রবিবার, ৭ জানুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

চোরে চোরে মাসতুতো ভাই

সাইফুর রহমান

চোরে চোরে মাসতুতো ভাই

ফরাসি পর্যটক তাভেরনিয়ের ভারতবর্ষে আসেন ১৬৪০ সালে। তখন মুঘল সম্রাট শাহজাহানের আমল। ১৬৪০ সালে ভারতে এলেও তাভেরনিয়ের বাংলাদেশে এসেছিলেন ১৬৬৫ সালের ১৪ জানুয়ারি। ততদিনে সম্রাট শাহজাহান পরলোকগত হয়েছেন। ভাইদের মধ্যে যুদ্ধবিগ্রহ শেষে সিংহাসনে বসেছেন সম্রাট আওরঙ্গজেব। আগ্রা থেকে ১৬৫৫ সালের ২৫ নভেম্বর নৌপথে যাত্রা করে প্রায় এক  মাস ২০ দিন পর তিনি ঢাকায় পৌঁছান। তাঁর লেখা ভ্রমণকাহিনিটি ইতিহাসের এক অমূল্য সম্পদ হিসেবে বিবেচিত। তিনি লিখেছেন, ‘১৪ জানুয়ারি আমি ঢাকা শহরে পৌঁছেই গিয়েছিলাম নবাব সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। তাঁকে উপঢৌকন হিসেবে দিয়েছিলাম সোনার জরিতে তৈরি অর্থাৎ টিস্যু কাপড়ের একটি পোশাক। তার ঝালর ও কিনারা মন্ডিত ছিল স্পেনের সোনালি জরির সুতায়। তাঁকে আরও দিলাম সোনালি-রুপালি নকশাযুক্ত একখানি চাদর বা অঙ্গাবরণ, আর সুন্দর একটি মরকত মণি।   নবাবের ১০ বছর বয়সের পুত্রকে উপহার দিলাম সোনার জলে মীনে করা বাক্সে একটি ঘড়ি, রূপা খচিত একজোড়া ছোট পিস্তল, অতি সুন্দর একখানি ম্যাগনিফাইং গ্লাস। পিতা-পুত্রকে মিলিয়ে যা আমি দিয়েছিলুম তার মূল্য ৫ হাজার লিভারের বেশি ছিল।

সন্ধ্যার দিকে আমি ওলন্দাজদের কুঠিতে ফিরে আসার পর নবাব আমার জন্য পাঠিয়েছিলেন স্ফটিক পাথর, চীনা কমলালেবু, দুটি পারসিক ফুটি এবং তিন রকমের নাশপাতি। ১৫ তারিখে আমি নবাবকে আমার জিনিসপত্র দেখিয়ে দিলাম। জিনিসপত্রের দাম সম্পর্কে আমি চুক্তিবদ্ধ হলাম ১৬ তারিখে। অবশেষে তাঁর গোমস্তার কাছে গেলাম আমার বিনিময় মুদ্রার জন্য চিঠি আনার উদ্দেশ্যে, যাতে আমার প্রাপ্য টাকাগুলো আমি কাশিমবাজার থেকে উঠিয়ে নিতে পারি।’

