শুক্রবার, ৫ জানুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

সকাল জানান দেয় দিনটি কেমন যাবে

মেজর নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ (অব.) পিএইচডি

সকাল জানান দেয় দিনটি কেমন যাবে

আজ থেকে ৪১৫ বছর আগে (৯ ডিসেম্বর ১৬০৮ সাল) লন্ডনে জন্মেছিলেন ইংরেজ মহাকবি জন মিলটন। তার বিখ্যাত কবিতা ‘প্যারাডাইস রিগেইন্ড’-এর একটি অংশে তিনি লিখেছেন, ‘শিশুকালেই মানুষের ভবিষ্যৎ প্রতিকৃতি ফুটে ওঠে- যেমনটা সকাল জানান দেয় দিনটি কেমন যাবে।’ সেই সূত্রে নতুন বছর ২০২৪ সালের প্রথম সকালে অভ্যাসমতো দিনের  পত্র-পত্রিকা ও ডিজিটাল জগতে থাকা বিভিন্ন মূলধারার গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত কিছু সংবাদ শিরোনাম দেখার মধ্য দিয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম বছরটা কেমন যাবে।

ঢাকা ট্রিবিউন, আলোকিত বাংলাদেশসহ বেশকিছু গণমাধ্যম বছরের প্রথম শীর্ষ খবর হিসেবে বেছে নিয়েছে লন্ডনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ইকোনমিকস অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চ (সিআইবিআর) থেকে প্রকাশিত একটি গবেষণা প্রতিবেদন। এ প্রতিবেদনে যুক্তি দিয়ে দেখানো হয়, ২০৩৮ সালের মধ্যে পৃথিবীর ১৯২টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার ২০তম হবে। দি ডেইলি স্টার পত্রিকায় বিশ্বের প্রথম ১০টি সর্বোচ্চ খাদ্য উৎপাদনকারী দেশের কাতারে বাংলাদেশের নাম থাকার সুখবর ঠাঁই পেয়েছে একই দিনের খবরে। দেশের শীর্ষস্থানীয় একজন তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকের মূল্যায়নকে উপজীব্য করে দি ডেইলি সানের আশাবাদ ২০২৪ সাল হবে তৈরি পোশাক খাত ঘুরে দাঁড়ানোর বছর। এরকম বেশকিছু ইতিবাচক খবর পড়ে অনেক আশায় বুক ভরে উঠেছিল। কিন্তু পরক্ষণে তাতে ছন্দপতন ঘটাল বছরের এই প্রথম দিনেই গণমাধ্যমে প্রকাশিত কিছু নেতিবাচক খবর।

এদিন বাংলাদেশ প্রতিদিনের শিরোনাম- দখলের জমি মন্ত্রীকে উপহার, বিএনপির আট নেতার জেল, সব দূতাবাসে বিএনপির চিঠি, পাঁচ আসন থেকে সরে দাঁড়াল জাতীয় পার্টি ইত্যাদি। দৈনিক প্রথম আলোর অর্থনীতি পাতার খবর অনিয়মের কারণে তারল্য সংকটে থাকা সাতটি ব্যাংকে বিরল সুবিধায় ২২ হাজার কোটি টাকা ধার দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক, যাতে এ ব্যাংকগুলো বছর শেষে অন্তত প্রকৃত চিত্রের বদলে তাদের তহবিলে টাকা আছে, তা দেখানোর সুযোগ পায়। দৈনিক কালের কণ্ঠ শিরোনাম করেছে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ২২ শতাংশ মানুষ। ডেইলি স্টার ও দৈনিক সমকাল পত্রিকায় উঠে এসেছে নগদ টাকার সংকটের কারণে বাজারে বন্ড ছেড়ে টাকা সংগ্রহ ও বিদ্যুতের দায় শোধের খবর, যে ব্যবস্থাকে লাইফ সাপোর্টের সঙ্গে তুলনা করেছেন অর্থনীতিবিদ ড. এম এ রাজ্জাক। প্রথম পাতায় দৈনিক আজকের পত্রিকা তুলে ধরেছে সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার এক নেতার বক্তব্য। তিনি তার ভাষায় ডাইরেক্ট অর্ডার দিয়ে বলেন কেউ যদি ‘... লিফলেট দিয়ে বলে নির্বাচনে যায়েন না, তাদের ধরেন। হাত-পা কেটে ফেলবেন। ডাইরেক্ট অর্ডার।’ নতুন বছরের বাকি তিন দিনের খবরগুলো আরও ভয়াবহ।

এমন ভয়াবহতাকে মোকাবিলা করে ২০২৩ থেকে ২০৩৮, এই ১৫ বছরে দেশকে ২০তম শীর্ষ অর্থনীতির দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে যারা নীতিনির্ধারণ করবেন এবং দেশ ও জনগণকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেবেন, তারা আমাদের কর্ণধার তথা মন্ত্রী ও এমপি। সবকিছু বর্তমান সংবিধান মতো চললে এবং পাঁচ বছর পরপর জাতীয় সংসদ নির্বাচন হলে আসছে ১৫ বছরে (২০২৩-২০৩৮) আমরা এমন তিনটি নির্বাচন পাব, যার প্রথমটি হবে এ লেখাটি পড়ার ৭২ ঘণ্টারও কম সময়ে। তাই জানার আগ্রহ হলো আমাদের আগামীর দিকপালদের সম্পর্কে একটু ধারণা নেওয়ার। তাই আবারও ডুব দিলাম প্রিয় গণমাধ্যমে।

লালমনিরহাট-২ আসনের এক প্রার্থী নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া হলফনামায় পৈতৃক সূত্রে প্রাপ্ত ২৫ বিঘা কৃষিজমির মূল্য শতকপ্রতি ৩৮ টাকা ১৮ পয়সা বলে দাবি করেছেন, আর ৩৫ বিঘার ওপর প্রতিষ্ঠিত মৎস্য খামারের মূল্য মাত্র ৭০ হাজার টাকা দেখিয়েছেন। অথচ ৭০ হাজার টাকার এই মৎস্য খামার থেকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই তার আয় ছিল ১৩ লাখ ৫৭ হাজার ৫৬০ টাকা। এবার তিনি পৃথকভাবে মৎস্য খাতে কোনো আয় দেখাননি। সূত্র : বার্তা বাজার ১৩ ডিসেম্বর ২০২৩। পাবনা-৩ আসনের একজন প্রার্থী নিজেকে ১০০ টাকা বিঘা মূল্যের ২০ বিঘা জমির মালিক মর্মে তথ্য দিয়েছেন দাখিলকৃত হলফনামার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির ঘরে। অর্থাৎ ৩৩ শতকে ১ বিঘা হিসেবে তার মালিকানাধীন প্রতি শতক জমির মূল্য ৩ টাকা ৩ পয়সা। অন্যদিকে পাবনা-৪ আসনের এক প্রার্থীও জানান যে, ৫৬৭ টাকা শতক মূল্যের ৬৭ শতক জমির মালিক তিনি (সূত্র : দৈনিক আজকের বাংলাদেশ, ৭ ডিসেম্বর ২০২৩)। জামালপুর, সুনামগঞ্জ ও বি.বাড়িয়ার তিন প্রার্থীর পরিবারে থাকা স্বর্ণের ভরি প্রতি মূল্য ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা। বরিশাল-৬ আসনের একজন প্রার্থী ঢাকায় থাকা ৫ কাঠা প্লটের মূল্য ৪ হাজার টাকা ও ছয় তলা বাড়িবিশিষ্ট ৩ কাঠা প্লটের মূল্য ২৯ হাজার টাকা বলে হলফনামায় উল্লেখ করেছেন (সূত্র : দৈনিক কালবেলা ১৪ ডিসেম্বর ২০২৩)।

উল্লেখ্য, নিজের জমির মূল্য একইভাবে দেখানো আছে অধিকাংশ প্রার্থীর আয়কর নথিতেও। তারপর পাঁচ বছর পরপর তাদের সম্পদ বৃদ্ধি ঘটতে থাকে জ্যামিতিকহারে। অথচ একজন মন্ত্রী দলে কোটিপতি প্রসঙ্গে সম্প্রতি বলেছেন যে, গ্রামেও ১ কাঠা জমির দাম ২০ লাখ টাকা, ৫ কাঠা জমির দাম ১ কোটি টাকা। আর ঢাকা শহরে ১ কোটি টাকার নিচে কোথাও কোনো জমি নেই (সূত্র : দৈনিক প্রথম আলো, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৩)। আসছে সংসদে নিশ্চিত ব্যয়ের পথে থাকা এই সত্যবাদী মন্ত্রী মহোদয় বিষয়টি তুলে ধরলেই আগামীতে এমনটি রোধ করা সম্ভব হবে। অন্যদিকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে জমির মূল্য কম দেখানোর পরও দুর্নীতিবিরোধী সংগঠন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) সম্প্রতি এক পর্যবেক্ষণে একটি দলের ৮৭ শতাংশ প্রার্থী কোটিপতি বলে উল্লেখ করেছে। গত ১৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবসায়ী অংশ নিচ্ছেন এবারের নির্বাচনে এবং প্রার্থীদের পেশা বিবেচনায় ব্যবসায়ীর সংখ্যা ৫৭ দশমিক ৩৪ শতাংশ। নাম গোপন রেখে এক মন্ত্রীর সম্পদের হিসাব তুলে টিআইবি বলেছিল, দেশের বাইরে ওই মন্ত্রীর ২৩১২ কোটি টাকার সম্পদ থাকলেও সে তথ্য হলফনামায় দেওয়া হয়নি। আর ২৯ ডিসেম্বর ২০২৩ তারিখে একজন মন্ত্রীর নাম উল্লেখ করেছেন, যুক্তরাজ্যে যার ১৮৮৮ কোটি টাকা মূল্যের অন্তত ২৬০টি সম্পত্তি তথা বাড়িঘর রয়েছে। এর মধ্যে ১৭৭ কোটি ১ লাখ টাকা মূল্যের একটি বাড়ি কেনা হয়েছে ২০২১ সালের ১৬ জুলাই। ওপরে উল্লিখিত প্রার্থীদের সবাই সংবিধান মেনেই নির্বাচন করছেন এবং তারা যে জয়লাভ করবেন সেটাও নিশ্চিত। আইনের দৃষ্টি এবং আয়কর অধ্যাদেশের আলোকে সম্পদের মূল্য প্রকাশ বা বিদেশের সম্পদ গোপনের ক্ষেত্রে তারা হয়তো কোনো ভুল করেননি। তাই দেশের প্রচলিত আইনে তারা সর্বদাই আমাদের সবার অহংকার ও শ্রদ্ধার পাত্র। তবে নৈতিকতার মানদন্ডে তাদের অবস্থান নিশ্চয়ই প্রশ্নের সম্মুখীন। তবে আশার কথা আমাদের একজন লৌহ মানবী আছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি একঝাঁক তরুণ-তরুণীর সঙ্গে সরাসরি প্রশ্নোত্তর পর্বে বলেছেন যে, ঢাকা শহরে তার কোনো বাড়িঘর নেই। তাই অবসর জীবনে গ্রামে চলে যাবেন এবং গ্রামেই থাকবেন। তিনি অন্তত এ বিষয়টি যৌক্তিকভাবে দেখবেন বলেই প্রত্যাশিত। কারণ দেশের প্রচলিত আইন সংশোধনের দায়িত্ব তো এই মহান সংসদের এবং সংসদ মানেই তো এই জনপ্রতিনিধিরা।

দুঃখজনক হলেও সত্য, সম্পদ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে একদল সংসদ সদস্যের যেমন সাফল্য, তার এলাকার মানুষের দুঃখ-দুর্দশা লাঘবে তাদের সেই সাফল্য লক্ষ্য করা যায় না। ব্রিজ হলেও বছরের পর বছর রাস্তা হয়নি এমন খবর হরহামেশাই প্রকাশ পায় গণমাধ্যমে। অতিসম্প্রতি একটি রাস্তাবিহীন ব্রিজে ওঠার জন্য কাটা নারিকেল গাছ দিয়েছে এলাকাবাসী। ভবন আছে-জনবল ও সরঞ্জাম নেই, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে-শিক্ষক নেই, হাসপাতাল আছে-ডাক্তার নেই, পদোন্নতি আছে-পদ নেই এমনতর পরিস্থিতির উন্নতিতে সংসদের ভূমিকা প্রয়োজন। টেলিভিশনের একটি সাম্প্রতিক টকশোতে একজন বিজ্ঞ সাংবাদিক উল্লেখ করেছেন, আমাদের এই ঢাকা মহানগরীর ১৮ জন সংসদ সদস্য মহান সংসদে আমাদের প্রতিনিধিত্ব করেন। ঢাকার আশপাশের এলাকারও এমন আরও ১৮ জন আছেন। অথচ ঢাকা শহর বছরজুড়ে বায়ুদূষণের দিক থেকে বিশ্বের সবচেয়ে নিকৃষ্ট শহরগুলোর একটির তকমা পেয়ে যাচ্ছে। এ বিষয়ে একটি কার্যকরী আইন প্রণয়ন কিংবা প্রচলিত আইনের কঠোর বাস্তবায়ন করে অবস্থার উন্নয়নের জন্য মহান সংসদে একযোগে এই সংসদ সদস্যদের আমরা কখনো বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে দেখিনি। এমনটা নগরবাসীর জন্য দুর্ভাগ্যজনক। আসছে মহান সংসদে যারা দেশ ও জনগণের প্রতিনিধিত্ব করবেন এবং দেশকে বিশ্বের বৃহৎ ২০টি অর্থনীতির দেশের একটিতে নিয়ে যাবেন, তাদের জন্য আগাম অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা।  মহান সংসদ হোক জাতির আশা-আকাক্সক্ষা পূরণের সূতিকাগার। নইলে কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ‘প্রতীক্ষা’ কবিতার মতো আমরা কেবল বলেই যাব ‘... অভাব হয়তো স্বভাবেরই অগ্রজ... অতএব কারো পথ চেয়ে লাভ নেই ... বিরূপ বিশ্বে মানুষ নিয়ত একাকী। অনুমানে শুরু, সমাধা অনুশ্চয়ে, জীবন পীড়িত প্রত্যয়ে প্রত্যয়ে : অথচ পাব না আমি আপনার দেখা কি?’

লেখক : গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট

email: [email protected]

সর্বশেষ খবর