ্ট হচ্ছে যে দূরত্ব বাড়ছে অনেক ক্ষেত্রে-সরকারি সেবা প্রতিষ্ঠানের ও নাগরিকের মধ্যে, করদাতা ও গ্রহীতার মধ্যে, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে, শিল্পমালিক ও শ্রমিকের মধ্যে, নীতিনির্ধারকের সঙ্গে পোষক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে, উৎপাদনকারীর সঙ্গে খুচরা ক্রেতার, ব্যাংকের আমানতকারীদের সঙ্গে ব্যাংক ব্যবস্থাপনার, সামষ্টিক অর্থনীতি ব্যবস্থাপনায় প্রত্যাশার সঙ্গে আর্থিক খরচে কর্মনৈপুণ্যের, ব্যয় সংকোচন কৃচ্ছ্রসাধন পরিবেশেও বল্গাহীন ব্যয়ের, সদাচার, সামাজিক ন্যায়নীতি নির্ভরতার সঙ্গে অসদাচার ও নীতিহীনতার, সুশৃঙ্খলা বোধের সঙ্গে উচ্ছৃঙ্খতার, রাজস্ব আহরণ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে ব্যয় ব্যবস্থাপনার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীর সঙ্গে সাধারণ মানুষের। বাংলাদেশের ভূরাজনীতি নতুন বলয়ে প্রবেশ করছে। পূর্বদিকে তাকানোর নীতি ‘তাকানো’ ও ‘দেখার’ মধ্যকার দূরত্ব ঘোচাতে না পারলে কিংবা ‘শ্যাম রাখি না কুল রাখি’ জাতীয় দোটানায় বুঁদ হয়ে থাকলে সৃজিত ব্যবসা-বাণিজ্য বিনিয়োগ সহযোগিতা সহায়তার সংসারে বাড়া ভাতে ছাই পড়তে পারে। বিদেশি বিনিয়োগ নানান কলাকৌশলে যাতে এদেশের বাজারকে কুক্ষিগত ও ক্ষতিগ্রস্ত করার পথে না থাকে সে ব্যাপারে নিজেদের মনোভঙ্গিকে অবশ্যই সতেজ ও সজিব হওয়ার অবকাশ থাকবে। আত্মস্বার্থ দেখার চেতনা শানিত ও জাগ্রত থাকার আবশ্যকতা আরও বৃদ্ধি পাবে দেশীয় অর্থনীতি ও উন্নয়নের স্বার্থ সংরক্ষণের প্রশ্নে।

সাম্প্রতিক সময়ে দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়েছে বলা হলেও এ উন্নয়নের অর্জিত সাফল্য বা ফলাফল কি দেশের সাধারণ মানুষ ন্যায্যতার ভিত্তিতে সবাই ভোগ করতে পারছে? দেশের উন্নয়নের সুফল যদি সামান্য কিছু ভাগ্যবান মানুষের ভান্ডারে গিয়ে জমা হয় এবং সাধারণ মানুষ বঞ্চিত হওয়া দুর্ভাগ্যজনক। অথচ এ অসম উন্নয়নের জন্য সরকারকে সাধারণ মানুষের কাছে জবাবদিহিও করতে হচ্ছে না। বর্তমান অর্থবছরটি নির্বাচনের বছর। ছয় মাস বিদ্যমান সরকার বাকি ছয় মাস নতুন নির্বাচিত সরকার। অতীতে সব সময় নির্বাচনের অর্থবছরে বাজেট বণ্টনের সময় এ বিষয়টি খেয়াল রাখা হতো গণতন্ত্রের স্বার্থে, সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় সচেতন হওয়ার স্বার্থে। কিন্তু এবার প্রথম দেখা গেল বিদ্যমান সরকারের বাজেট বক্তৃতায় ও প্রকল্প ব্যয় ব্যবস্থাপনায় বিষয়টি পুরোপুরি উপেক্ষা করা হয়েছে। শেষ দুটি একনেকে প্রচুর প্রকল্প অনুমোদন দিয়ে, আমরাই বাস্তবায়ন করব, কিংবা আমরা না এলে এগুলো বাস্তবায়ন করা যাবে না জাতীয় মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে। নতুন অর্থবছরের এসব কর্মসূচি বাস্তবায়নে রেভিনিউ আর্নিং না বাড়লেও বাস্তবায়নের চাপ বাড়বে অন্তত যারা একপক্ষীয় নির্বাচনে বিনিয়োগ করছেন তাদের পক্ষ থেকে। ফলে ধারকর্জের পরিমাণ বাড়বে। মানুষ উন্নয়ন চায় কিন্তু সেই উন্নয়ন হতে হবে সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিমূলক উন্নয়ন। দুর্নীতির মাধ্যমে ব্যাপক উন্নয়ন সাধারণ মানুষের কাম্য নয়। তারা সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা এবং দুর্নীতিমুক্ত উন্নয়ন কামনা করে। দুর্নীতিমুক্ত উন্নয়নের জন্য সাধারণ মানুষ ত্যাগ স্বীকার করতেও প্রস্তুত। এমনকি দুর্নীতিবিহীন তুলনামূলক কম উন্নয়নও কাম্য হতে পারে। কিন্তু দুর্নীতিযুক্ত উন্নয়ন কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। উন্নয়নের নামে ব্যাপক দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে সমাজের একটি শ্রেণি আঙুল ফুলে কলাগাছ হলে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী দিন দিন নিঃস্ব হয়ে পড়বে। সাধারণ মানুষ বাজারে গিয়ে নিত্যপণ্য ক্রয় করতে পারছে না। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের একটি বড় লক্ষ্য ছিল সমাজে বিত্তবান-বিত্তহীনের মাঝে সৃষ্ট পর্বতপ্রমাণ অর্থনৈতিক বৈষম্য কমিয়ে আনা। কিন্তু এখন সেই বৈষম্য ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। দেশের অধিকাংশ সাধারণ মানুষ এখন অর্থনৈতিক কারণে নিঃস্ব হওয়ার পথে এবং সীমিত সংখ্যক মানুষ উন্নয়নের সুফল ভোগ করছে। সমাজে মধ্যবিত্ত এবং আরও সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে বলতে হয় নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ বড়ই অসহায় অবস্থার মধ্যে আছে। আমাদের দেশে উন্নয়ন বলতে শুধু অবকাঠামোগত উন্নয়নকেই বিবেচনা করা হয়। কিন্তু উন্নয়নের অর্থ আরও ব্যাপক। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবেশ, সামাজিক অবস্থা এসবের উন্নয়ন না হলে অবকাঠামোগত উন্নয়ন এক সময় ফিকে হয়ে যেতে পারে। আর আমাদের মতো দেশে উন্নয়ন অর্থই হচ্ছে ব্যাপকভিত্তিক দুর্নীতির প্রসার ঘটানো। এমন এক সময় আসতে পারে যখন দেখা যাবে উন্নয়নের জন্য বাজেট প্রণয়নের অর্থ নেই। উন্নয়ন যদি সমন্বিত হতো, মানুষ যদি শিক্ষিত হতো, জনসম্পদ তৈরি হতো, সামাজিক উন্নয়ন সাধিত হতো, তাহলে সেই উন্নয়নকে সত্যিকার কল্যাণমূলক উন্নয়ন বলা যেত।