তখনকার দিনে একটি প্রথা প্রচলিত ছিল। যে কোনো পর্যটক নবাব ও তাঁর পরিবারের জন্য দামি কোনো উপঢৌকন নিয়ে এলে সেগুলোর দাম নির্ধারণ করে তা চুকিয়ে দেওয়া হতো পর্যটকের হাতে। তাভেরনিয়ের ঢাকায় বসে তাঁর পাওনা টাকা গ্রহণ না করে কেন তিনি সেই টাকা কাশিমবাজার থেকে উত্তোলন করতে চাইলেন? এর পেছনের কারণটি হলো, তাভেরনিয়ের ঢাকা আসার পর দেখলেন ওলন্দাজরা বেশ জমিয়ে ব্যবসা করছে। কিন্তু সমস্যা হলো তাদের জিনিসপত্রগুলো চুরি হয়ে যায় হামেশাই। যখন তারা দেখলেন যে ঢাকার সাধারণ বাড়িতে জিনিসপত্র রাখা নিরাপদ নয়, তারা চোরদের হাত থেকে জিনিসপত্রগুলো রক্ষা করার জন্য নিজেদের জন্য ভারি চমৎকার একটি বাড়ি তৈরি করে নিয়েছিলেন সেখানে। তাভেরনিয়ের আরও লিখেছেন, ‘ওলন্দাজদের ব্যবসাবুদ্ধি আমার চেয়ে ঢের বেশি। তারা আমাকে বললেন সঙ্গে টাকাকড়ি নিয়ে কাশিমবাজার যাওয়া নিরাপদ নয়। আবার গঙ্গা নদীর পথ ছাড়া যাওয়ার দ্বিতীয় কোনো উপায়ও নেই। স্থলপথ যা আছে তাও পাঁকে, জলায় পরিপূর্ণ। তা ছাড়া জলপথে আরও বিপদ আছে। যে-জাতীয় নৌকার ব্যবহার হয় তা সামান্য ঝড়বাতাসে উল্টে যাওয়ার আশঙ্কা।

কিন্তু তার চেয়েও বড় সমস্যা হলো মাঝিমাল্লাদের যদি জানা থাকে যাত্রীর সঙ্গে যথেষ্ট পরিমাণ টাকাকড়ি আছে, তাহলে খুব অনায়াসেই তারা নৌকা উল্টে দিতে পারে। মাঝিমাল্লাগুলো এমনই দক্ষ চোর যে তারা ঠিকই বুঝতে পারত নদীর কোন জায়গায় মুদ্রার থলেগুলো নিমজ্জিত হয়েছে এবং সময়মতো এসে তারা অবাধে সেগুলো তুলে নিতে সক্ষম ছিল।’

শুধু তাভেরনিয়েরই নন, প্রায় অধিকাংশ ভ্রামণিক যেমন আল বিরুনি (ভারতবর্ষে ছিলেন ১০১৭ থেকে ১০৩০ পর্যন্ত), ইবনে বতুতা (ভারতবর্ষে এসেছিলেন ১৩৩৩ সালে), বার্নিয়ের (১৬৫৯-১৬৬৬), মানুচি (১৭০৪-১৭১৭) কমবেশি আমাদের চারিত্রিক স্খলনের নানা চিত্র তুলে ধরেছেন। ইবনে বতুতা তাঁর ভ্রমণবৃত্তান্তে লিখেছেন, ‘মালদ্বীপে চুরি করার অপরাধে আমি একবার একটি চোরের হাত কেটে ফেলার হুকুম দিয়েছিলাম, তখন সেখানে উপস্থিত কয়েকজন সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে।’

