শনিবার, ৬ জানুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

গোলাম মুস্তাফা ও সুবর্ণা মুস্তাফা

ইমদাদুল হক মিলন

গোলাম মুস্তাফা ও সুবর্ণা মুস্তাফা

প্যাকেজ নাটক ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হচ্ছে। আমি নিজে একটি নাটক তৈরির কোম্পানি খুলেছি। নাম ‘নির্বাচিতা’। কয়েকটি একঘণ্টার নাটক তৈরির পর ‘যুবরাজ’ নামে একটা সিরিজ লিখলাম ১৩ পর্বের। আমি নিজেই পরিচালক। কাজটা খুব ভালো জানি না বলে বিটিভির প্রযোজক রিয়াজউদ্দিন বাদশাকে নিয়েছি নাটকটি সুন্দরভাবে তুলে দেওয়ার জন্য। নায়িকার বাবার চরিত্রে শ্রদ্ধেয় গোলাম মুস্তাফা। শমী কায়সার তিনটি চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। দিলারা জামান, তৌকীর, চিত্রলেখা গুহ ওঁরা ছিলেন অন্যান্য চরিত্রে। চিত্রলেখা গুহ হয়েছেন মুস্তাফা আঙ্কেলের স্ত্রী, শমীর মা। আমরা শুটিং করছি হোতাপাড়ায়। প্রথম দিন শুটিংয়ে এসে মুস্তাফা আঙ্কেল আমাকে বললেন, ‘শোনো মিলন, তুমি চিত্রাকে আমার স্ত্রী বানিয়েছ। আরে ও তো সুবর্ণার চেয়েও বয়সে ছোট।’ সঙ্গে তাঁর জগৎ ভোলানো হাসি। এই লেখা আসলে সেই মহান অভিনেতা গোলাম মুস্তাফাকে নিয়ে। কবে, কোন সিনেমায় তাঁকে প্রথম দেখেছিলাম সে কথা বলার জন্য অনেক দূর পেছনে ফিরে যাচ্ছি। 

