মঙ্গলবার, ৯ জানুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

বাংলাদেশ বিমান এবং অন্যান্য গল্প

জসিম মল্লিক

বাংলাদেশ বিমান এবং অন্যান্য গল্প

১. আমি টরন্টো থাকি। টরন্টো থেকে প্রতি সপ্তাহের শনি ও মঙ্গলবার বিমান বাংলাদেশের দুটো ফ্লাইট চলাচল করে। একসময় যা ছিল স্বপ্ন, এখন তা বাস্তব। ভবিষ্যতে এই রুটে আরও বেশি ফ্লাইট চলাচল করবে এটা বলাই যায়। বিমান ঢাকা-টরন্টো-ঢাকা রুটকে উদাহরণ হিসেবে দেখাচ্ছে। কারণ এই রুট ক্রমশ লাভজনক হয়ে উঠছে। বেশির ভাগ ফ্লাইট ফুল হচ্ছে। শুধু যে বাংলাদেশি যাত্রী যাচ্ছেন তা না, বিদেশি যাত্রীরাও যাচ্ছেন। আমি সব সময় এমিরেটস বা ইত্তেহাদে ভ্রমণ করতাম। প্রতি বছর এক-দুবার দেশে যাওয়া হয় আমার। কিন্তু যেদিন থেকে বিমান সরাসরি ফ্লাইট চালু করল আমি বিমানের নিয়মিত যাত্রী হয়ে গেলাম। শুধু আমি না আমার মতো অনেকেই। অপেক্ষাকৃত বয়স্কদের জন্য সরাসরি ফ্লাইট খুবই স্বাচ্ছন্দ্যের হয়েছে। আমি সব সময় নিজ দেশের পতাকাবাহী এয়ারলাইনসেই ভ্রমণ করতে চাই। দেশে গিয়েও যেখানেই যাই বিমানে ভ্রমণ করি। টরন্টো পিয়ারসন এয়ারপোর্ট নেমে টার্মিনালের বাইরে যখন বিমান কথাটা লেখা দেখি তখন একটা ভালোলাগার অনুভূতি কাজ করে। ভিতরে গিয়েও একই অনুভূতি হয়। অন্য সব নামকরা এয়ারলাইনসের সঙ্গে বিমানের নামও শোভা পাচ্ছে। নতুন প্রজন্মের বোয়িং-৭৮৭-৯ ড্রিমলাইনার দিয়ে দেশে যেতে পারছি এর চেয়ে আনন্দের আর কিছু হতেই পারে না। বিমানের টরন্টোর স্থানীয় অফিসের কর্মকর্তারা খুবই প্রফেশনালিজমের পরিচয় দিচ্ছেন। তাদের কাস্টমার সার্ভিসও খুবই ভালো। আকাশেও বিমানের আতিথেয়তা প্রশংসনীয়। টানা ১৮-২০ ঘণ্টার জার্নি কখনো একঘেয়ে মনে হয় না। আকাশে শান্তির নীড়। তবে ক্যাটারিংয়ে আর একটু বৈচিত্র্য ও এন্টারটেনমেন্টের পরিসর বাড়ানোর অনুরোধ করব কর্তৃপক্ষকে। এসব কিছুই সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসী সিদ্ধান্ত ও দূরদর্শিতার কারণে। শেখ হাসিনার সরকার পুরো বিশ্বকে এক সুতোয় বাঁধতে চাইছে। ইতোমধ্যে জাপান, চেন্নাই বা চীনের সঙ্গেও সরাসরি ফ্লাইট চালু হয়েছে। সিডনি, ইউরোপের আরও ডেস্টিনেশন ও নিউইয়র্কের সঙ্গেও চেষ্টা চলছে। আরও অন্তত ১০টা এয়ারবাস বা বোয়িং কেনার কথাবার্তা হচ্ছে। শুধু এয়ারলাইনসের ক্ষেত্রেই নয়, দেশের মধ্যেও একটা সমন্বিত নেটওয়ার্ক গড়ে তোলায় মনোনিবেশ করেছেন শেখ হাসিনা। তার প্রমাণ পদ্মা সেতু। ইতোমধ্যে পদ্মা সেতু যোগাযোগের ক্ষেত্রে রীতিমতো বিপ্লব ঘটিয়েছে। ঢাকায় মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ট্রেন সার্ভিস, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল সবই স্বপ্নের মতো। আরও অনেক মেগা প্রজেক্ট অনগোয়িং। ঢাকায় তৃতীয় টার্মিনাল তার আর একটি অনন্য উদাহরণ। কে না জানে, একটা দেশের উন্নতি বা অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি অনেকটাই নির্ভর করে সে দেশের সুষ্ঠু যোগাযোগব্যবস্থার ওপর। তাই তো উন্নত দেশগুলোর প্রথম নজর থাকে যোগাযোগের ওপর। আমেরিকা, কানাডার মতো দেশগুলো রাস্তাঘাট তৈরি করে পরবর্তী ১০০ বছরের চিন্তা মাথায় রেখে। কানাডা পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ, কিন্তু মানুষ মাত্র ৩ কোটি ৮০ লাখ। কিন্তু পুরো দেশে সুতোর মতো নেটওয়ার্ক। কথিত আছে কানাডায় যত রাস্তা আছে তা একত্র করলে চাঁদে যাওয়া যায়। আওয়ামী লীগ সরকার কয়েক দফায় ক্ষমতায় থাকার সুফল জনগণ পাচ্ছে। তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ পদ্মা সেতু। শেখ হাসিনার দৃঢ়চেতা মনোবলের কারণেই পদ্মা সেতু আজ বাস্তবরূপ লাভ করেছে।

২. একসময় বরিশাল যেতে কত ঝক্কি না পোহাতে হতো। একটা ঘটনা বলি। সেটা ১৯৯৪ সাল। একবার ঈদে আমার ছোট ছোট দুই বাচ্চা নিয়ে বরিশাল রওনা হয়েছি। সদরঘাট পর্যন্ত আসতেই অবস্থা কেরোসিন। টু স্ট্রোক অটোরিকশা ছিল তখন। তার ভটভট আওয়াজ আর বিকট ধোঁয়ায় অর্ক বমি টমি করে অস্থির। মহাখালী থেকে লঞ্চঘাট পৌঁছতেই সেদিন লেগেছিল ৩ ঘণ্টা। সদরঘাট পৌঁছে দেখি ভয়াবহ অবস্থা। অর্কর বয়স তখন তিন বছর। মানুষের মাথা ছাড়া আর কিছু দেখা যায় না। এদিকে লঞ্চগুলো মানুষের চাপ এড়াতে নদীর মাঝখানে নোঙর করে রেখেছে। সেখানে পৌঁছানোও বিরাট ঝুঁঁকি। আমি বললাম, জেসমিন চলো ফিরে যাই।

জেসমিন বলল, এত কষ্ট করে এসেছি ফিরে যাব! বরিশালে ঈদ করা হবে না! দেখ না কিছু করা যায় কি না।

আমরা অবশেষে একটা ছোট্ট ডিঙি নৌকায় উঠলাম। হুর হুর আরও কয়েকজন উঠে পড়ল। বুড়িগঙ্গার মাঝখানে গিয়ে নৌকা দুলছে মানুষের চাপে। যে কোনো সময় ডুবে যাবে! মনে হচ্ছিল আজই সলিলসমাধি ঘটবে। জেসমিন ভয়ে চিৎকার করছে। এদিকে ঘাটেই কুলিদের টানাটানিতে একটা বাক্স খুলে কাপড়-চোপড় রাস্তায় গড়াগড়ি খাচ্ছিল। সবকিছু সয়লাব হয়ে গেছে। তার মধ্যে নৌকার বিপদ। নৌকা যখন ডুবে যায় অবস্থা এমন সময় আমাদের বিপদ দেখে কোস্টগার্ডের একজন তরুণ অফিসার ছুটে এলো ইঞ্জিন বোট নিয়ে। সেদিন সে আমাদের রক্ষা করল এবং লঞ্চে উঠিয়ে দিল। সেই অফিসারের কথা আজও মনে পড়ে। এরপর থেকে সব সময় রকেট স্টিমারে বরিশাল যাওয়া শুরু করলাম। একসময় দিনে স্টিমার সার্ভিস ছিল। অপূর্ব ছিল সেই জার্নি। বেলা ১১টায় সদরঘাট থেকে ছাড়ত সন্ধ্যা ৬টায় বরিশাল পৌঁছত। তারপর দিনের সার্ভিস হয়ে গেল রাতে। কেন হলো কে জানে। সন্ধ্যা ৬টায় ঢাকা থেকে ছেড়ে সকাল ৬টায় বরিশাল পৌঁছে যায়। ১২ ঘণ্টার জার্নি। সদরঘাট পর্যন্ত পৌঁছানোর ঝক্কি তো আছেই। আবার বরিশাল থেকে সন্ধ্যা ৬টায় ছেড়ে সকাল ৬টায় ঢাকা পৌঁছায়। ঢাকা বরিশাল যাওয়া যেন এক যুদ্ধ এবং ব্যয়বহুল। শুধু তাই না, যারা প্রথম শ্রেণিতে জার্নি করতে চান তাদের জন্য টিকিট পাওয়া লোটো পাওয়ার সমান। মতিঝিলে ছিল বিআইডব্লিউটিসির অফিস। সেখান থেকে ফার্স্টক্লাসের টিকিট কিনতে হতো। একবারের একটা ঘটনা বলি- সেটা ১৯৯৬ সাল। আলাউদ্দিন নামে একজন টিকিট ক্লার্ক ছিলেন তখন। তাকে গিয়ে এক দিন বললাম- ভাই, টিকিট লাগবে। একটা ডাবল কেবিন রিটার্নসহ দেন।

টিকিট তো নাই ভাই।

কেন নাই!

বোঝেনই তো ঈদের সময় ক্রাইসিস থাকে।

কিন্তু আমার টিকিট চাই।

দিতে পারব না।

আমি একটু জেদি এটা সবাই জানে। লিগ্যাল ব্যাপারে জেদি।

রোজার শুরুতে আসলাম তাও বলছেন টিকিট নাই!

জানেনই তো নানা কোটা। আর্মির কোটা, মন্ত্রী, এমপি, ডিসি সাহেবদের কোটা!

আমি রেগে বললাম, হ্যাং ইয়োর মন্ত্রী!

কী বললেন!

টিকিট দেন।

আপনি বরং চেয়ারম্যান সাহেবের কাছে যান। তাকে বলেন। আমি টিকিট দিলে আমার চাকরি চলে যাবে।

আমি চারতলায় চেয়ারম্যান সাহেবের রুমে গেলাম। প্রথমে আমাকে তার পিএ পাত্তাই দিল না। আমার দিকে তাকাচ্ছে না পর্যন্ত। টাইপ রাইটারে টাইপ করছে আর কথা বলছে,

স্যার বিজি আছেন, দেখা হবে না।

আমার যে তার সঙ্গে দেখা করতে হবে।

কী ব্যাপারে বলেন।

আপনাকে বলা যাবে না।

তাহলে তো দেখা হবে না।

আমি লোকটার চোখের দিকে কড়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম আপনি ভিতরে গিয়ে বলেন, যে একজন সাংবাদিক দেখা করতে চায়। দেখা করা তার দায়িত্ব। সঙ্গে আমার ভিজিটিং কার্ডটা দেবেন।

৩. এতে কাজ হলো। একটু পরই চেয়ারম্যান সাহেব তার রুমে ডাকলেন আমাকে। বসতে বললেন। চা অফার করলেন, কিছু খাজুরে গল্পও হলো এবং ইন্টারকমে আলাউদ্দিনকে ফোন করে বললেন, টিকিট দিতে। সেই থেকে আর কখনো টিকিটের সমস্যা হয়নি। আমি মাঝে মাঝে আলাউদ্দিনকে টাকা সাহায্য করতাম। তার স্ত্রী ছিল চিরঅসুস্থ। তার চিকিৎসার জন্য দিতাম। লঞ্চের টিকিট পাওয়াও ছিল এক কঠিন কাজ। আজও। সব বড় স্যারদের জন্য রিজার্ভ থাকে ভিআইপি কেবিনগুলো। এখানেও কোটা। লঞ্চ মালিকদের আমি কাউকে চিনি না। একবার বিমানে ঢাকা থেকে বরিশাল যাচ্ছি। আমার পাশের সিটে বসেছেন সুরভি লঞ্চের মালিকের ছেলে। তিনি বললেন, যখনই কেবিনের দরকার হবে ফোন দেবেন। আমার দরকার হয়নি অবশ্য। লঞ্চের সেই অভিজ্ঞার পর আমি লঞ্চে খুব একটা জার্নি করি না। কখনো করলেও বরিশালে আমার বন্ধুরা টিকিটের ব্যবস্থা করে দেয়। কানাডা আসার পরও আমি বরিশাল যাই প্রতি বছর এক দুবার। বেশির ভাগই বিমানে যাই। কিন্তু এখন নতুন সময়। নতুন আশা, নতুন স্বপ্ন, নতুন উচ্ছ্বাস, নতুন আবেগ। আর স্টিমার বা লঞ্চে যেতে হয় না। লঞ্চ মালিকদের খামখেয়ালির দিন শেষ হয়ে গেছে। কারও কাছে ধরনা ধরতে হয় না টিকিটের জন্য। বিআইডব্লিউটিসির চেয়ারম্যানের পিএর উপেক্ষা সহ্য করতে হয় না বা আলাউদ্দিনদের মতো কেরানিকে তোয়াজ করতে হবে না। মন্ত্রী, এমপি, ডিসি সাহেবরা যত খুশি কোটা উপভোগ করুক আমার কিছু যায় আসে না। আমি বরিশাল চলে যাই পদ্মা সেতু দিয়ে। এমনকি চাইলে আমি নিজে ড্রাইভ করেও চলে যেতে পারি। মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার পার হয়ে পোস্তগোলা থেকে এক্সপ্রেসওয়ে ধরব আমি। তারপর পদ্মা সেতু দিয়ে চলে যাব ভাঙ্গা পর্যন্ত। চার লেনের চমৎকার এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে ৩ ঘণ্টায় পৌঁছে যাওয়া যায় বরিশাল। যদি নিজেই ড্রাইভ করি পাশে বসে থাকবে আমার প্রেমিকা। বাতাসে চুল উড়বে তার। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখব। আহা এই দৃশ্য এখন আর কল্পনা না, বাস্তব। এদিকে মাওয়া প্রান্ত থেকে বরিশাল হয়ে কুয়াকাটা পর্যন্ত চার লেনের রাস্তা একনেকে পাস হয়ে আছে। বরিশালে এক দিন ট্রেনও যাবে! ট্রেনের লাক্সারি কোচে যেতে যেতে আমি আর জেসমিন স্মৃতিচারণা করব। একবার বুড়িগঙ্গায় বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে ডুবে যেতে নিয়েছিলাম সেই গল্প করব।

লেখক : সাংবাদিক

[email protected]

সর্বশেষ খবর