এবার আমরা একটু পেছনে ফিরে যাই। ভারতবর্ষে সর্বপ্রথম যে পরিব্রাজক এসেছিলেন তাঁর নাম মেগাস্থিনিস। তিনি এসেছিলেন গ্রিস থেকে। সম্ভবত ৩০২-২৯৮ খ্রিস্টপূর্বের কোনো একসময়। অর্থাৎ এখন থেকে প্রায় ২ হাজার ৩০০ বছর আগে। গ্রিক সম্রাট সেলুকাসের দূত হিসেবে ভারতে এসেছিলেন মেগাস্থিনিস। তখন মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকাল। চন্দ্রগুপ্তের রাজধানী পাটলিপুত্র (বর্তমান বিহারের রাজধানী পাটনা)। মেগাস্থিনিস কিন্তু আল বিরুনি, তাভেরনিয়ের, মানুচি কিংবা অন্য পর্যটকদের মতো আমাদের চোর, শঠ, প্রতারক হিসেবে চিহ্নিত করেননি। মেগাস্থিনিস লিখেছেন, ‘পাটলিপুত্র নগরের সাধারণ মানুষের জীবন সুসংযত ও সুশৃঙ্খল। এখানে চুরিচামারি অতি বিরল। পাটলিপুত্র নগরে ৪ লাখ লোকের বাস। কিন্তু কোনো দিনও ৩০ মুদ্রার অধিক মূল্যের বস্তু অপহৃত হয়েছে বলে শোনা যায়নি। ভারতবর্ষে লিখিত আইনকানুনের ব্যবহার নেই। তার পরও কেউ আইন ভঙ্গ করে না। তারা সরলচিত্ত ও মিতাচারী বলে সুখেই দিন যাপন করে। তাদের বিধি ও পরস্পরের প্রতি অঙ্গীকার সবই সরল। তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ, তারা কখনো রাজদ্বারে অভিযোগ নিয়ে উপস্থিত হয় না। তারা অন্যের কাছে যেসব মূল্যবান সম্পদ গচ্ছিত কিংবা আমানত রাখে তৎসম্পর্কেও কারও কাছে কোনো অভিযোগ করতে হয় না। সেসবের জন্য কোনো সাক্ষীরও প্রয়োজন হয় না। তারা পরস্পরকে বিশ্বাস করেই সম্পদ গচ্ছিত রাখে। তারা সচরাচর তাদের ঘর অরক্ষিত রেখেই প্রতিদিন কাজকর্মে বেরিয়ে পড়ে।’ শুধু মেগাস্থিনিসই নন, চীনা পরিব্রাজক ফা হিয়েন (৩৯৯-৪১৪), হিউয়েন সাঙ (৬২৯-৬৪৫) প্রভৃতি পর্যটকও আমাদের সততা, আতিথেয়তা ও ন্যায়পরায়ণতার সুখ্যাতি করেছেন। হিউয়েন সাঙ এসেছিলেন নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে (নালন্দা জেলা, বিহার, ভারত) একজন আচার্য হিসেবে। হিউয়েন সাঙ লিখেছেন, ‘ভারতবর্ষের দুর্গম ও অরণ্যসংকুল অঞ্চলে ডাকাতির কিছু আশঙ্কা থাকলেও চোরের তেমন কোনো উপদ্রব নেই। লোকজন সাধারণত রাতে ঘরের দরজায় খিল না এঁটেই ঘুমায়।’

ভারতের লোকজন রাতে ঘরের দ্বার খোলা রেখে ঘুমায় এটা দেখে হিউয়েন সাঙ যে অবাক হবেন সেটাই স্বাভাবিক। কারণ পৃথিবীতে যিশুখ্রিস্টের জন্মেরও ২ হাজার বছর আগে সর্বপ্রথম তালার আবিষ্কার হয় মিসর ও চীনে। এ থেকেই বোঝা যায় চীনে ও মিসরে ফারাওদের রাজত্বকালে কী প্রকার চোরের উপদ্রব ছিল সেখানে! সে যা হোক, আমার প্রশ্ন হচ্ছে মেগাস্থিনিস, ফা হিয়েন কিংবা হিউয়েন সাঙের মতে এ দেশের মানুষ সে সময় চুরি করতে জানত না। আমরা সত্যি সত্যি একসময় ছিলাম সৎ, উদার ও ন্যায়পরায়ণ কিন্তু চার-পাঁচ শ বছরের ব্যবধানে কীরূপে আমরা সাংঘাতিকরকম চোর হয়ে উঠলাম তা সত্যি আশ্চর্যের বিষয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টের মতো সুরক্ষিত একটি স্থানে সোনা হয়ে যায় তামা! লাখ লাখ টন কয়লা কিংবা পাথর লোপাট হয়ে যায় চোখের সামনে থেকে। এ কোন বিচিত্র দেশে বাস করছি আমরা?