টিফিন পিরিয়ডে হিরা আমাকে চুপিচুপি বলল, ‘আমাদের হলে ‘চাওয়া পাওয়া’ নামে একটা সিনেমা এসেছে। এখন স্কুল থেকে পালালে ম্যাটিনিশোতে দেখা যাবে। চল, পালাই।’ আমি ভয় পেয়ে গেলাম। ‘কাল স্কুলে এলে স্যার তো ধরবেন। তখন কী করব?’ হিরা বলল, ‘এত কিছু ভাবলে স্কুল পালানো যায় না। কালকেরটা কালকে দেখা যাবে। দু-চারটা বেতের বাড়ি খেতে হলে খাব। সিনেমা দেখে একটু মার খেলে কী হয়?’ আমরা দুজন বইখাতা বগলে নিয়ে পালিয়ে গেলাম। ১৯৬৭ সালের কথা। গেন্ডারিয়া হাইস্কুলে ক্লাস সেভেনে পড়ি। হিরার সঙ্গে খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়েছে। দীননাথ সেন রোডে ওদের বাড়ি। ওর বাবা বড় ব্যবসায়ী। দুটো দামি গাড়ি সব সময় বাড়ির লনে। বছর দেড়েক আগে পোস্তগোলায় ‘ডায়না’ নামে হিরার বাবা একটা সিনেমা হল করেছেন। নতুন আধুনিক সিনেমা হল। ওই এলাকার ধারেকাছে কোনো সিনেমা হল নেই। হলটি শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দারুণ জমে গেছে। রোববার ছুটির দিন মর্নিংশোতে ইংরেজি সিনেমা চলে। হিরা আমাদের কখনো কখনো মাগনা সিনেমা দেখাতে নিয়ে যায়। সে মালিকের ছেলে, দাপটই আলাদা। আমরা তখনো বাজারের পয়সা চুরি করে সদরঘাটের ‘রূপমহল’ রায়সাহেব বাজারের ওখানকার ‘মুকুল’ সিনেমায় বা ওয়াইজঘাটের ‘মায়া’ হলে বড়জোড় মিডলস্টলের টিকিট কেটে সিনেমা দেখতে পারি। বেশির ভাগই দেখি ফ্রন্টস্টলে। তখন ১৬ আনায় এক টাকার হিসাব। ফ্রন্টস্টলের টিকিট ছয়আনা। ওই ছয়আনা জোগাড় করতেই পাঁচ-সাতদিন বাজার থেকে চুরি করতে হতো। ফ্রন্টস্টল হচ্ছে পর্দার একেবারে লাগোয়া। মধ্য আকাশের চাঁদ দেখার মতো মাথা তুলে পর্দার দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। ঘাড় ব্যথা হয়ে যায়। তারপরও সিনেমা দেখার সেই আনন্দের কোনো তুলনা হয় না। ‘মুকুল’ সিনেমা হলটির নাম বদলে ‘আজাদ’ হয়ে গেল। ‘নিশাত’ সিনেমা হলের নাম হলো ‘মানসি’। ‘নাগরমহল’-এর নামও বোধহয় বদলে গেছে। হলটি এখনো আছে কিনা জানি না। ইংলিশ রোডে ছিল। ‘মায়া’ হয়ে গেল ‘স্টার’। তার উল্টো দিকে বেশ আধুনিক কায়দায় তৈরি হলো ‘মুন’ সিনেমা। ইসলামপুরে ছিল ‘লায়ন’, আরমানিটোলায় ‘সাবিস্তান’। ‘গুলিস্তান’ সিনেমা হলের নিচের তলায় ছিল ‘নাজ’। ছোট্ট সুন্দর সেই হলটিতে সারা বছরই ইংরেজি সিনেমা চলত। গুলিস্তান এলাকা বিখ্যাতই ছিল ‘গুলিস্তান’ সিনেমা হলটির জন্য। প্রথমে বন্ধ হলো ‘নাজ’। তারপর হলো ‘গুলিস্তান’। ‘লায়ন’ সিনেমা হলটি বন্ধ হয়ে সেখানে কাপড়ের মার্কেট হয়েছে। ‘মুন’ হলটিও বন্ধ হয়ে গেছে। ‘রূপমহল’ বন্ধ হয়ে গেছে। ‘নাগরমহল’ বা ‘সাবিস্তান’ও বোধহয় নেই। আর আমাদের ছেলেবেলায় কী জমজমাট এসব সিনেমা হল। প্রতি শুক্রবারে নতুন সিনেমা আসে। ঘোড়ার গাড়ি কিংবা রিকশায় করে মাইকে চলে সিনেমার প্রচারণা। লিফলেট বিতরণ করা হয়। পোস্টারে পোস্টারে ভরে যায় শহরের দেয়াল। নতুন বাংলা সিনেমা এলেই সেই সিনেমার গানের বাণী কবিতার মতো করে সাজিয়ে আট পৃষ্ঠার বুকলেট বের হয়। দাম দুআনা। আমার ফজলকাকা সেই লিফলেট কিনে গান মুখস্থ করতেন। আমাকেও দুয়েকটা মুখস্থ করাতেন। যখন জিন্দাবাহারে থাকতাম তখন প্রতিমাসে পরিবার নিয়ে সিনেমা দেখতে যেতেন আব্বা। তখনো আমি বোধহয় স্কুলে ভর্তি হইনি। পাঁচ সাড়ে পাঁচ বছর হবে বয়স। উত্তম কুমারের ‘পৃথিবী আমারে চায়’ দেখাতে রূপমহলে নিয়ে গেছেন আব্বা। উত্তমের ঠোঁটে শ্যামল মিত্রের গান হচ্ছে ‘আমার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা থাকে’। ফজলকাকা আমাকে এই গানটা কয়েক লাইন শিখিয়েছিলেন। পর্দায় উত্তম কুমারকে ওই গান গাইতে দেখে এতই উত্তেজিত হলাম, পরিবেশ ভুলে উত্তম কুমারের সঙ্গে গলা মিলিয়ে গাইতে লাগলাম। আমরা বসেছি মিডলস্টলে মানে সেকেন্ডক্লাস। পাশ থেকে ঢাকাইয়া এক লোক ঠাট্টা করে আমাকে একটা ধমক দিল। ‘ওই পিচ্চি থাম’। একা একা প্রথম সিনেমা দেখেছিলাম ‘লায়ন’ সিনেমা হলে। সিনেমার নাম ‘হনুমান পাতাল বিজয়’। রামায়ণের কাহিনি থেকে নেওয়া। কিছুদিন আগে হঠাৎ মনে হলো উত্তম সুচিত্রার পুরনো দিনের সিনেমাগুলো আবার একটু দেখি। সাদাকালো সে সব সিনেমা কী যে মুগ্ধ হয়ে দেখলাম! ‘পৃথিবী আমারে চায়’ সিনেমার নায়িকা ছিলেন মালা সিনহা। চমৎকার সব গানে ভরা সিনেমা। দুর্দান্ত অভিনয় একেকজনের। বিনোদনে টইটম্বুর। পর পর দু’বার দেখলাম সিনেমাটা। সমান আনন্দ পেলাম।