উন্নয়ন অর্থায়নের জন্য অভ্যন্তরীণ সূত্র থেকে সম্পদ আহরণ করা না গেলে সেই উন্নয়ন কখনোই টেকসই এবং গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। মুক্তিযুদ্ধে আমাদের দেশের মানুষ অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছে। তার বিপরীতে আমরা স্বার্থকতা খুঁজে নিয়েছি এভাবে যে, আমরা ত্যাগের বিনিময়ে একটি স্বাধীন দেশ পেয়েছি। কিন্তু সেই স্বাধীন দেশে উন্নয়নের নামে মহলবিশেষের স্বার্থ রক্ষা করা হবে এটা বাঞ্ছনীয় নয়। সামষ্টিক অর্থনীতিতে চড়া সুদ ও কড়া শর্তের ঋণের টাকা ব্যয়ের ক্ষেত্রে অপব্যয়ের জৌলুসের চাকচিক্যের ডামাডোলকে মনে হতেই পারে এটি পুঁজিবাদী মানসিকতা প্রস্তুত এবং বৈষম্যবিলাসী উদাসীন ঊর্ধ্বতনদের ইচ্ছা ও অভিলাষ উৎসারিত। এ অগ্রগতি গুণগতমান উন্নয়ন ব্যতিরেকে শিক্ষার পাসের হার এবং পার ক্যাপিটা জিডিপি বৃদ্ধির মতো সাময়িক তৃপ্তিলাভের অগ্রগতি মনে হতে পারে ভূত ভবিষ্যতের দিকে দৃষ্টিপাত করে নয়- সাময়িকভাবে নিজেদের মতো করে অর্থনীতি ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ডকে সীমিতভাবে সীমাবদ্ধকরণের প্রয়াস উৎসারিত। অর্থনৈতিক বৈষম্য বিভাজন থেকে মুক্তির সংগ্রামে জয়ী একটি জাতির আকিঞ্চন আকাক্সক্ষা যেখানে একটি স্বাধীন সার্বভৌম অর্থনীতির প্রাণবায়ু, সেখানে জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা ও ন্যায়নীতি নির্ভরতা, নৈতিক মনোবল ও মূল্যবোধ তার সার্বিক অবস্থান ও উপস্থিতিকে আপাত প্রাণচাঞ্চল্যে ফিরে আসার অজুহাত দেখিয়ে প্রকারান্তরে সেগুলো ক্রমশ নির্বাসনে পাঠিয়ে সাময়িক এ প্রগলভতায় সমাজ প্রকৃতপক্ষে এগোচ্ছে না পিছাচ্ছে তার একটা সালতামামি ও আত্মবিশ্লেষণ প্রয়োজন হবে নতুন বছরে।

লেখক : সরকারের সাবেক সচিব এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান

সর্বশেষ খবর