শিরোনাম
রবিবার, ৭ জানুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

ভোটের জল্প ভোটের কল্প

আবু তাহের

ভোটের জল্প ভোটের কল্প

একানব্বই সালের সংসদ নির্বাচনের প্রচারণা যখন তুঙ্গে সেই সময়টায় এক প্রাক-সন্ধ্যায় আমার তদানীন্তন দফতরে এলেন সৈয়দ মোফাকখারুল ইসলাম। রাজধানীর বংশাল রোডে ‘সংবাদ’ অফিসে তার সঙ্গে আমার পরিচয়। সেখানে তিনি চিফ-সাব এডিটর মোজাম্মেল হোসেন, আমাদের প্রিয় ‘মন্টুদা’র কাছে আসতেন। মন্টু ভাই তাকে ডাকেন ‘মোফাভাই’। ব্রিটিশ আমলের গ্র্যাজুয়েট সৈয়দ মোফাকখারুল বয়সের ভারে ন্যুব্জ হলেও ধারণ করেন অন্তর্ভেদী দৃষ্টি। চোখে পুরুলেন্সের চশমা, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। দন্তহীন পুরুষ কিন্তু কণ্ঠস্বর খনখনে। গলায় সব সময় ঝোলানো কাপড়ের ব্যাগ।

জীবনে অনেক কিছু দেখেছেন মোফাভাই। সুযোগ পেলেই কী কী দেখেছেন তা এ যুগের ফাজিল তরুণদের শোনান। বিস্তর পড়ালেখা তার। চমৎকার ইংরেজি বলেন। আমরা নিজেকে শিক্ষিত করার জন্য তাকে নানারকম প্রশ্ন করতাম। এসব প্রশ্নের কিছু কিছু যে তার ‘বিদ্যা কেমন’ জানার জন্য করা, সেটা তিনি বুঝতেন। বুঝে সহাস্যে বলতেন, ‘আমি বিক্রমপুইরা পোলা। আমারে মাইটা কড়াইতে টাইল্লা জুৎ করতে পারবেন!’ সেই প্রাক-সন্ধ্যায় মোফাভাই তার স্বভাব অনুযায়ী পরপর দুকাপ চা খেয়ে বিড়ি ধরালেন। আমরা জানতে চাই, ইলেকশনে কে জিতবে, ধান্য পার্টি নাকি মান্য পার্টি?

‘যারা কিছু না ছুঁয়ে খালি দেখে আর দেখে যায় আমি সেই বান্দা! আমি ধান্য সমর্থক হলে বলতাম ধান্য পার্টির বিজয় ঠেকায় কেডা! মান্য পার্টির সাপোর্টার হলে বলতাম, এই পার্টি যে জিতবই তাতে কোনো সন্দেহ নাই।’-বললেন সৈয়দ মোফাকখার, ‘কে জিতবে তা বলতে পারব না। কে হারবে তা জানি। বলব?’ সমস্বরে আমরা বলি, ‘জি বলুন। তাতেই চলবে।’ তিনি বললেন, ‘হারবে জনগণ। তাদের কাজ ওয়াদা শুনে মুগ্ধ হওয়া এবং ওয়াদা অনুযায়ী কিছু হচ্ছে না দেখে কাঁদা। কাঁদনের জীবন তো পরাজিতের জীবন।’ সৈয়দ মোফাকখারুলের মন্তব্য আমাদের স্তম্ভিত করে দেয়। সেদিন অর্থনৈতিক বিষয়েও কিছু কথা বলেছিলেন। তার মতে, যত দোষ-ত্রুটিই থাকুক নিয়মিত ভোট গরিবের জন্য স্বাস্থ্যপ্রদ। এতে গ্রামগঞ্জে পাড়ামহল্লায় বাদ্য বাজায় টংকা। কপট দরদিরা উদারহস্ত হয় তখন। তাতে করে জবেদ আলী সমেদ আলী ফুলবানু আলতা বেগমরা নগদ টাকা পায়, কয়েক দিনের তরে গরিবের উপকার হয়। পুষ্টিকর খাবার শরীরে শক্তি ঢোকায়। ক’দিন পরেই তো পেয়ে যাবে তোড়ায় ভরা ঘোড়ার ডিম। তখন কাঁদতে হবে না! কান্নার শক্তি অর্জন বিরাট ফ্যাক্টর।

ভোটভিত্তিক কোনো রচনাপ্রয়াসী হলেই দার্শনিক মোফাভাইয়ের স্মৃতি আমায় ঝাঁকুনি দেয়। স্বনামখ্যাত পার্লামেন্টারিয়ান সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে একবার সৈয়দ মোফাকখারের কাহিনি শোনাই। তিনি বলেন, ‘ইনার মতো যত মানুষের দেখা পেয়েছ তাদেরকে নিয়ে জল্পকল্প লিখে ফেলছ না কেন?’ বলেছি, ‘আপনার ওপরও লিখব।’ তিনি বলেন, ‘ও মাই গড! আমি তোমারে চিমটি কাটলাম কখন?’

বায়তুল মোকাররম মসজিদের পশ্চিম দিকে এক সময় ছিল স্টেডিয়ামের টিকিটঘর। এই ঘরের ছাদকে মঞ্চ বানিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো জনসভা করত। আমরা কয়েক বন্ধু প্রায়শ বিকালে বক্তৃতা শুনতে যেতাম। একবার দেখি সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বক্তৃতা করছেন-ক’দিন আগে গ্রামের বাড়িতে গেছিলাম। ভোরে ঘুম থেকে উঠে রাস্তায় হাঁটছি। স্বাস্থ্যরক্ষার হাঁটা আর কী? রাস্তার দুদিকে ফসলি মাঠ। চাষিরা কাজ করছেন। পরিচিত দুই চাষিকে দেখলাম, এরা বাপ-বেটা। দুজনই কাজ ক্ষান্ত দিয়ে দাঁড়িয়ে আমায় সালাম দেয়। বাপ জানতে চায়, ‘কত্তা ওইটা কবে?’ সুরঞ্জিত জানতে চান, কোনটা কবে? বাপ বলে, ‘ইলেকশন কত্তা’। সুরঞ্জিত জানান,  ইলেকশনের এখনো অনেক দেরি। হঠাৎ ইলেকশনের খোঁজ নিতেছ, ঘটনা কী? বাপ কৃষক বলে, ‘ইলেকশন ছাড়া তো আপনারা গ্রামে তেমন আসেন না, তাই আর কী।’

পাকিস্তান জমানায় আইউব খানের মৌলিক গণতন্ত্রের ফর্মুলায় অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনি প্রচারণায় অংশ নিয়েছিলাম নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলার একটি গ্রামে। একদিন প্রচারণায় এলেন জননেতা আবদুল মালেক উকিল। বক্তৃতায় বললেন, অ্যাডভোকেট শেহাবউল্লাহ সাহেব বছরের ৩৬৪ দিন থাকেন ঢাকায়। সেই মানুষটা এখানে চেয়ারম্যান হওয়ার খায়েশে এসেছেন। যারা সুখ-দুখে সব সময় আপনাদের পাশে থাকে তাদের বাদ দিয়ে উনারে চেয়ারম্যান বানানো কি উচিত হবে? জবাবে শ্রোতারা বলেন, ‘না। না।’ মালেক উকিল বলেন, ‘বেশ বেশ! বিষয়টা যখন বুঝেছেন, এবার উনারে দুরমুশ করেন।’

 

দুরমুশ মানে ভোটে পরাজিতকরণ। সর্বশেষ বক্তা ছিলেন মনশাদ আলী। ছ’ফুটের বেশি লম্বা এই নেতার দেহখানা খুবই মজবুত। তার শব্দচয়ন সুন্দর উচ্চারণে গোলমাল। মনশাদ বলেন, ‘আমাদের প্রাণপ্রিয় লিডার আবদুল উকিল মালেক স্যার গণতন্ত্রের জন্য অবিরাম মেহনত করতেছেন। সারা ডিস্টিক চক্কর দিয়ে আইউব শাহির বিরুদ্ধে জনমত ঘটন করতেছেন। এ জন্য স্যারকে আমরা উপরেহার দিব। কী সেই উপরেহার? উপরেহার হইল শেহাবউল্লাহর জামানত বাজেয়াপ্তকরণ।’ শ্রোতারা দুহাত তুলে উপহার দেওয়ার প্রস্তাব সমর্থন করলেন। হ্যাঁ, মনশাদ আলীরা শেষতক উপহার দিয়েই ছেড়েছেন।

উনিশশ সত্তরের নির্বাচনের মাস কয়েক আগে ‘শেষ পর্যন্ত’ নামে একটি ফিল্ম মুক্তি পায়। এর পরিচালক জহির রায়হান। এ ছবিতেও উপহারের ব্যাপার ছিল। নির্বাচনে প্রার্থীর বিজয় ঘটানোটাই উপহার। যার বন্দোবস্ত করতে হবে প্রার্থীর কন্যার প্রেমিককে। নির্বাচনি প্রচারণায় রোজ অংশ নেয় প্রেমিক। একদিন মিছিল করার সময় প্রতিপক্ষের আক্রমণে প্রেমিকের পা ভেঙে যায়। হাসপাতালে তাকে দেখতে আসে প্রার্থীকন্যা। বলে, তোমাকে না বলেছি সব দিন মিছিলে থাকতে হবে না। তবু মিছিলে যাও কেন? প্রেমিক বলে, ‘সখী তোমায় বুঝতে হবে। এটা শুধু তোমার বাপের ইলেকশন নয়, তোমার বরের সিলেকশনও।’ ভোটের নেশায় বুঁদ হয়ে প্রার্থীরা কী ধরনের হাস্যকর অবাস্তব সব ওয়াদা করেন তা ফুটিয়ে তুলেছিল ‘শেষ পর্যন্ত’। একটি দৃশ্যে দেখা যায়, প্রার্থীর লোকেরা গান গাইতে গাইতে মিছিল করছে গ্রামের রাস্তায়। তারা গাইছে- ‘ভোট চাই ভোট চাই, ভোট চাই/ভোট দিলে যাহা চান তাহা পাবেন ভাই॥ বাড়িঘর করে দেব ফিটফাট/সোনা দিয়ে মুড়ে দিব পথঘাট॥’

মরহুম সাংবাদিক সৈয়দ নাজিমুদ্দিন মানিক বলতেন, দুনিয়ায় তিনটি নেশা থেকে মুক্ত হওয়া কঠিন। মদ, জুয়া ও ভোট। আমাদের প্রশ্নের জবাবে তিনি কথাগুলো বলেছিলেন। সাংবাদিক ইউনিয়ন বা প্রেস ক্লাবের নির্বাচনে তার দাঁড়িয়ে যাওয়ার অভ্যাস আমরা পছন্দ করতাম না। নির্বাচন করার যেসব উপাদান অপরিহার্য তার অনেকগুলোয় তাঁর ঘাটতি ছিল। শোচনীয় পরাজয়-উত্তর সম্মানহানি থেকে তাঁকে আগলে রাখবার কাজে আমরা মাঝেমধ্যে সফল হতাম ভয়ানক অভিমানকৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে।

