মঙ্গলবার, ৯ জানুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-কে নাপিতের নসিহত

আল্লামা মাহ্‌মূদুল হাসান

জিকিরের কয়েকটি ধাপ বুজুর্গানে দীন বলেছেন। জিকিরের প্রথম স্তর হলো- ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’। এই জিকির করতে করতে যখন নিজের মধ্যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়ে যায়, জাকের তখন প্রথম স্তর অতিক্রম করে দ্বিতীয় স্তর তথা ‘ইল্লাল্লাহ-এর স্তরে পৌঁছেন। যখন ‘ইল্লাল্লাহ পড়েও মন ভরে না, আল্লাহর পুরো আশেক হয়ে যান তখন তৃতীয় স্তর তথা শুধু আল্লাহ আল্লাহ বলতে থাকেন। যখন আরশের মালিকের সঙ্গে পূর্ণ সম্পর্ক হয়ে যায় তখনই তার আত্মা শান্তি পায়। অকল্পনীয় মহব্বত আল্লাহর ওলিরা নবীর রওজাতে গিয়ে সালাম দিলে সালামের জবাব পান। এমনকি মুসাফাহার জন্য কবর থেকে নবীর হাত বের হয়ে আসে। এগুলো সবার পক্ষে সম্ভব নয়। আবার সবাই বিশ্বাস করতেও পারেন না। যে ব্যক্তি যে বস্তু খায়নি সে কি সে বস্তুর মজা বুঝবে? এগুলো বুঝেছেন শাহ আহমদ কবির রেফায়ি, হজরত যিন্নুন মিসরি, ইমাম আবু হানিফা, জুনাইদ বাগদাদি (রহ.)। একটি জিজ্ঞাসা ও তার জওয়াব অনেকে প্রশ্ন করে যে, আল্লাহর নবীর রওজাতে গিয়ে সালাম দেওয়া হয় ‘আস্সালামু আলাইকা ইয়া রসুলুল্লাহ’ বলে, অথচ আমরা একে অপরকে সালাম দিই ‘আলাইকুম’ শব্দের মাধ্যমে। এই ব্যতিক্রমের কারণ কী? আরবি কুম (জমা) শব্দ আসে সম্মানের জন্য; তাহলে আমাদের নবী কি সম্মানের অধিক যোগ্য নন? অনেক আলেমকে এ প্রশ্নের উত্তর দিতে বলা হলে তারা হতবুদ্ধি হয়ে যান। এর সঠিক উত্তর হলো, মহব্বত এবং ভালোবাসার মধ্যে কোনো অংশীদারি থাকে না। যারা রওজাপাকে গিয়ে সালাম দেন তারা একমাত্র রসুলকেই সম্বোধন করতে চান, অন্যকে এখানে শরিক করতে চান না। এ কারণেই নবীপ্রেমীরা ‘আলাইকা’ শব্দ ব্যবহার করেন। তাদের মনের ধারণা এই যে, আমরা বিবি, বাচ্চা, সহায়-সম্পদ সবকিছু ছেড়ে এখানে এসেছি প্রিয়তমের কাছে, তাই সালাম শুধু তাঁকেই জানাই। হজরত থানভী (রহ.) বলেছেন, যারা আল্লাহর নবীর প্রেমিক হন তারা আগুন, পানি, মোটকথা দুনিয়ার কোনো কিছুই ভয় করেন না। তাদের কামনা থাকে শুধু মাশুককে পাওয়ার। মাশুকের ভালোবাসা তাদের অন্তরে এমনভাবে প্রোথিত হয়ে যায় যে, নববিবাহিতা জীবনসঙ্গীকে পেছনে ফেলে নবীর হুকুম মানার জন্য জিহাদের ময়দানে ছুটে চলেন। স্ত্রী যদি আপন স্বামী ছাড়া অন্য একজনকে ভালোবাসে তাহলে এটা কেমন অশান্তির বিষয় হয়? অন্যদিকে স্বামী যদি রাতে বাসায় একটু দেরি করে ফেরেন তাহলেই আর রক্ষা নেই। স্বামীকে শত প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। আমাদের দেশে এরকম শত ঘটনা আছে যে, দ্বিতীয় বিবাহ করার কারণে প্রথম স্ত্রী স্বামীকে রেখে অন্যত্র চলে গেছে। আসলে এখানে মহব্বত ও ভালোবাসার বিষয়টিই প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। যার দরুন সুখের সংসার ভেঙে তছনছ হয়ে যায়। রসুলের রওজাপাকে সালাম দেওয়ার বিষয়টিও এমনই। যারা আশেক হয়ে মদিনাতে যান তারা প্রিয়তম মাহবুব ছাড়া আর কাউকে পছন্দ করেন না। তাই তো সালামে ‘আলাইকা’ শব্দ ব্যবহার করে। এ কথায়  বোঝাতে চান যে, আমি শুধু আপনার প্রেমে পাগল হয়ে এখানে এসেছি, তাই সালাম শুধু আপনাকেই জানাই। মাশুকের প্রেমে পাগল হওয়ার একটি ঘটনা হজরত থানভী (রহ.) বলেন, এক বুজুর্গ এক দিন রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় দেখেন এক হাতুড়িওয়ালা হাতুড়ি দিয়ে পাথর ভাঙছেন আর সেখান থেকে এক ধরনের আওয়াজ বের হচ্ছে। বুজুর্গ পাশে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ পর বেহুঁশ হয়ে পড়েন। হাতুড়িওয়ালা এ অবস্থা দেখে শব্দ থামিয়ে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে বুজুর্গেরও হুঁশ ফিরে এলো। প্রশ্ন করা হলো, আপনার এ অবস্থা হওয়ার কারণ কী? বুজুর্গ উত্তর দিলেন, তোমার হাতুড়ির আওয়াজ থেকে আমার মাহবুবের নামের আওয়াজ তথা ‘আল্লাহ আল্লাহ’ শব্দের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলাম বিধায় সহ্য করতে না পেরে হুঁশ হারিয়ে ফেলি। সালামে বহুবচনের শব্দ ব্যবহারের রহস্য আল্লাহর নবী দুনিয়াতে থাকাকালে ‘কুম’ শব্দের মাধ্যমে সালাম শিক্ষা দিয়েছেন। সাহাবায়ে কেরামগণ এভাবেই তাঁকে সালাম দিতেন, কিন্তু যেহেতু তিনি এখন আর দুনিয়াতে নেই তাই এই বিধান এক্ষেত্রে পরিবর্তন হয়ে গেছে। রসুল (সা.) দুনিয়ার জীবনে আল্লাহর হুকুমে শরিয়ত প্রবর্তনকারী ছিলেন। তিনি তাঁর উম্মতকে এ শিক্ষা দিয়ে গেছেন যে, হে আমার উম্মত! তোমরা যারা কালিমা পড়েছ তারা সর্বদা একতাবদ্ধ থাকবে। কখনো বিচ্ছিন্ন হবে না। বিচ্ছিন্নতা তোমাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। তোমরা কথাবার্তায়ও একে অন্যকে একা হিসেবে সম্বোধন করো না। বরং একজনকেই জামাত মনে করবে। এ বিষয়টা শিক্ষা দোয়ার জন্যই রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালামের শব্দ ‘আস সালামু আলাইকুম’- এভাবে শিখিয়েছেন। হজের সময় এক নাপিত ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-কে চারটি নসিহত করেছিলেন- (১) ইবাদতের বিনিময় গ্রহণ না করা, (২) কিবলামুখী অবস্থায় থাকা, (৩) শুরু করার ক্ষেত্রে ডান দিককে প্রাধান্য দেওয়া, (৪) জিকিরের হালতে থাকা। নাপিত সব শেষে আরেকটি উপদেশ দেন।