এককালে নাকি এ পেশাটির বেশ নামডাক ছিল। প্রাচীন শাস্ত্রে ৬৪ কলার একটি অন্যতম কলা ছিল চুরিবিদ্যা। সেকালে রাজকুমারদের নানা বিদ্যাশিক্ষার পর চুরিবিদ্যা শেখানো হচ্ছে এমন বর্ণনা ‘দশকুমার চরিত’ গ্রন্থে পাওয়া যায়। সংস্কৃতে লেখা পুথিরও হদিস মেলে ‘চৌর্য চর্যা’ বা ‘চৌর্য স্বরূপ’ নামে। এও শোনা যায়, প্রথম পুথির লেখক মূলদেব নিজেই নাকি ছিলেন একজন ডাকসাইটে চোর। তাহলে কি এটাই ধরে নিতে হবে যে প্রাচীনকালের পর্যটকরা সৎ হিসেবে যতই আমাদের সুখ্যাতি করুক চৌর্যবৃত্তিটাই আসলে আমাদের অনিবার্য পরিণতি! আমাদের শিক্ষা ও সংস্কৃতিতেই কি তাহলে ছিল চৌর্যবৃত্তির বীজ? তা না হলে চারদিকে কেন আজ শুধুই চৌর্যবৃত্তি আর চোরদের মহোৎসব। কবিবর কাশীরাম দাস তো কোন কালে বলেছেন, ‘চোরা নাহি শোনে কভু ধর্ম্মের কাহিনী’, চোর ধর্মকথা বোঝে না, বুঝতে চায়ও না। তার স্বধর্ম চৌর্যবৃত্তি। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর আমাদের স্পষ্টই জানিয়েছেন চুরি হলো একটি বদভ্যাস। লোভ থেকে যার জন্ম। অন্যদিকে অক্ষয় কুমার দত্ত লিখেছেন, ‘চৌর্যবৃত্তির মতো নিকৃষ্ট প্রবৃত্তির অন্যতম কারণ হলো অর্জনস্পৃহা অর্থাৎ লাভের ইচ্ছা- অর্জনস্পৃহা বৃত্তি অতি প্রবল হইলে লোভ অত্যন্ত বৃদ্ধি হইয়া প্রতারণা ও চৌর্যবৃত্তিতে মানুষ প্রবৃত্ত হয়।’ ১৬৬৬ সালে স্বদেশে ফিরে গিয়ে বার্নিয়ের ভারতবর্ষের অর্থনৈতিক অবস্থা ও সম্পদ, আচার-ব্যবহার, সেনাবাহিনী, সমাজব্যবস্থা ইত্যাদি সম্পর্কে মঁসিয়ে কলবার্টের কাছে একটি দীর্ঘ পত্র লেখেন। বার্নিয়েরের সময় ফ্রান্সের সম্রাট ছিলেন চতুর্দশ লুই এবং মঁসিয়ে কলবার্ট ছিলেন ফ্রান্সের অর্থসচিব। বার্নিয়েরের ভ্রমণবৃত্তান্তে অন্যান্য অংশের মধ্যে এ পত্রখানির ঐতিহাসিক মূল্য ও গুরুত্ব তার ভ্রমণবৃত্তান্তের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।

বার্নিয়েরের ভ্রমণবৃত্তান্তের চমৎকার একটি অনুবাদ করেছেন লেখক ও সাহিত্যিক বিনয় ঘোষ ‘বাদশাহী আমল’ নামে। বার্নিয়ের কলবার্টের কাছে লিখেছেন, ‘ভারতবর্ষে সম্রাটই দেশের সমস্ত সম্পদের মালিক, বিশেষ করে ভূসম্পত্তির। সামরিক কর্মচারীদের বেতন হিসেবে তিনি ভূসম্পত্তির ভোগাধিকার দান করেন তাকে “জায়গির” বলে। এ জায়গির থেকে তারা তাদের ন্যায্য বেতন আয় করেন। প্রাদেশিক সুবাদারদেরও জায়গির দেওয়া হয়, শুধু বেতনের জন্য নয়, সৈন্যসামন্তদের জন্যও। একমাত্র শর্ত হলো এই যে, বার্ষিক বাড়তি রাজস্ব যা আয় হবে সেটা সম্রাটকে দিতে হবে। যেসব ভূসম্পত্তি জায়গির দেওয়া হয় না, সেগুলো সম্রাটের নিজস্ব আয়ত্তে থাকে এবং তিনি রাজস্ব আদায়কারী (জমিদার ও চৌধুরী) নিয়োগ করে তাঁর রাজস্ব আদায় করেন।

