বিএনপি নেতা-কর্মীদের বিরাট অংশ দল ছেড়ে বিভিন্ন দিকে চলে গিয়ে নির্বাচনমুখী হওয়ার পর দলটি এখন প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে পড়েছে। তবে রুহুল কবির রিজভীসহ কয়েকজন এই ডুবন্তমুখী দলটিকে টিকিয়ে রেখে শেষ ভরসা হিসেবে কাজ করে তাদের নেতা, খুনের দায়ে দন্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামি, তারেক জিয়ার নির্দেশ পালন করে যাচ্ছেন। মাঠপর্যায়ে ধ্বংসাত্মক কার্যাবলি চালানোর জন্য জামায়াতের নেতা-কর্মী ছাড়াও ভাড়াটে সন্ত্রাসীদের ওপর এরা ভর করে সন্ত্রাস চালিয়ে যাচ্ছে। এরই মধ্যে প্রমাণিত হয়েছে, ভাড়াটে সন্ত্রাসীরা পয়সার বিনিময়ে বাসে-ট্রেনে অগ্নিসংযোগ চালিয়ে শিশুসহ বহুজনের প্রাণহানি ঘটাচ্ছে, সম্পদ বিনষ্ট করছে। প্রাথমিকভাবে তারা চেষ্টা করছিল বিভিন্ন দলের বিভিন্ন লোককে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে বিরত রাখতে। কিন্তু সে অপচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর তারা নতুন কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নেমেছে, নির্বাচন থেকে জনগণকে সরিয়ে রাখার জন্য। তাদের সেই পরিকল্পনায় সম্প্রতি নতুনভাবে সংযোজিত হয়েছে ভোট দিতে না যেতে জনগণকে প্রভাবিত করার জন্য মৌখিক ঘোষণা ছাড়াও গণহারে লিফলেট বিতরণ। কদিন আগে রুহুল কবির রিজভীসহ কয়েকজন শীর্ষ নেতা প্রকাশ্যেই ঘোষণা দিয়েছেন, জনগণকে ভোট কেন্দ্রে যেতে দেওয়া হবে না। এটি বলাই বাহুল্য, এমনকি একজন ব্যক্তিকেও ভোট দিতে যাওয়া থেকে বিরত করা বা ভোট না দেওয়ার জন্য প্রভাবিত করা বা সেগুলোর চেষ্টা করা শুধু দন্ডবিধির বিভিন্ন ধারাতেই অপরাধ নয়, দ্য রেপ্রেজেন্টেশন অব দি পিপলস অর্ডারের বিভিন্ন বিধানেও এসব গণবিরোধী কর্মকান্ডকে, অত্যন্ত যৌক্তিকভাবেই, শাস্তিযোগ্য অপরাধের আওতাভুক্ত করা হয়েছে। নির্বাচন হচ্ছে গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত। জনগণের ইচ্ছায় গঠিত সরকার পদ্ধতি প্রতিষ্ঠিত করা এবং চালিয়ে রাখার জন্য নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই বলে জাতিসংঘের মানবাধিকার ঘোষণাপত্রের ২১ অনুচ্ছেদে নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। বিএনপির নেতা-কর্মীরা কিছুদিন আগ পর্যন্তও বলছিল, ২০২৪ সালের জানুয়ারির নির্বাচন হবে না। কিন্তু জাতীয় পার্টির মতো একটি বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ দল, বিএনপি থেকে বেরিয়ে যাওয়া তৃণমূল বিএনপি, বিএনএম ছাড়াও বিএনপির অনেক নেতা-কর্মী নির্বাচনে অংশ নিয়ে অথবা অংশগ্রহণকারীদের নির্বাচনি কর্মসূচিতে জড়িত হয়ে পড়ায়, তাদের সেই দাবি আর ধোপে টেকেনি। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের যে কটি দেশ অতীতে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা বলছিল, তারাও এখন আর সে কথা বলতে পারছে না এটি দেখার পর যে নির্বাচন শুধু অংশগ্রহণমূলকই হচ্ছে না, বরং অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি প্রতিযোগিতার আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