এসব সিনেমার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে একটার পর একটা সিনেমা তৈরি হচ্ছিল। সেসব সিনেমা দেখতেও হল ভেঙে পড়ত দর্শকে। আমাদের গেন্ডারিয়া হাইস্কুলের ধর্ম শিক্ষক ছিলেন ছোটখাটো অসামান্য সুন্দর দেখতে এক ভদ্রলোক। কথা বলতেন কম, পড়াতেন চমৎকার। তিনি ধর্মের মেধাবী শিক্ষক। আর তাঁর বড় ছেলে ঢাকার চলচ্চিত্রের বিখ্যাত অভিনেতা শওকত আকবর। যেমন লম্বা তেমন সুদর্শন। কতদিন শওকত আকবরকে দেখার জন্য তাঁদের দীননাথ সেন রোডের বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছি। ভাটিখানার ওদিককার এক গলিতে চমৎকার একটি দোতলা বাড়ি। সেই বাড়ি আলোকিত করেছিলেন নায়িকা সুচন্দা। তারপরে এলেন সুচন্দার মেজোবোন ববিতা। ববিতার ডাকনাম ছিল পপি। মনিজা রহমান গার্লস স্কুলে পড়তেন। তারও পরে এলেন এই দুই বোনের ছোটজন চম্পা। এক পরিবারের তিন কন্যার তিনজনই জনপ্রিয় নায়িকা, এ রকম ইতিহাস পৃথিবীর কোথাও আছে কিনা আমার জানা নেই। পরবর্তীকালে চম্পা আমার অনেক নাটকে অভিনয় করেছেন। ববিতাকে একদিন গেন্ডারিয়ার কথা বলাতে, পপি নামটা বলাতে তিনি খুব আনন্দিত হয়েছিলেন। গেন্ডারিয়া নিয়ে অনেকক্ষণ কথা বলেছিলেন আমার সঙ্গে। সুচন্দাকে এক অনুষ্ঠানে বললাম, ‘কোনো কোনো দিন বিকালে বাড়ির ছাদে উঠতেন আপনি। আর আমরা আপনাকে দেখার জন্য আপনাদের বাড়ির ওদিকে ঘুরঘুর করতাম।’ শুনে তিনি খুব হাসলেন। সুচন্দা বিখ্যাত ছিলেন তাঁর চোখের জন্য। অসামান্য একজোড়া চোখ নিয়ে জন্মেছিলেন তিনি। এক সময় শাবানাও থাকতেন গেন্ডারিয়ার পাশের ফরিদাবাদ এলাকায়। তিনিও বোধহয় মনিজা রহমানের ছাত্রী ছিলেন। তখন তার নাম ছিল রত্না। নাদিমের সঙ্গে ‘চকোরি’ নামে একটি সিনেমা করে দর্শকদের পাগল করে দিয়েছিলেন।

সেই দুপুরে হিরা আমাকে নিয়ে গেল তাদের ‘ডায়না’ সিনেমা হলে। হাউজফুল হয়ে গেছে। সে মালিকের ছেলে। এক্সটা দুটো চেয়ার দিয়ে দোতলার ডিসিতে আমাদের বসানো হলো। ডিসিতে সিনেমা দেখা আমাদের জন্য তখন কল্পনার বাইরে। টিকিটের দাম দু বা আড়াই টাকা। বড়লোকরা ওখানে বসে সিনেমা দেখে। আমরা তো ফ্রন্টস্টলের লোক। বড়জোর মিডলস্টল। হিরা নিয়ে গেছে বলে ডিসিতে বসার সুযোগ পেয়েছি। গভীর আনন্দে ভরে আছে মন। সেই মন আরও ভালো হয়ে গেল ‘চাওয়া পাওয়া’ সিনেমাটি দেখে। সিনেমার নায়ক গোলাম মুস্তাফা। রাজপুরুষের মতো একজন মানুষ। তাঁর সৌন্দর্যে ঝলমল করে উঠল ‘ডায়না’ সিনেমা হলের পর্দা। যেমন তাঁর রুচিস্নিগ্ধ পোশাক-আশাক তেমন তাঁর হাঁটাচলা, তেমন তাঁর কথা বলা। সব মিলিয়ে পরিপূর্ণ একজন অভিনেতা। অসম্ভব সুন্দর বাংলা-ইংরেজি উচ্চারণ। বেশ কয়েক দিন আচ্ছন্ন হয়ে থাকলাম এই সিনেমা দেখে। বিশেষ করে গোলাম মুস্তাফাকে দেখে। চোখ থেকে তাঁকে যেন সরাতেই পারি না। এই জীবন আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে। তখন ভুলেও কল্পনা করিনি এই মহান অভিনেতার সঙ্গে একদিন পরিচয় হবে। আমার অনেক সামান্য টিভি নাটক তাঁর অসামান্য অভিনয়গুণে সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে আর তাঁর কন্যা সুবর্ণা মুস্তাফা হবে আমার প্রিয়তম বন্ধু! সুবর্ণাকে একটা বই উৎসর্গ করে লিখেছিলাম- ‘তোমার তুলনা তুমি’। সুবর্ণার তুলনা সত্যি সুবর্ণা। এ বয়সেই সে অভিনয় জগতের কিংবদন্তি-যেমন কিংবদন্তি হয়ে আছেন তার পিতা গোলাম মুস্তাফা। পিতা ও কন্যা একই জগতে কাজ করে এ পর্যায়ে ওঠার ইতিহাস জগতে বিরল।

