শনিবার, ১৩ জানুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

রাজ্জাক কবরী ও অন্যদের কিছু কথা

ইমদাদুল হক মিলন

রাজ্জাক কবরী ও অন্যদের কিছু কথা

সুভাষ দত্ত খুবই বিনীতভাবে আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। আমাকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে গেলেন। আমি লাফ দিয়ে সরে গেছি। ‘এ কী করছেন দাদা?’ তিনি হাসিমুখে বিনম্র কণ্ঠে বললেন, ‘সিনেমা বা নাটকের ফার্স্ট শর্টের সময় আমি রাইটারকে প্রণাম করি। আমি মনে করি একজন লেখকই এই শিল্পটির প্রধান ব্যক্তি।’ শুনে আমার চোখে পানি এসে গিয়েছিল। এমন মানুষও হয়! সুভাষ দত্ত আমাদের চলচ্চিত্রের এক বটবৃক্ষ। খুবই মিষ্টি সুন্দর সুন্দর চলচ্চিত্র তৈরি করেছেন। হাসি আনন্দ আর প্রেমে ভর্তি চমৎকার বিনোদনমূলক সিনেমা। নিজে এক অসামান্য অভিনেতা। কমেডি চরিত্রে তাঁর কোনো তুলনা ছিল না। অসামান্য পড়াশোনা ছিল। নিয়মিত সাহিত্যপাঠ করতেন। ছবি আঁকতেন নিজের আলাদা বৈশিষ্ট্য নিয়ে। ব্যক্তিজীবনে ছিলেন খুবই নিয়ম মেনে চলা মানুষ। সেই ১৯৬৭ সালে ‘সুতরাং’ নামে একটি সিনেমা করলেন। তখন তাঁর যৌবনকাল। মোটেই নায়কোচিত ছিলেন না। ছিলেন মধ্যবিত্ত পরিবারের একেবারেই সাদামাটা এক যুবক। স্বাস্থ্য খারাপ, গাল-মুখ ভাঙা, উচ্চতাও কম। সিনেমার নায়ক তাঁকে ভাবাই যায় না। তবু তিনি সিনেমার নায়ক হলেন। নায়কও তিনি, পরিচালকও তিনি। শচীন ভৌমিক নামে একজন লেখক ছিলেন। মূলত ছিলেন চলচ্চিত্র সাংবাদিক। গান গল্প লিখতেন। রম্য রচনা লিখতেন। কলকাতার ‘ঘরোয়া’ নামে একটি পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পরে মুম্বাইতে চলে যান। সেখানে সিনেমার গল্প লিখতেন, চিত্রনাট্য করতেন। জনপ্রিয় লেখক। তাঁর লেখা বিখ্যাত বাংলা গান আছে, ‘মনে পড়ে রুবি রায়’। রাহুল দেববর্মণ গেয়েছিলেন। আমাদের কিশোর বয়সে এ গান মানুষের মুখে মুখে ফিরত। বহুকাল অতিক্রম করে গানটি এখনো জনপ্রিয়। নতুন নতুন শিল্পীরা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গেয়ে থাকেন। ‘বেডসাইড শচীন ভৌমিক’ নামে তাঁর একটি বই পড়ে আমি খুব মজা পেয়েছিলাম। ‘সুতরাং’ ছিল এ শচীন ভৌমিকের লেখা ছোটগল্প। নিজে নায়ক ও পরিচালক হয়ে এ গল্প চলচ্চিত্রে নিয়ে এলেন সুভাষ দত্ত। চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে একটি কিশোরী মেয়েকে খুঁজে এনে ‘সুতরাং’ সিনেমার নায়িকা করে দিলেন। মেয়েটি তখন ক্লাস এইটে পড়ে। শ্যামলবরণ গায়ের রং। গোলগাল অত্যন্ত আকর্ষণীয় মুখ। চোখ দুটো সুন্দর। হাসিটি অতুলনীয়। গলার স্বরও একটু অন্যরকম। হাইট তেমন বেশি না। কিন্তু মেয়েটির দিকে তাকালে চোখ জুড়িয়ে যায়। সম্পূর্ণ বাঙালি কন্যা। তখনো অভিনয়ের কিছুই জানেন না তিনি। তারপরেও চরিত্রটির সঙ্গে মিলেমিশে চমৎকার অভিনয় করলেন। এ মেয়েটির নাম কবরী। পরবর্তীকালে বাংলা চলচ্চিত্রের ‘মিষ্টি মেয়ে’ হিসেবে খ্যাত হলেন। কত স্মরণীয় আর কত তুমুল জনপ্রিয় চলচ্চিত্রে তিনি একের পর এক অভিনয় করে গেলেন দীর্ঘ সময় ধরে। ‘রাজ্জাক-কবরী’ জুটি একসময় জনপ্রিয়তার তুঙ্গে পৌঁছে গেল। রাজ্জাকের নায়িকা তখন অনেকেই। কবরী, সুচন্দা, শাবানা, ববিতা, সুজাতা এসব নায়িকার নায়ক হয়ে একের পর এক জনপ্রিয় চলচ্চিত্র উপহার দিয়ে গেছেন রাজ্জাক। ‘রংবাজ’ সিনেমাটির কথা খুব মনে পড়ে। কবরীর ঠোঁটে ‘সে যে কেন এলো না, কিছু ভালো লাগে না’, এ গান দারুণ জনপ্রিয় হয়ে গেল।