দ্য রেপ্রেজেন্টেশন অব দি পিপলস অর্ডার ৭২-এর (পরবর্তীতে একাধিকবার পরিবর্তিত এবং পরিবর্ধিত) ৭৩ অনুচ্ছেদের বিভিন্ন উপ-অনুচ্ছেদে নির্বাচনসংক্রান্ত যেসব অপরাধসমূহের উল্লেখ রয়েছে, তার অন্যতমটি হচ্ছে কোনো ব্যক্তিকে ভোটদানে বিরত থাকার জন্য প্রভাবিত করা। ৭৩(৬) অনুচ্ছেদের ভাষ্যমতে, ভোট কেন্দ্রে হাজির কোনো ব্যক্তিকে ভোট না দিয়ে প্রস্থান ঘটাবার চেষ্টা একটি কঠিন শাস্তিযোগ্য অপরাধ, যার জন্য অন্যূন সাত বছর সশ্রম কারাদন্ড হতে পারে। ৭৭(১) অনুচ্ছেদে লিখিত বিধান অনুযায়ী, কোনো নির্বাচনে কোনো ব্যক্তিকে ভোট দেওয়ার জন্য বা ভোটদানে বিরত থাকার জন্য চেষ্টা করা বা কারও প্রার্থিতা প্রত্যাহারের জন্য তাকে প্ররোচিত করাকেও অপরাধভুক্ত করা হয়েছে। কোনো শক্তি, হিংস্রতা বা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির জন্য ভয় দেখানো, ভোট দেওয়া থেকে কোনো ব্যক্তিকে বিরত রাখার জন্য বাধ্য করতে অপহরণ, জবরদস্তিতা বা প্রতারণামূলক ফন্দি আঁটা বা কৌশল দ্বারা কোনো ভোটারের স্বাধীন ভোটাধিকার প্রয়োগ বাধাগ্রস্ত করা, কোনো ভোটারকে ভোট দিতে বা ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকতে বাধ্য, প্ররোচিত বা উদ্বুদ্ধ করা সবই কঠোর শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ৮২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি কোনো ভোটারকে বাধা দিলে বা দেওয়ার চেষ্টা করলে সেও শাস্তিযোগ্য অপরাধের দায়ে দন্ডিত হবে।
এর ফলে তারা আজ দিশাহারা হয়ে পড়ে অধিকতর সন্ত্রাসের দিকে ঝুঁকছে, নির্বাচন বন্ধ করার জন্য আদাজল খেয়ে নেমেছে। তাদের সন্ত্রাসী কর্মকান্ড দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে বিঘ্ন ঘটাতে পারে। নির্বাচনের দিন ঘনিয়ে আসার সময় তারা যেন নৈরাজ্যের সৃষ্টি করতে না পারে, সেজন্য এদের এবং এদের হুকুমদাতাদের বিরুদ্ধে এখনই ফৌজদারি ব্যবস্থা গ্রহণ অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।
সন্ত্রাসজনিত অপরাধ যে বিশ্বব্যাপী অত্যন্ত মারাত্মক বলে বিবেচিত, তার প্রমাণ পাওয়া গেল সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের দুটি অঙ্গরাজ্যে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার অযোগ্য ঘোষণা করা থেকে। প্রথমত, কলোরাডো অঙ্গরাজ্যের শীর্ষ আদালত হেন সিদ্ধান্ত নেওয়ার কয়েকদিন পর মেইন অঙ্গরাজ্য প্রশাসনিক নির্দেশ দ্বারা একই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে, যা এখন আদালতের সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষমাণ। ধারণা করা হচ্ছে, আরও কিছু অঙ্গরাজ্যও একই সিদ্ধান্ত নিতে পারে। জনসাধারণকে নির্বাচন বর্জনের জন্য প্ররোচনাকারী এবং তাদের হুকুমদাতাদের বিচারের ব্যবস্থা করলে তা যেন বহির্বিশ্বে ভুল ব্যাখ্যা না পায় বা বিভ্রান্তিকরভাবে উপস্থাপিত না হয়, সেজন্য এসব অপরাধীর কর্মকান্ড, যথা প্রকাশ্য ঘোষণা, লিফলেট বিতরণ, ইত্যাদি বিশ্বব্যাপী জানান দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
লেখক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি