শুক্রবার, ৫ জানুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

দিনরাতের আবর্তনে রয়েছে মাবুদের নিদর্শন

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

দিনরাতের আবর্তনে রয়েছে মাবুদের নিদর্শন

দিন শেষে রাত আসে। রাত শেষে আসে ভোর। এভাবেই এক দিন কেটে যাবে জীবনের ঘোর। তখন হুঁশ ফিরলেও সময় ফিরবে না। বিদায়ঘণ্টা যখন কারও বাজবে ‘বিদায়’ নেওয়ার সুযোগও পাওয়া যাবে না আর। মহান স্রষ্টা আল্লাহতায়ালার এটাই বিধান। রঙের দুনিয়ায় মানুষ নামক রঙিলা সৃষ্টিকে ছেড়ে দিয়েছেন তিনি। তাঁর ইচ্ছা, রঙিলা মানুষ কতটা সফেদ হয়ে তার কাছে আসতে পারে সেটা পরখ করা। তাই তো তিনি পৃথিবী নামক গ্রহটি সাজিয়েছেন দিনরাতের রং দিয়ে। যারা রঙের কারিগর মাবুদ রাব্বানার রং খেলা সম্পর্কে চিন্তা করেন তারা জানেন এ কোনো নিছক খেলা নয়। পেছনে রয়েছে এক মহৎ উদ্দেশ্য। পবিত্র কোরআনেও এ কথাই বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয় মহাকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টিতে, দিনরাতের আবর্তনে জ্ঞানীদের জন্য নিদর্শন রয়েছে। তারা দাঁড়িয়ে, বসে বা শুয়ে আল্লাহকে স্মরণ করে। তারা মহাকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টির রহস্য নিয়ে গভীর ধ্যানে নিমগ্ন হয় এবং বলে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি এসব অনর্থক সৃষ্টি করোনি! তুমি মহাপবিত্র! আগুনের শাস্তি থেকে তুমি আমাদের রক্ষা কর (সুরা আলে ইমরান ১৯০-১৯১)। দিনরাতের নিদর্শন আল্লাহর অসীম কুদরতের নিদর্শন; তাঁর সীমাহীন শক্তি ক্ষমতা ও রাজত্বের নিদর্শন, তিনি সর্বশক্তিমান হওয়ার নিদর্শন, তিনি যা ইচ্ছা তা-ই করতে পারেন এবং তাঁর ইচ্ছাতেই জগতের ছোট-বড় সব বিষয় সংঘটিত হওয়ার নিদর্শন। রাতদিনের আবর্তন যে আল্লাহতায়ালার বহু নিদর্শনের ধারক- বিষয়টি পবিত্র কোরআনের আরও অনেক আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। যেমন- সুরা বাকারার ১৬৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘রাতদিনের আবর্তনের মধ্যে বুদ্ধিমানদের জন্য রয়েছে বহু নিদর্শন।’ সুরা ইউনুসের ৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, রাতদিনের আবর্তনের মধ্যে নিদর্শন রয়েছে মুত্তাকিদের জন্য।

আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আপন মেহেরবানিতেই তিনি তোমাদের জন্য রাত ও দিন সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা রাতে বিশ্রাম করতে পার আর দিনে তাঁর অনুগ্রহ সন্ধান করতে পার; এবং যাতে তোমরা শোকর আদায় করতে পার’ (সুরা কাসাস-৭৩)। দিনরাতের আবর্তন নিয়ে চিন্তা করলে আমরা দেখতে পাব এ পৃথিবীতে আসলে কোনো কিছুই স্থায়ী নয়। সময়ের চক্র ঘুরছে। যে মুহূর্তটি চলে যাচ্ছে তা আর ফিরে আসছে না। যে সুযোগ একবার হাতছাড়া হয়ে যায় সেটা আর পাওয়া যায় না। তেমনি আমাদের জীবনপ্রদীপ একবার নিভে গেলে ফের জ¦ালানোর আর কোনো সুযোগ থাকবে না। এক আল্লাহর ওলি বলতেন, বাবারা! দুনিয়ায় কোনো পরীক্ষায় এ বছর ফেল করলে পরের বছর আবার পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ পাওয়া যায়। দুনিয়ায় কোনো মামলায় একবার হারলে আবার আপিল করার সুযোগ থাকে। কিন্তু আখেরাত এমন এক জগৎ, একবার যদি ফেল কর, একবার যদি হেরে যাও তাহলে দ্বিতীয়বার সেখানে আর কোনো সুযোগ পাওয়া যাবে না। তাই সময় অবহেলা কর না।’