সুভাষ দত্তের সাহিত্যপাঠের কথা বলছিলাম। আলাউদ্দিন আল আজাদের ‘তেইশ নম্বর তৈলচিত্র’ উপন্যাসটিকে পর্দায় নিয়ে এলেন তিনি। ছবির নাম ‘বসুন্ধরা’। একজন নতুন নায়ক আনলেন এ চলচ্চিত্রের জন্য। তাঁর নাম ইলিয়াস কাঞ্চন। চম্পার সঙ্গে জুটি বেঁধে ইলিয়াস আমার বেশ কয়েকটি নাটকে অভিনয় করেছেন। জগন্নাথ কলেজে আমাদের জুনিয়র ছিলেন। ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলন নিয়ে পথে নামলেন, এক ভয়ংকর দুর্ঘটনায় স্ত্রীকে হারানোর পর। আশরাফ সিদ্দিকীর একটি গল্প স্কুলে সেভেন বা এইটে আমাদের পাঠ্য ছিল। গল্পটির নাম ‘গলির ধারের ছেলেটি’। সুভাষ দত্ত এ গল্প নিয়ে সিনেমা করলেন ‘ডুমুরের ফুল’ নামে। অসামান্য সিনেমা। হুমায়ূন আহমেদের গল্প বা উপন্যাস নিয়েও সিনেমা করেছিলেন। নাম ছিল ‘আবদার’। রাজ্জাক ববিতাকে নিয়ে দুর্দান্ত প্রেমের সিনেমা করেছিলেন ‘আকাক্সক্ষা’ নামে। রাজ্জাক ববিতাকে খুবই মানিয়েছিল সিনেমাটিতে। কত আগে দেখেছি! এখনো সেই সিনেমার দুই-একটি দৃশ্য চোখে লেগে আছে। সঙ্গে ববিতার আরেকটি সিনেমার কথা খুব মনে পড়ে। ‘আলোর মিছিল’। ববিতা হয়েছিলেন রাজ্জাকের ভাগনি। দুজনেরই এত প্রাণবন্ত অভিনয় এবং আবেগে ভরপুর সিনেমা! শেষ পর্যন্ত ‘আলো’ নামের ববিতার মৃত্যু দর্শকের চোখ ভিজিয়ে দিয়েছিল। সেই ছবির পরিচালক ছিলেন মিতা। ফারুকের সঙ্গে ববিতার সিনেমা ছিল ‘নয়নমনি’ ও ‘গোলাপি এখন ট্রেনে’। আমজাদ হোসেন পরিচালিত এ ছবি দুটো বাংলা চলচ্চিত্রের স্থায়ী সম্পদ। ‘লাঠিয়াল’ নামে ফারুকের একটি সিনেমার কথা মনে পড়ে। সেই ছবিরও পরিচালক মিতা। ফারুকের বড় ভাইয়ের চরিত্রে আনোয়ার হোসেন। ছবিতে তাঁর চরিত্র লাঠিয়ালের। ছোট ভাই ফারুক বাঁশি বাজায়। এ সিনেমাটির থিম আমার খুব ভালো লেগেছিল। ‘যে বাঁশে বাঁশি হয় সেই বাঁশে লাঠিও হয়’। ফারুক কবরীর দুটি সিনেমার কথাও কখনোই ভুলতে পারব না। একটি ‘সারেং বউ’ আরেকটি ‘সুজন সখি’। দুটোই প্রেমের সিনেমা। দুটোই অতুলনীয়। অসাধারণ সব গান ছিল দুটো সিনেমাতেই। নায়ক ফারুকের ক্যারিয়ারে এ পাঁচটি ছবি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে এ ছবিগুলো চিরস্থায়ী আসন করে নিয়েছে। কোনো কোনোটা ক্লাসিক হিসেবে গণ্য।