তা হলো, ইমাম সাহেব চুল কাটা শেষে যখন ফিরে যাচ্ছিলেন, তখন নাপিত ডাক দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, হে আবু হানিফা, এখন কোথায় যাচ্ছেন? তিনি উত্তর দিলেন, আমার অবস্থানস্থলে যাচ্ছি। নাপিত বললেন, হজের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি আমল চুল না কাটলে তা সম্পূর্ণ হয় না। এখন যেহেতু হজ চুল কাটার মাধ্যমে পূর্ণ হয়েছে; আল্লাহ আপনাকে শরিয়তের একটি মহান ইবাদত সম্পন্ন করার তৌফিক দিলেন, এর জন্য কি আপনি  শোকরিয়াস্বরূপ দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করতে পারেন না? পরবর্তী সময়ে ইমাম সাহেব বলেছেন যে, আমি এই পাঁচটি মাসআলা নাপিতের কাছ থেকে শিখেছি। এখন প্রশ্ন হয় যে, তিনি তো একজন বড় মুজতাহিদ ছিলেন কিন্তু এই পাঁচটি মাসআলা না জেনে কেমন করে মুজতাহিদ হলেন? উত্তর হলো, মাসআলা জানা ছিল কিন্তু আমলে ছিল না বিধায় তা না জানার পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। তিনি বলেছেন, কিছুক্ষণ নাপিতের সুহবতে বসা ও তার উপদেশ শোনার পর এর আঁচড় আমার অন্তরে পড়েছে, যার পর আর কোনো দিনও এ আমলের কথা ভুলিনি।

লেখক : আমির, আল হাইআতুল উলয়া ও বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ

সর্বশেষ খবর