এভাবে ভূসম্পত্তির অধিকারী যারা হন- সুবাদার, জায়গিরদার ও জমিদার; তাঁরা প্রজাদের একমাত্র হর্তাকর্তাবিধাতা হয়ে যান, চাষিদের ওপর তাঁদের পরিপূর্ণ কর্তৃত্ব বজায় থাকে, এমনকি নগর ও গ্রামের বণিকশ্রেণি ও কারিগরদের ওপরও। এ কর্তৃত্ব ও আধিপত্য তাঁরা যে কী নির্মমভাবে প্রয়োগ করেন নিষ্ঠুর অত্যাচারীর মতো, তা কল্পনা করা যায় না। এ অত্যাচার ও উৎপীড়নের বিরুদ্ধে অভিযোগ করারও কোনো উপায় নেই। কারণ যিনি রক্ষক, তিনিই ভক্ষক। এমন কোনো নিরপেক্ষ কর্তৃপক্ষ নেই, যার কাছে তার অভিযোগ পেশ করা যায়। আমাদের দেশের (ফ্রান্স) মতো ভারতবর্ষে পার্লামেন্ট নেই, আইনসভা নেই, আদালতে বিচারক নেই। অর্থাৎ এমন কিছু নেই যার সাহায্যে এ নিষ্ঠুর অত্যাচারীদের বর্বরতার প্রতিকার করা যেতে পারে। কিছু নেই, কেউ নেই। আছেন শুধু কাজি সাহেব, কিন্তু কাজির বিচারও তেমন, কারণ কাজির কাছে জনসাধারণের সুবিচারের কোনো আশা নেই।’

পাঠক, একটু ভালো করে লক্ষ্য করুন, আমাদের দেশ ও মানুষ সম্পর্কে ৩৫০ বছর আগে বার্নিয়ের যা লিখে গেছেন বর্তমানে কি তার এতটুকু বদলেছে? যে কোনো রাষ্ট্রে সুশাসন, ন্যায়বিচার, মানবাধিকার বিষয়গুলোর অনুপস্থিতিতে রাষ্ট্রে তৈরি হয় এক ধরনের অনিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক বৈষম্য। এসব প্রেক্ষাপটে দুর্নীতি নেয় এক ভয়াবহ রূপ। যেমনটি ঘটছে বর্তমানে।

একজন মানুষ যখন অনিরাপত্তায় ভোগেন তখন তিনি মনে করেন টাকা দিয়েই নিশ্চিতভাবে সব সমস্যার সমাধান করবেন। চৌর্যবৃত্তির অন্যতম একটি কারণ যদি হয় সামাজিক অনিরাপত্তা তাহলে চৌর্যবৃত্তির অন্য আরেকটি বড় কারণ হলো অর্থ সঞ্চয়ের প্রতি আমাদের মাত্রাতিরিক্ত আসক্তি। আমার মতে এ আসক্তি হেরোইন, গাঁজা কিংবা আফিমের চেয়ে কম প্রভাবশালী নয়, বরং বেশি।

ঘুষ, ব্যাংক লুট, ঠিকাদারি কাজে দুর্নীতি প্রভৃতি চৌর্যবৃত্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের একশ্রেণির মানুষ বিপুল সম্পদ অর্জনের পরও তাদের খিদে মেটে না সহজে। তারা ক্রমাগত দেশের সম্পদ লুণ্ঠনে অব্যাহত থাকে। পত্রপত্রিকায় পড়েছি মালয়েশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা প্রভৃতি দেশে বাংলাদেশের একশ্রেণির মানুষ নাকি তৈরি করেছে সম্পদের পাহাড়। কানাডার এক অঞ্চলের নাম হয়েছে ‘বেগমপাড়া’। সেখানে বসবাস করেন বাংলাদেশের বেশ কিছু রাজনীতিবিদের বেগমরা। তাঁদের সেসব বিলাসবহুল বাড়ির সামনে দিয়ে যখন কানাডার স্থানীয় বাসিন্দারা হেঁটে যান তখন নাকি তারাও লজ্জা পান রাজনীতিবিদদের ওইসব প্রাসাদোপম বাড়ি দেখে। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, ভালোভাবে জীবন ধারণ করতে একজন মানুষের আসলে কতটুকু সম্পদ প্রয়োজন? সেটা কি খুব বেশি? কেউ হয়তো বলবেন সরকারি পদে থেকে একেবারেই কি নিজেকে দুর্নীতিমুক্ত রাখা সম্ভব? চাণক্যও বলেছেন, ‘জিহ্বার অগ্রে বিষ রেখে মধু পান যেমন সম্ভব নয়, ঠিক তেমনি রাজ অমাত্য হয়ে অর্থ তছরুপ থেকে বিরত থাকাও সম্ভব নয়।’ অথচ চাণক্য কিন্তু ঠিকই দুর্নীতি থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পেরেছিলেন। তিনি ছিলেন মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের প্রধানমন্ত্রী। তাঁর কাছে কেউ দেখা করতে এলে তিনি প্রথমে প্রশ্ন করতেন, তুমি কি সরকারি কাজে এসেছ, নাকি আমার কাছে ব্যক্তিগত কাজে এসেছ? ওই লোকটি হয়তো বলল, আপনার সঙ্গে ব্যক্তিগত সাক্ষাৎ করতে এসেছি। তখন তিনি সরকারি লণ্ঠনটি নিভিয়ে দিয়ে নিজের ব্যক্তিগত লণ্ঠনটি জ্বালিয়ে ওই লোকের সঙ্গে কাজকর্ম সারতেন। তিনি নিজের কাজে সরকারি তেল ব্যবহার করতেন না। দেখা যাচ্ছে দুর্নীতিপরায়ণ একজন মানুষ হয়তো ব্যক্তিজীবনে ভোগ করছেন যৎসামান্যই। কিন্তু ব্যাংকে জমিয়ে রাখছেন শত সহস্র কোটি টাকা। চোরের খেতাব মাথায় নিয়ে কবরে যেতেও তাদের কোনো দ্বিধা নেই। কিন্তু ঐশ্বর্যের পাহাড় তাকে যে করেই হোক গড়তেই হবে। এ জন্যই আমি বলেছি অবৈধ পথে অর্থ উপার্জন হচ্ছে একটি নেশার মতো। বার্নিয়ের তাঁর ভ্রমণকাহিনিতে লিখেছেন, ‘অনাহারে-অর্ধাহারে থেকেও ভারতবর্ষের মানুষের সোনার গহনা পরার লোভ ও অভ্যাস খুব প্রবল।’

রাশিয়ার স্বৈরশাসক স্তালিন, চিলির পিনোশে, ফিলিপাইনের মার্কোস কিংবা প্রাচীন যুগের জুলিয়াস সিজার, চেঙ্গিস খান হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক ছিলেন। জীবনে তাঁরা কতটুকু ভোগ করেছিলেন আর কতটুকু কবরে নিয়ে যেতে পেরেছেন সে ইতিহাস হয়তো অনেকেরই জানা আছে। তার পরও সম্পদের প্রতি মানুষের লোভ চিরন্তন। তবে সাধারণ মানুষের চেয়ে আলোকিত মানুষজন ও লেখক-সাহিত্যিকরা চট করেই ধরতে পারেন যে একজন মানুষের বেঁচে থাকার জন্য আসলে বিপুল পরিমাণ অর্থসম্পদের প্রয়োজন নেই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এ বিষয়ে দুটো গল্প আছে। একটি গল্পের নাম ‘সম্পত্তি সমর্পণ’, দ্বিতীয়টি ‘গুপ্তধন’ নামে।