সেই সাতষট্টি সালের পর থেকে কত সিনেমায় যে গোলাম

মুস্তাফাকে দেখেছি! একেক সিনেমায় একেক রকমের চরিত্র। অসামান্য এক চরিত্রে অভিনয় করলেন ঋত্বিক ঘটকের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ সিনেমায়। কী শহরের উচ্চবিত্ত চরিত্রের অভিনয়, কী ভিলেন, কী গ্রামের জমিদার, কী নায়ক বা নায়িকার পিতা বা বড় ভাইয়ের চরিত্র, ধীরে ধীরে অনুভব করলাম গোলাম মুস্তাফা শুধু সিনেমা বা নাটকের তথাকথিত নায়ক হওয়ার জন্য জন্মাননি। তিনি একজন সম্পূর্ণ অভিনেতা। চরিত্রের সঙ্গে মিশে যেতে মুহূর্তকাল সময়ও লাগে না। আমাদের কিশোর বয়স থেকে অন্তত পঞ্চাশ-বায়ান্ন বছর গোলাম মুস্তাফার অভিনয় আমি সিনেমা আর টিভি নাটকে দেখেছি। কখনোই মনে হয়নি যে এই মহান অভিনেতার অভিনয় একঘেয়ে হয়ে গেছে। বড়পর্দা ছোটপর্দা যেখানেই তিনি উপস্থিত হয়েছেন, জায়গাটা আলোকিত হয়ে গেছে। প্যাকেজ নাটকের দ্বিতীয় নাটকটিই ছিল আমার লেখা। নাটকের নাম ‘কোথায় সে জন’। শমী কায়সার যমজ মেয়ের অভিনয় করেছিলেন। পরিচালক ছিলেন শহীদুল হক খান। এই নাটকে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়কার এক গ্রাম্য ডাক্তারের ছোট্ট একটি চরিত্র করেছিলেন গোলাম মুস্তাফা। যে কোনো রোগী দেখে প্রথমেই তিনি বলেন, ‘আরে তুই তো বাঁচবি না, তুই তো মরে যাবি।’ তারপর চিকিৎসা করে তাকে সারিয়ে তোলেন। ছোট্ট চরিত্র। কিন্তু তাঁর অসামান্য অভিনয়টুকুর কথা এই জীবনে আমি কখনো ভুলবো না। আমার ‘রূপনগর’ ধারাবাহিকে শহীদুজ্জামান সেলিমের বাবার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন তিনি। বোধহয় প্রথম পর্বেই বন্ধুদের হাতে খুন হয়ে যায় শহীদুজ্জামান সেলিম। তারপর একমাত্র পুত্র হারানো পিতার যে আর্তি গোলাম মুস্তাফা ফুটিয়ে তোলেন তা অনন্য।

কত পরিচয়ে পরিচিত ছিলেন গোলাম মুস্তাফা। রবীন্দ্রনাথ, শেকসপিয়র, নজরুল, জীবনানন্দ দাশ থেকে শুরু করে শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী বা রফিক আজাদ বা নির্মলেন্দু গুণ, ওপার বাংলার শঙ্খঘোষ, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় পাঠ করে তিনি মঞ্চ কাঁপিয়ে দিতেন। আবৃত্তি শিল্পে তিনি ছিলেন একক। ও রকম ভরাট ও আকর্ষণীয় আবৃত্তি শুধু তাঁকেই মানাত। শেকসপিয়র থেকে অবিরাম মুখস্থ বলে যেতে পারতেন। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ ঘণ্টার পর ঘণ্টা মুখস্থ বলে যেতেন। রেডিও নাটকেও ছিল তাঁর অসামান্য অবদান। এই মহতী শিল্পীর কথা বলে শেষ করা যাবে না। আমাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের এক মহিরুহ ছিলেন তিনি। এই অঙ্গনের অনেকখানি জায়গা একাই দখল করে রেখেছিলেন। তাঁর কন্যা সুবর্ণা মুস্তাফা আমার বন্ধু। আমি খুব গৌরব বোধ করি যখন ভাবি গোলাম মুস্তাফার কন্যা আমার বন্ধু। মুস্তাফা আঙ্কেল যখন বনানীর বাড়িতে থাকেন তখন অনেকবার গিয়েছি সেই বাড়িতে। সুবর্ণার বন্ধু হিসেবে কী যে স্নেহ করতেন আমাকে! আমার লেখালেখি নিয়ে কথা বলতেন। চা খেতে খেতে নিজের ফেলে আসা দিনের কথা বলতেন। সুবর্ণার মা ছিলেন বিদুষী নারী। রেডিওর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন। অভিনয় জগতেও ছিল তাঁর পদচারণা। এত শান্ত নম্র আর ব্যক্তিত্বময়ী আমি খুব কম দেখেছি। তাঁর বাড়িতে গেলেই কিছুক্ষণের জন্য এসে গল্প করে ভিতরে চলে যেতেন। চা-নাশতা পাঠাতেন। সুবর্ণা তার বাবাকে ‘বোবা’ বলে ডাকত। আর আমাদের কাছে তিনি মুস্তাফা আঙ্কেল। কী যে বন্ধুত্ব ছিল বাপ মেয়ের! নিজ চোখে না দেখলে তা বোঝা যাবে না।