আমার বন্ধু আবদুর রহমান চমৎকার ছড়া লিখত। আমরা একসঙ্গে ‘চাঁদের হাট’ নামের সংগঠনটি করেছি। রহমান চলচ্চিত্র সাংবাদিকতা শুরু করে ‘চিত্রালী’ পত্রিকাতে। একসময় নিজেও পত্রিকা সম্পাদনা করতে থাকে। ‘আকর্ষণ’ নামে পত্রিকা বের করল। সেই পত্রিকাতে আমি নতুন ধরনের একটি লেখা লিখতে শুরু করেছিলাম। বিষয় ‘কাল্পনিক সাক্ষাৎকার’। রেখা, অমিতাভ বচ্চন এরকম কারও কারও কাল্পনিক সাক্ষাৎকার নিতে শুরু করেছিলাম। তারপর রহমান আরেকটি পাক্ষিক পত্রিকা বের করল ‘প্রিয়জন’ নামে। সেই পত্রিকাতেও নানা রকমের লেখা লিখেছি। রহমানের বাবা ঢাকা সিড স্টোরের মালিক। দৈনিক বাংলার পূর্বপাশে সিড স্টোরের শোরুম এবং নার্সারি। এখন সেখানটায় দশ-বারোতলা বিল্ডিং করেছে রহমানরা। আটাত্তর সালের দিকে ঢাকা সিড স্টোরের বাইরের দিককার একটা রুমে রহমান অভিনব এক ব্যবসা শুরু করেছিল। সে একটা ফুলের দোকান খুলে বসেছিল। ফুল বিক্রি করত, তাজা ফুল দিয়ে বরযাত্রার গাড়ি সাজিয়ে দিত ইত্যাদি ইত্যাদি। রহমান খুবই ক্রিয়েটিভ মানুষ। বছরখানেক হয়তো ফুলের দোকানটি সে চালু রেখেছিল। তারপর বন্ধ হয়ে যায়। ভাবতে অবাক লাগে, শাহবাগের মোড়ে এখন বিশাল ফুলের মার্কেট, পাঁচ দশ কোটি টাকার ফুল বিক্রি হয় বছরে। অথচ আজ থেকে পঁয়তাল্লিশ বছর আগে রহমান এই ব্যবসাটির গোড়াপত্তন করেছিল। সেই ইতিহাস কেউ মনে রাখেনি। রহমানের ফুলের দোকানে বসে আড্ডা দিতে দিতে ‘ও রাধা ও কৃষ্ণ’ উপন্যাসের আইডিয়া পেয়েছিলাম আমি। সেই উপন্যাসে এ দোকানটির উল্লেখও আছে।

