বৃহস্পতিবার, ১১ জানুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

জাদুকরী ব্যক্তিত্ব বিচারপতি মোরশেদ

রাজিয়া বেগম

জাদুকরী ব্যক্তিত্ব বিচারপতি মোরশেদ

কিছু মানুষ ইতিহাস তৈরি করেন এবং কিছু মানুষ এমন পরিস্থিতি তৈরি করেন যা সুনির্দিষ্ট দিকে তাদের পরিচালিত করে। সৈয়দ মাহবুব মোরশেদ এমন একজন ব্যক্তি ছিলেন যিনি  এ দুটি বিষয়কেই একত্রিত করেছিলেন। তাঁর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল সুস্পষ্ট। তাই, ইতিহাসবিদরা বিশেষ করে বিচারপতি মোরশেদকে তাঁর দৃঢ়চেতা ও সাহসী মনোভাব নিয়ে বিচারের রায় প্রদানের জন্য মনে রাখবেন। তাঁর রায়গুলো ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান ও তাঁর মৌলিক গণতন্ত্র অনুসারী সরকারের স্বৈরতন্ত্রের জন্য কাঁটা হয়ে উঠেছিল। দেশপ্রেমের নীতি অনুসরণ করার জন্য মোরশেদ ‘জীবন্ত ইতিহাস’ হয়ে আছেন। আলোচনা করতে চাই যেখানে তাঁকে দেখা হয়েছে বিচারক হিসেবে মোরশেদ এবং একজন মানুষ হিসেবে মোরশেদ।

প্রথমত, বিচারপতি হিসেবে তাঁর জীবন সম্পর্কে আলোচনা করব যখন তিনি ছিলেন হাই কোর্টের বিচারক বা সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য সুপ্রিম কোর্টের বিচারক। পরে প্রধান বিচারপতি হিসেবে তিনি সেই সময়ের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক পর্যায় থেকে বড় বাধা থাকা সত্ত্বেও নির্ভয়ে আইনের শাসনকে সমুন্নত রেখেছিলেন। সাংবিধানিক প্রশ্নে তাঁর সাহসী রায় ঘোষণার মাধ্যমে বিচারপতি মোরশেদ নিজেকে কেবল জাতীয় পর্যায়ে উচ্চ আসনে প্রতিষ্ঠিত করেননি, বরং স্বাধীন ও নির্ভীক হওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও পেয়েছিলেন। নানাভাবে তিনি ছিলেন জনগণের ন্যায়বিচার লাভের আশ্রয়স্থল।

এখানে তাঁর দেওয়া যুগান্তকারী রায়ের কয়েকটি উদাহরণ উপস্থাপন করা হলো। বিচারপতি মোরশেদ ১৯৫৯ সালে মার্শাল ল’ সরকারের বিরুদ্ধে প্রথমে আঘাত করেন। তিনি ইপিডি বাতিল ও অকার্যকর ঘোষণা করেছিলেন। এ কারণে অনেক শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিবিদ বেকায়দায় পড়েন। মন্ত্রীদের কয়েকজনও অপসারিত হয়েছিলেন। বিচারপতি মোরশেদ এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন যে, ‘আদালত যা মীমাংসা করে তা ক্ষমতার অপব্যবহার নয়।’ আবু মাহমুদ মামলায় গভর্নর মোনায়েম খানকে তলব এবং একটি কমিশন গঠন করা হয়েছিল। বিচারপতি মোরশেদ তখন গভর্নরের আইনজীবীদের বলেছিলেন, ‘গভর্নরকে বলুন আমার আদালত ন্যায়বিচারের স্থান, ভীতি সঞ্চারের কক্ষ নয়।’ এটা হচ্ছে তাঁর সাহসিকতার নজির। বিচারপতি মোরশেদের রায়গুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল পান মামলায় দেওয়া রায় যা আন্তর্জাতিক আইনবিদদের মতে আইনি ইতিহাসের অন্যতম সেরা রায়।

বিচারপতি মোরশেদ পিতা ছিলেন বাংলার প্রথম বিভাগীয় কমিশনার। তাঁর মা হচ্ছেন শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের ছোট বোন। তিনি তৎকালীন কলকাতার মেয়র জাকারিয়ার একমাত্র সন্তানকে বিয়ে করেছিলেন। সৈয়দ মাহবুব মোরশেদ স্কুল, প্রেসিডেন্সি কলেজ বা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার সময় বরাবরই একজন মেধাবী শিক্ষার্থী হিসেবে স্বাক্ষর রেখেছেন। পরে তিনি লিংকনস ইন লন্ডন থেকে ব্যারিস্টার হয়।

১৯৪২ সালে তাঁর মামা এ কে ফজলুল হককে সমর্থন করে লেখা তাঁর নিবন্ধ একই সঙ্গে ‘স্টেটসম্যান’ কলকাতায় ও ‘গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় যা পাঠকদের মধ্যে সাড়া জাগায়। মোরশেদের মানবতাবাদী মন তাঁকে ‘আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম’ গঠনে উদ্বুদ্ধ করেছিল। পঞ্চাশের দশকে তিনি একজন বিচারকের দায়িত্ব পালনকালে রেড ক্রসের চেয়ারম্যান ছিলেন। এ ছাড়াও তিনি সারা জীবন অনেক আর্থসামাজিক কর্মকান্ডে জড়িত ছিলেন।

বিচারপতি মোরশেদ সাংস্কৃতিক স্বাধীনতায় বিশ্বাসী ছিলেন। সর্বোচ্চ মহলের বিরোধিতা সত্ত্বেও তিনি ১৯৬১ সালে সারা দেশে রবিঠাকুরের জন্মশতবর্ষ উদযাপনের আয়োজন করেছিলেন।

১৯৫৪ সালে মোরশেদ তাঁর মামা শেরেবাংলার নেতৃত্বে আবুল মনসুর আহমেদের সঙ্গে ঐতিহাসিক ২১ দফার খসড়া তৈরি করেছিলেন যা তৎকালীন যুক্তফ্রন্ট সরকারের নিরঙ্কুশ বিজয় নিশ্চিত করেছিল। ১৯৬৬ সালের দিকে অগাধ দেশপ্রেমের ফলে তিনি আবারও ঐতিহাসিক ছয় দফার খসড়া চূড়ান্ত করতে ভূমিকা রেখেছিলেন। এ ছয় দফার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব লড়াই করে জেলে গিয়েছিলেন।

অনেক বর্ষীয়ান ছাত্রলীগ নেতা স্মৃতিচারণা করে বলেছেন যে, একই বছর কেবল প্রধান বিচারপতি মোরশেদই তাদের বার্ষিক সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত হওয়ার সাহস করেছিলেন। সে অনুষ্ঠানেই মোরশেদ জেলখানায় আটক শেখ মুজিবের মতোই প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের জন্য সাহসী ডাক দিয়েছিলেন।

১৯৬৭ সালের শেষ দিকে মোরশেদ প্রধান বিচারপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেন। তিনি প্রথম যে কাজটি করেছিলেন তা হলো- আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আইনি লড়াইয়ের ব্যবস্থা করা।

ঐতিহাসিক গোলটেবিল বৈঠকে সভাপতিত্ব করার সময় মোরশেদ এক ব্যক্তির একটি ভোটের প্রস্তাব করেছিলেন যা গৃহীত হয়েছিল। এ কারণেই পাকিস্তানের জাতীয় সংসদে ৩০০ আসনের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের অংশে ১৬৯টি আসন পেয়েছিল। এর আগে উভয় অংশে ১৫০টি আসনের সমতা ছিল। মোরশেদের এক ব্যক্তির একটি ভোটের প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার মাধ্যমে আরও সিদ্ধান্ত হয় যে, যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পাবে তারা সরকার গঠন করবে।

সাংবিধানিক বিধিবিধানের বিষয়ে তৎকালীন হাই কোর্ট বার ও আইনজীবীদের মধ্যে বিচারপতি মোরশেদ যে শ্রদ্ধাবোধ সৃষ্টি করেছিলেন সে কারণে ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে গণআন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে কোনো বিচারক জেনারেল টিক্কা খানকে গভর্নর পদে শপথ পাঠ  করাতে রাজি হননি বা সাহস করেননি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সহযোগিতা করতে তাঁর অস্বীকৃতি জানানো নজির হয়ে রয়েছে।

 

লেখক : গবেষক এবং সাবেক বিশ্বব্যাংক কর্মকর্তা

সর্বশেষ খবর