বৃহস্পতিবার, ৪ জানুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

কেনারাম, বাবুরাম ও বেচারাম

মোশাররফ হোসেন মুসা

কেনারাম, বাবুরাম ও বেচারাম

কলামটির শিরোনাম আমার নয়; এটি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ আবদুল্লাহ  আবু সায়ীদের। তাঁর লেখার বিষয়বস্তু মনে না থাকলেও শিরোনামটি মনে আছে। আজকের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে শিরোনামটি ব্যবহার করা যথাযথ হবে। তবে যারা কষ্ট করে বৈধপথে অর্থ উপার্জন করে মধ্যবিত্ত হয়েছেন, যারা সরকারের আইনের আওতায় থেকে ব্যবসা-বাণিজ্য করে জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করেছেন, উদাহরণটি তাদের জন্য নয়। যারা অসৎ উপায়ে অর্থ উপার্জন করে রাতারাতি বিপুল অর্থের মালিক হয়েছেন, লেখাটি তাদের উদ্দেশে। ধরুন ‘কানাই রাম’ একজন এমপি, কিংবা একটি মেগা প্রকল্পের বড় ঠিকাদার। তিনি রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য পেয়ে            ১৫-১৬ বছরে কয়েক শ কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। মানুষের লোভের যেহেতু সীমা নেই, সে কারণে তার আরও টাকা চাই। ‘আরও অর্থ’, ‘আরও অর্থ’ করতে করতে একদিন তিনি প্রাণত্যাগ করলেন। পরের প্রজন্ম, তথা দ্বিতীয় প্রজন্ম বিনা বাধায় অবৈধ অর্থের অংশীদার হয়ে গেল। তারা অভাব কাকে বলে জানে না। তাদের লেখাপড়া ও ব্যবসা-বাণিজ্যে তেমন মনোযোগ নেই। আলসেমি আর বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা মেরে সময় পার করলেন। লোকজন তাদের নাম দিল বাবুরাম ভ্রাতৃবৃন্দ। বাবু রামেরা একসময় ইহজগৎ থেকে বিদায় নিলেন। তৃতীয় প্রজন্মের পিতামহের সম্পত্তির প্রতি তেমন লোভ নেই। তারা লেখাপড়া শিখে মানসিক উৎকর্ষতা লাভ করলেন। তারা সম্পত্তি বেচা শুরু করলেন। সে জন্য লোকে তাদের নাম দিল বেচারাম। এই বেচারামরাই এলাকার শিক্ষা, চিকিৎসা, খেলাধুলা, সংস্কৃতির জন্য পিতামহের অবৈধ টাকা অকাতরে ব্যয় করতে থাকলেন। সেই সঙ্গে রাজনীতিতে সুস্থধারা নিয়ে আসার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকলেন। এখানে একটি উদাহরণ প্রাসঙ্গিক হবে। ব্রিটিশ আমলে (১৯০০ সালে) হার্ডিঞ্জ ব্রিজ নির্মাণকে তৎকালীন সময়ের মেগা প্রকল্প হিসেবে ধরা হয়। সেই প্রকল্পেও দুর্নীতি হয়েছে। তবে সেটা সীমার মধ্যে ছিল। তখন যারা মাটি, পাথর, কাঠ ও শ্রমিক সরবরাহ করতেন তথা যারা ইংরেজদের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করার সুযোগ পেয়েছিলেন তারাই লাভবান হয়েছেন। তাদের সন্তানরাই পরবর্তী সময়ে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আমলা ও রেলওয়ের বড় চাকরিজীবী হয়েছেন। সে সময় হার্ডিঞ্জ ব্রিজের আশপাশে তথা পাকশী, রূপপুর, বাঘৈল প্রভৃতি এলাকায় বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ক্লাব ও খেলার মাঠ গড়ে ওঠে। সেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বহু প্রতিভাবান ব্যক্তির জন্ম ঘটে (কবি শঙ্খ ঘোষ, কবি অমিয়ভূষণ মজুমদার, চিকিৎসক কামরুল ইসলাম উল্লেখযোগ্য)। অর্থাৎ তাদের পিতারা সরকারের আনুকূল্য পেয়েছিলেন বটে; কিন্তু তাদের চিন্তা-ভাবনা ও জীবনযাপনে সুস্থতা ছিল বলেই দ্বিতীয় প্রজন্ম শিক্ষিত হয়ে পড়ে। বর্তমানে রূপপুর, পাকশী বাজার, বিবিসি বাজার, বাঘৈল প্রভৃতি এলাকায় দ্বিতীয় প্রজন্ম তথা বাবুরামদের যথেষ্ট অবদান এখনো চোখে পড়ে। একই জায়গায় রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মিত হচ্ছে। ১২৬.৫ বিলিয়ন ডলার চুক্তির এই প্রকল্পে ৯০% অর্থ রুশ সরকার দিচ্ছে। এ প্রকল্পে কী পরিমাণ দুর্নীতি হচ্ছে, তা প্রমাণের জন্য বালিশ কেলেঙ্কারির উদাহরণটি যথেষ্ট হবে। বালিশের বাজার মূল্য ৩০০ টাকা হলেও বালিশের মূল্য ধরা হয় ৫ হাজার ৯৫৭ টাকা। প্রজেক্টকে কেন্দ্র করে ইতোমধ্যে একজন বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধাসহ ৬-৭ জন খুন হয়েছেন। এসব ঘটনায় আমাদের ব্রিটিশ সরকারের প্রকল্পের সঙ্গে পার্থক্য চিহ্নিত করে। বর্তমান সরকার ১৫ বছর ক্ষমতায় (আগের ৮ বছর ৬ মাস, আর আগামীর পাঁচ বছর ধরলে মোট হবে ২৩ বছর ৬ মাস)।

সিপিডির ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এক সম্মেলনে বলেন, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীদের হলফনামায় দেখা গেছে, তাদের সম্পদ ৫০০ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু সে তুলনায় তারা ৫০০ গুণ কর দেননি (আজকের পত্রিকা, ৩১ ডিসেম্বর ২০২৩)।

উল্লেখ্য, হলফনামায় প্রকাশ্য সম্পদ যদি ৫০০ গুণ বৃদ্ধি পায়, তাহলে গোপনে অদৃশ্য সম্পদ কতগুণ রয়েছে, তা বের করতে ডিগ্রিধারী হতে হয় না। এমপিদের সম্পদ একই রকম আছে, সেরকম এমপির সংখ্যা খুবই নগণ্য। শুধু তারাই বিত্তবৈভবের মালিক হননি; আত্মীয়স্বজনও সমানতালে অর্থের মালিক হয়েছেন। তাদের সন্তানদের বিভিন্ন পদে অধিষ্ঠিত করেছেন। এখন দ্বিতীয় প্রজন্ম, তথা বাবুরামদের রাজত্ব চলছে। সমাজতত্ত্বের সূত্র বলে, দ্বিতীয় প্রজন্মের মনেও লোভ-লালসার রেশ থাকে।  কিন্তু আমরা যারা প্রবীণের খাতায় নাম লিখিয়েছি, তারা তো বেশি দিন বাঁচব না। আশা করাই মানুষের ধর্ম। তাই বাবুরামদের কাছে বিনীত প্রার্থনা, আর কোনো অর্থ কামাই নয়, যথেষ্ট হয়েছে।  এবার দেশগড়ায় মনোযোগ দেন। অন্তত জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন।

লেখক : গণতন্ত্রায়ণ ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার বিষয়ক গবেষক

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর