পৃথিবীর সব সৃষ্টজীব মহান আল্লাহর পরিবারের সদস্য। প্রত্যেক সৃষ্টজীবই মহান স্রষ্টার সৃষ্টিনৈপুণ্যের বহিঃপ্রকাশ। ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র প্রতিটি প্রাণী তাঁর অনেক আদরের এবং তিনি সব জীবের রিজিকদাতা। বৈচিত্র্যময় হাজারো মাখলুক সৃষ্টির মাধ্যমে তিনি সাজিয়েছেন এ বিশাল জগৎসংসার। দয়াময় প্রভুর এসব আয়োজন মানব জাতির কল্যাণের জন্য এবং তিনিই এ জগৎসংসারের একমাত্র অভিভাবক। পাহাড়, নদী কিংবা সাগরতলের প্রতিটি প্রাণীর তিনি খবর রাখেন অতি কাছ থেকে। সব সৃষ্টিজীবই দিনরাত তাঁর তসবিহ পাঠে মশগুল। মহান আল্লাহ আল কোরআনে ইরশাদ করেন, তারা কি লক্ষ্য করে না; তাদের মাথার ওপর উড়ন্ত পাখিদের প্রতি, তারা (কখনো) ডানা বিস্তারকারী এবং (কখনো) ডানা সংকোচনকারী? রহমান আল্লাহই তাদের স্থির রাখেন। তিনি সর্ববিষয় দেখেন। (সুরা মুল্ক, আয়াত-১৯)
মহান আল্লাহর বাণী : নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলে যা কিছু আছে সবই আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা করে। রাজত্ব এবং প্রশংসা তাঁরই। তিনি সর্ববিষয়ে শক্তিমান। (সুরা তাগাবুন, আয়াত-০১) কোনো জীবকে কষ্ট দেওয়া মানে মহান মালিকের পরিবারকে কষ্ট দেওয়া। পক্ষান্তরে কোনো জীবের প্রতি দয়া করা মানে মহান স্রষ্টার পরিবারের প্রতি দয়া করা। আর যে মহান স্রষ্টার পরিবারের ওপর দয়ার্দ্র হয়, রব্বুল আলামিন তার ওপর অসীম দয়ার ভান্ডার খুলে দেন। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, অনুগ্রহকারীদের প্রতি পরম করুণাময় অনুগ্রহ করে থাকেন। তোমরা দুনিয়াবাসীর ওপর অনুগ্রহ কর, এতে আসমানে অবস্থানকারী তোমাদের ওপর অনুগ্রহ করবেন। (আবু দাউদ, তিরমিজি)
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, নবীদের মধ্যে কোনো এক নবীকে একটি পিঁপড়া কামড়ালে তিনি পিঁপড়ার গোটা বস্তি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন এবং তা জ্বালিয়ে দেওয়া হলো। এরপর মহান আল্লাহ তাঁর কাছে ওহি পাঠালেন, তোমাকে একটি পিঁপড়া কামড়াল, আর তুমি আল্লাহর প্রশংসাকারী একটি উম্মতকেই পুড়িয়ে ফেললে! (বুখারি, মুসলিম)যারা সৃষ্টজীবের প্রতি অনুগ্রহ প্রদর্শন করে, দয়াময় প্রভু তাদের দিকে ক্ষমার হাত প্রসারিত করেন। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, এক ব্যক্তি রাস্তা দিয়ে চলছিল; সে খুব পিপাসার্ত হয়ে পড়ল এবং সামনে একটি কুয়া পেল। সে তাতে নেমে পানি পান করল। কুয়া থেকে উঠে দেখল একটি কুকুর পিপাসার কারণে জিব বের করে কাদামাটি চাটছে। লোকটি বুঝতে পারল পিপাসার কারণে আমার যে অবস্থা হয়েছিল কুকুরটিরও সে অবস্থা। এরপর সে আবার কুয়ায় নেমে নিজের পা- মোজায় পানি ভরে ওপরে নিয়ে এলো এবং কুকুরটিকে পান করাল। এ কারণে আল্লাহ তাকে পুরস্কৃত করলেন এবং ক্ষমা করে দিলেন। সাহাবিরা আরজ করলেন, হে আল্লাহর রসুল! চতুষ্পদ প্রাণীর প্রতি দয়া প্রদর্শনেও কি আমাদের জন্য সওয়াব রয়েছে? রসুল (সা.) ইরশাদ করলেন, হ্যাঁ, প্রত্যেক জীবের প্রতি দয়া প্রদর্শনে সওয়াব রয়েছে। (বুখারি, মুসলিম)
পক্ষান্তরে অন্যায়ভাবে কোনো জীব-জানোয়ারকে কষ্ট দেওয়া মহাপরাধ ও গুনাহের কাজ। হজরত ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, এক মহিলা একটি বিড়ালের ওপর জুলুম করার কারণে জাহান্নামি হয়ে গেছে। সে বিড়ালকে বেঁধে রেখেছিল অথচ কোনো খাবার দেয়নি। (বুখারি, মুসলিম)। সৃষ্টজীবের প্রতি মহানবী (সা.)-এর ভালোবাসা, দয়া ও অনুগ্রহ ছিল অতুলনীয়। অহেতুক কোনো প্রাণীকে কষ্ট দেওয়াকে তিনি খুব অপছন্দ করতেন। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, আমরা এক সফরে রসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে ছিলাম। এক জায়গায় একটি চড়ুই পাখিকে দুটি বাচ্চাসহ দেখতে পেলাম। আমরা বাচ্চা দুটিকে হাতে তুলে নিলাম। ফলে মা পাখিটি অস্থির হয়ে আমাদের মাথার ওপর ঘোরাঘুরি করতে লাগল। মহানবী (সা.) তখন বললেন, পাখিটির বাচ্চা ছিনিয়ে নিয়ে কে তাকে কষ্ট দিয়েছে? তার বাচ্চা তাকে ফিরিয়ে দাও। (আবু দাউদ)
একদিন মহানবী (সা.) এক আনসারি সাহাবির বাগানে প্রবেশ করলে একটি উট তাঁকে দেখে কাঁদতে লাগল। মহানবী (সা.) উটটির কাঁধ ও মাথার পেছনের অংশে হাত বুলিয়ে দেওয়ার পর সে কান্না বন্ধ করল। মহানবী (সা.) বাগানের মালিকের কাছে জিজ্ঞাসা করলেন, এ উটটি কার? তখন আনসারি সাহাবি বললেন, আমার। এরপর মহানবী (সা.) তাকে বললেন, মহান আল্লাহ তোমাকে এ উটের মালিক বানিয়েছেন অথচ তুমি কি এ ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় কর না? এ উটটি তোমার বিরুদ্ধে আমার কাছে অভিযোগ করেছে, তুমি তাকে দিয়ে অধিক বোঝা বহন করাও কিন্তু তাকে চাহিদা মোতাবেক খাবার দাও না। (আবু দাউদ) মহান স্রষ্টার সৃষ্ট প্রতিটি জীবের প্রতি সর্বোচ্চ অনুগ্রহ প্রদর্শন করা প্রত্যেক মানুষের নৈতিক দায়িত্ব ও ইসলামের মৌলিক দীক্ষা। সৃষ্টজীবকে কষ্ট দিয়ে স্রষ্টার সন্তুষ্টি অর্জন করা যায় না। মহান আল্লাহ আমাদের মানবিক হওয়ার তৌফিক দান করুন।
লেখক : খতিব, মাসজিদুল কোরআন জামে মসজিদ, কাজলা (ভাঙ্গাপ্রেস), যাত্রাবাড়ী, ঢাকা