দিনরাতের সৃষ্টি নিয়ে গবেষণা করলে পাওয়া যাবে স্রষ্টার পরিচয়। কেননা দিনরাত দুটোই সৃষ্টি করেছেন আল্লাহতায়ালা। শুধু তাই নয়, দিনরাতের মূল উপাদান সূর্য ও চাঁদ এ দুটোও আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন। বান্দা যখন গবেষণা করে দেখবে দিনরাত, চাঁদ-সূর্য আল্লাহর সৃষ্টি তখন সে আরও একটি মহাসত্যের মুখোমুখি হবে। সে দেখবে রাতদিন ও চাঁদ-সূর্য আসলে আল্লাহর ইবাদত করছে। তাদের ইবাদতের পদ্ধতি হলো নিজ নিজ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করা। যেমনটি বলা হয়েছে এ আয়াতে- ‘দিনরাতের আবর্তন, এটা তাঁরই মহিমা। সূর্য ও চন্দ্র তিনিই সৃষ্টি করেছেন। এরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ কক্ষপথে বিচরণ করে’ (সুরা আম্বিয়া-৩৩)। অন্য আয়াতে এসেছে, ‘নিশ্চয়ই তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহ। তিনি মহাকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন সময়ের ছয় স্তরে। তারপর তিনি আরশে সমাসীন হন। তিনি দিনরাতের আবর্তন ঘটান। সূর্য, চন্দ্র ও নক্ষত্ররাজি তাঁরই সৃষ্টি, তাঁরই আজ্ঞাবহ। সৃষ্টি করা ও আদেশ দেওয়ার সার্বভৌম ক্ষমতা শুধু তাঁর। তিনি মহাবিশ্বের প্রতিপালক, মহামহিম (সুরা আরাফ-৫৪)।’ রাতদিনের মহিমা বর্ণনা করে অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘হে নবী! আপনি বলুন, ‘সব ক্ষমতার মালিক হে আল্লাহ! তুমি যাকে ইচ্ছা ক্ষমতা দান কর। যাকে ইচ্ছা ক্ষমতাচ্যুত কর। যাকে ইচ্ছা সম্মানিত কর। যাকে ইচ্ছা অপমানিত কর। তুমি সর্বশক্তিমান। সব কল্যাণ ও মঙ্গলের আধার। তুমি রাতকে বড় করে দিনকে ছোট কর, আবার দিনকে বড় করে রাতকে ছোট কর। তুমি প্রাণহীনকে দাও প্রাণ আর প্রাণবন্তকে কর প্রাণহীন। তুমি যাকে চাও বেহিসাব রিজিক দান কর’ (সুরা আলে ইমরান-২৭)। অন্য আয়াতে আল্লাহ রাতদিন বড়-ছোট করাকে আজাব হিসেবে উল্লেখ করে আমাদের ভয় দেখিয়েছেন। আল্লাহ বলেন, ‘তুমি বলো, তোমরা ভেবে দেখেছ কী, আল্লাহ যদি তোমাদের ওপর রাতকে কেয়ামত পর্যন্ত স্থায়ী করে দেন, তবে আল্লাহ ছাড়া আর কোনো মাবুদ আছে, যে তোমাদের আলো এনে দিতে পারে? তবে কি তোমরা শুনতে পাও না? তুমি বলো,  তোমরা ভেবে দেখেছ কি, আল্লাহ যদি তোমাদের ওপর দিনকে কেয়ামত পর্যন্ত স্থায়ী করে দেন, তবে আল্লাহ ছাড়া আর কোনো মাবুদ আছে, যে তোমাদের একটি রাত এনে দেবে, যাতে তোমরা বিশ্রাম করবে? তবে কি তোমরা দেখতে পাও না’ (সুরা কাসাস ৭১-৭২)।

লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মুফাসসির সোসাইটি, পীর সাহেব আউলিয়ানগর

সর্বশেষ খবর