মুস্তাফা আঙ্কেল চলে গেছেন অনেকগুলো বছর হয়ে গেল। আমিও নাটক লেখার জগৎ থেকে সরে এসেছি। রিয়াজউদ্দিন বাদশা চলে গেছেন অল্প বয়সে। ফরীদি চলে গেছে। আমরা টেলিভিশনের জন্য যে নাটকের জগৎ তৈরি করেছিলাম সেই জগৎটা বিষণœ হয়ে গেছে। টেলিভিশনে আমার প্রথম নাটক ছিল ‘মায়াকানন’। তখনকার জনপ্রিয়তম জুটি সুবর্ণা আর আফজাল অভিনয় করল। তার পরের নাটক ‘সখা তুমি সখী তুমি’।

এখানেও নায়িকা সুবর্ণা। তার বিপরীতে হুমায়ূন ফরীদি। আমার ধারাবাহিক ‘বারো রকম মানুষ’ সুবর্ণার অভিনয়গুণে জনপ্রিয়তার চূড়ান্তে পৌঁছে গিয়েছিল। সেই সময়কার দর্শক এখনো ‘বারো রকম মানুষ’-এর কথা বলে। বিটিভির ফ্লোরে ‘বারো রকম মানুষ’-এর শুটিং চলছে। সুবর্ণার শট নেওয়া হচ্ছে। সেটে কে একজন খুব বকবক করছে। সুবর্ণা অভিনয় থামিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মিলন, ওটাকে ধরে গান্ধীপোকা আর নিমপাতা বেটে খাইয়ে দে।’ গান্ধীপোকা এবং নিমপাতা বাটার কম্বিনেশন, এ রকম ক্রিয়েটিভ চিন্তা সুবর্ণা মুস্তাফার পক্ষেই করা সম্ভব। আর সুবর্ণা হলো পরিষ্কার কথার মানুষ। স্পষ্টবাদী বলতে যা বোঝায়, তাই। ওর কথা শুনে কে খুশি হলো বা দুঃখ পেল তাতে সুবর্ণার কিছুই যায় আসে না। হুমায়ূন আহমেদের ধানমন্ডির বাড়ির গৃহপ্রবেশ হচ্ছে। সন্ধ্যাবেলা ছাদে আয়োজন। অনেকের সঙ্গে সুবর্ণা আর আমি পাশাপাশি বসে আছি।  পানাহার চলছে। একজন একটা হুইস্কির গ্লাস নিয়ে আমাকে খুব জোরাজুরি করছিলেন। আমি হুইস্কি খাই না। বেশ কয়েকবার বলার পরও তিনি থামছিলেন না। তিনিও একজন পরিচিত মানুষ। সুবর্ণা তাঁকে চেনে। এক পর্যায়ে সে খুবই বিরক্ত হলো। আমার দিকে তাকিয়ে, সেই লোককে শুনিয়ে কঠিন উচ্চারণে বলল, ‘মিলন, এই গরুটা কে রে?’

২০১৯-এ সুবর্ণা আর আমি ‘একুশে পদক’ পেলাম। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সুবর্ণাকে বিশেষ স্নেহ করেন। স্টেজে সুবর্ণা তাঁকে বললেন, ‘আপা, আমি আর মিলন বহু দিনের বন্ধু।  আমরা আপনার দুপাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে চাই।’ সেই ছবি আমি বাঁধিয়ে রেখেছি। প্রতিদিনই কোনো না কোনো সময় ছবিটির দিকে তাকাই। মুস্তাফা আঙ্কেলের কোনো ছবি আমার কাছে নেই। তবে তাঁর অনেক ছবি আমি আমার মনের ফ্রেমে বাঁধিয়ে রেখেছি। এই অমর অভিনেতার জন্য অনেক অনেক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।

                লেখক : কথাসাহিত্যিক ও প্রধান সম্পাদক, কালের কণ্ঠ

সর্বশেষ খবর