আমাদের এক নানা ছিলেন যাঁকে মা সম্বোধন করতেন ‘বকর মামা’। ফুর্তিবাজ পুরুষ, দুনিয়াজুড়ে ঘুরে বেড়ানো এই নানা যৌবনের এক পর্যায়ে বর্মায় গিয়ে থিতু হন। ধনাঢ্য অবস্থায় মাঝবয়সে দেশে ফেরেন। মায়ের এই বকর মামার ভোট নেশা ছিল। ভিন্ন কিসিমের নেশা। তিনি ভোটে দাঁড়াতেন না, দাঁড় করাতেন। মনপছন্দ প্রার্থীটির জয় কামনায় বিস্তর পয়সা ঢালতেন। বাবা তাঁর এই মামাশ্বশুর প্রসঙ্গে বলতেন, বকর মামার রুচি আছে। উনি সব সময় শিক্ষিত মার্জিত প্রার্থীর পৃষ্ঠপোষকতা করেন। কিন্তু এলাকার মানুষ বড়লোক বকর সাহেবের ইচ্ছায় নাচতে নারাজ। বকর নানা (১৯৭৫ সালে তিনি কবরস্থ হন, আমি এখনো জানি না তাঁর প্রকৃত নাম কী) বলেন, ‘বুঝলে মাইডিয়ার ফ্রেন্ড। পাবলিকে কয় বকর স্যারের ক্যান্ডিডেট খালি ন্যায্য কথা শোনায়। ন্যায্য কথা দিয়া আমরা কাঁথা সিলামু?’ আমার বড় ভাই জানতে চান, তাহলে পাবলিক কী শুনতে চায়? বকর নানা বলেন, ওরা শুনতে চায় রূপকথা।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাসে ভোট প্রসঙ্গে রূপকথার বিষয়টি এসেছে। লন্ডন প্রবাসী নায়ক পশ্চিমবঙ্গের এক জেলা শহরে ফিরেছে বারো বছর পর। এসে শুনল, তার পিতার বন্ধু মন্ত্রী হয়েছেন। দেখা করতে যায় নায়ক। বলে, যেমনটা দেখে গেছি, বারো বছর পরও মানুষের দুরবস্থা, রাস্তাঘাট বাড়িঘরের হতদশা প্রায় আগের মতোই আছে। আপনার পার্টি তো পরপর দুবার ক্ষমতায় এলো। আপনারা যেসব উন্নতি করবেন ওয়াদা করেছিলেন তার কী হলো?

মন্ত্রী বলেন, পার্টি তো ভোট পাওয়ার জন্য লম্বা লম্বা ওয়াদা করবেই। এটা সিস্টেম। যতদূর সম্ভব ওয়াদা পূরণ করা হয়। এটাই সিস্টেম। পিতৃবন্ধুর ব্যাখ্যা শুনে নায়কের টেম্পার হট। তার প্রশ্ন : যে ওয়াদাপূরণ অসম্ভব, সেই ওয়াদা আপনারা কেন করেন? মন্ত্রী বলেন, ‘কুল, কুল। দেখ বাবা, আমরা নিরুপায়। পাবলিক রূপকথা শুনতে চায়। তাদের নিরাশ করা মহাপাপ।’

শুনতে না চাইলেও লাইবেরিয়ার নাগরিকদের রূপকথা শোনানো হয়েছিল ১৯২৮ সালে। সে বছর দেশটিতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়েছিল। ভোট গ্রহণ শেষে বিকালে রেডিও লাইবেরিয়া রূপকথা প্রচার করে। রেডিও বলে, ‘প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী চার্লস কিং তার প্রতিদ্বন্দ্বী থমাস ফকনারের চেয়ে ৬ লাখ ভোট বেশি পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন।’ প্রশ্ন করা যায় এখানে রূপকথা কোথায়? খুব সংক্ষিত উত্তর : ওই নির্বাচনে নিবন্ধিত ভোটার ছিল ১৫ হাজার জন।

সবশেষে ভারতীয় চুটকি। রমেশ বলল, ‘আমার ভাই দু’বছর আগে লোকসভা নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলেন।’ হিতেশ বলে,  ‘তোর ভাই এখন কী করেন।’ রমেশ : কিছুই করেন না। উনি তো নির্বাচিত।

 

                লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন

সর্বশেষ খবর