সম্পত্তি সমর্পণ গল্পে যজ্ঞনাথ কুন্ড তার এত্তো এত্তো সম্পত্তি তো শেষ পর্যন্ত ভোগ করতে পারলেন না। নিজের নাতিকে চিনতে না পেরে সব সম্পত্তিসমেত নিজের সেই দৌহিত্রকে মাটিচাপা দিয়ে দিলেন মন্দিরের নিচে। ছেলে নিতাই কুন্ডের মুখে যজ্ঞনাথ যখন জানতে পারলেন পথে কুড়িয়ে পাওয়া নিতাই পাল আসলে তার নিজের নাতি গকুলচন্দ্র কুন্ড তখন তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেললেন। ‘গুপ্তধন’ গল্পে দেখি মৃত্যুঞ্জয় তার পিতামহের কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে একটি গুপ্তধনের নকশা পেয়েছিলেন। অনেক চেষ্টা-তদবির করে এক সন্ন্যাসীর সাহায্যে বিরাট এক সুড়ঙ্গের মধ্যে সেই গুপ্তধনের সন্ধান তিনি পান। কিন্তু সেই সুড়ঙ্গের ভিতর আটকা পড়ে মৃত্যুঞ্জয়ের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘সেই জীবন, সেই আকাশ, সেই আলোক, পৃথিবীর সব মণিমাণিক্যের চেয়ে মৃত্যুঞ্জয়ের কাছে দুর্মূল্য বোধ হইতে লাগিল। তাহার মনে হইতে লাগিল, কেবল ক্ষণকালের জন্য একবার যদি আমার সেই শ্যামাজননী ধরিত্রীর ধূলিক্রোড়ে, সেই উন্মুক্ত আলোকিত নীলাম্বরের তলে, সেই তৃণপত্রের গন্ধবাসিত বাতাস বুক ভরিয়া একটিমাত্র শেষ নিঃশ্বাসে গ্রহণ করিয়া মরিতে পারি তাহা হইলেও জীবন সার্থক হয়।

এমন সময় দ্বার খুলিয়া গেল। সন্ন্যাসী ঘরে প্রবেশ করিয়া কহিলেন, মৃত্যুঞ্জয়, কী চাও। সে বলিয়া উঠিল, আমি আর কিছুই চাই না- আমি এই সুড়ঙ্গ হইতে, অন্ধকার হইতে, গোলকধাঁধা হইতে, এই সোনার গারদ হইতে, বাহির হইতে চাই। আমি আলোক চাই, আকাশ চাই, মুক্তি চাই।’

আমাদের দেশে চৌর্যবৃত্তি প্রসারের আরেকটি অন্যতম কারণ হচ্ছে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির দুর্বলতা। সমাজে চোরেরা আজ সবচেয়ে বেশি সম্মানিত ও প্রতিষ্ঠিত। সব আমলের মন্ত্রী, আমলা-কামলাদের দিকে তাকালেই সেটা স্পষ্ট বোঝা যায়। ডান-বাম, আস্তিক-নাস্তিক, কমিউনিস্ট-ইসলামিস্ট মিলেমিশে সব আজ চৌর্যবৃত্তিতে নিমজ্জিত।  নামাজ পড়ে পড়ে কপালে কালো তিলক ফেলে দিয়েছেন কিংবা বছর বছর যারা হজ করেন তারাও চৌর্যবৃত্তিতে পিছিয়ে নেই এতটুকু। এরাই আমাদের সমাজের বিভিন্ন সভাসমিতিতে সভাপতি, প্রধান অতিথি ও অগ্রগণ্য ব্যক্তি। চোর হিসেবে যে তাদের অযোগ্য অপাঙ্ক্তেয় করবে সেই সৎসাহস আমাদের সমাজের কারও নেই।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ‘মাধব’ নামে এক বালকের কাহিনি আমাদের শুনিয়েছেন। ১৮৫৫ সালে তাঁর লেখা বর্ণপরিচয় দ্বিতীয় ভাগে প্রকাশিত এই গল্পে নানা ভালো গুণ থাকা সত্ত্বেও চুরি করার বদগুণটির জন্য মাধব কেমন করে সমাজে অস্পৃশ্য হয়ে গেল তা আমরা জানতে পারি।  আলোচ্য গল্পটিতে দেখা যায় মাধব কারও বাড়িতে গেলে, বাড়ির লোকজন তাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিত। এখন আর চোরদের কেউ দূর দূর করে তাড়ায় না। বর্তমানে বাবা-মায়েরা চান তার সন্তানগুলো শৈশবে হবে শ্রেণির সবচেয়ে ভালো ছাত্র আর বড় হয়ে হবে মহাচোর। তা না হলে ছেলেমেয়ে যখন নির্দিষ্ট বেতনের বাইরে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা উপার্জন করে তখন তো বাবা-মা তার সন্তানদের একটিবারও প্রশ্ন করেন না, এত টাকার উৎস কী?

লেখক : গল্পকার ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী

[email protected]

সর্বশেষ খবর