রহমানকে খুব ভালোবাসতেন নায়ক ফারুক। রহমানের বন্ধু হিসেবে আমাদের কয়েকজনকেও প্রশ্রয় দিতে শুরু করেছিলেন ফারুক ভাই। পাভেল রহমান, আলীমুজ্জামান হারু কখনো কখনো আফজাল হোসেন আর আমাকে ফারুক ভাইয়ের অফিসে নিয়ে যেত রহমান। বিজয়নগরের সিনেমার অফিসপাড়ায় ফারুক ভাইয়ের অফিস ছিল। দুপুরবেলা খাওয়ার পয়সা না থাকলে রহমান আমাদের ফারুক ভাইয়ের অফিসে নিয়ে যেত। আমাদের মুখ দেখেই ফারুক ভাই যা বোঝার বুঝে যেতেন। সঙ্গে সঙ্গে মোরগ পোলাওয়ের অর্ডার দিতেন। মুরগির রোস্ট আর সেভেনআপ, বড় বড় মিষ্টি ভরপেট খেয়ে ঢেঁকুর তুলতে তুলতে আমরা ফিরে আসতাম। তারপর জীবনের টানে আমরা একেকজন একেকদিকে চলে গেছি। ফারুক ভাইয়ের সঙ্গে দু-চার বছরে এক আধবার দেখা হতো। অনেক দিনের না দেখা ছোট ভাইটিকে যেমন করে জড়িয়ে ধরেন পিতৃতুল্য বড় ভাই ঠিক সেভাবে ফারুক ভাই আমাকে জড়িয়ে ধরতেন। একবার এক অনুষ্ঠানে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে অনেকক্ষণ ধরে আমার কথা বললেন। ‘নিউজ টোয়েন্টিফোরের’ একটা অনুষ্ঠানে এলেন। আমি তাঁর ইন্টারভিউ নিলাম। অনুষ্ঠান শেষে খামে ভরে তাঁকে যে সম্মানির টাকাটা দেওয়া হলো সেই খামটা আমার পকেটে গুঁজে দিয়ে গাড়িতে চড়লেন। এমপি হওয়ার পর তাঁর সঙ্গে আর দেখা হয়নি। দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকলেন। কখনো সিঙ্গাপুরের হাসপাতালে, কখনো ঢাকায়। ফারুক ভাইয়ের সঙ্গে আর কখনোই দেখা হয়নি। তাঁর ভালোবাসার গভীর স্পর্শটুকু রয়ে গেছে হৃদয়জুড়ে।

ষাটের দশকের গোড়ার দিকে কলকাতা থেকে স্ত্রীর হাত ধরে সুদর্শন এক যুবক ফুলবাড়িয়া কিংবা কমলাপুর স্টেশনে এসে নামলেন। কলকাতার স্টেজে অভিনয় করতেন। ছোটখাটো চরিত্রে সিনেমাতেও অভিনয় করতেন। ঢাকায় এসে খুবই স্ট্রাগলের মধ্যে পড়েছিলেন। অভিনয়ই তাঁর ধ্যানজ্ঞান। এর বাইরে কিছু শেখেননি, করতেও পারেন না। তাঁকে প্রথম সুযোগ করে দিলেন জহির রায়হান। সিনেমার নাম ‘বেহুলা’। নায়িকা সুচন্দা। সেই ছবিতে সিংহভাগ সময় তাঁকে মৃত লখিন্দরের ভূমিকায় শুয়ে থাকতে হলো। দেবপুরিতে গিয়ে বেহুলারূপী সুচন্দা ‘ময়ূরনাচে’ দেবতাদের মুগ্ধ করে স্বামী লখিন্দরকে জীবিত করে আনলেন। ব্যাপক জনপ্রিয় হলো ‘বেহুলা’। সুচন্দার ‘ময়ূরনাচ’ এখনো আমার চোখে লেগে আছে। আর এ সিনেমাটি যে মানুষটির ভাগ্য খুলে দিল তাঁর নাম রাজ্জাক। তারপর থেকে রাজ্জাককে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ধীরে ধীরে তিনি হয়ে উঠলেন জনপ্রিয়তম নায়ক। যে ছবিতেই অভিনয় করেন সেই ছবিই জনপ্রিয়তার তুঙ্গ স্পর্শ করে। বলতে গেলে তাঁর কোনো ফ্লপ ছবিই নেই। আহমেদ জামান চৌধুরী ছিলেন বিখ্যাত চলচ্চিত্র সাংবাদিক। সিনেমার গল্প লিখতেন, চিত্রনাট্য করতেন গানও লিখতেন। চলচ্চিত্রবিষয়ক জনপ্রিয় সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘চিত্রালী’র সম্পাদক হলেন। রাজ্জাকের উপাধি দিলেন ‘নায়করাজ’। নায়কদের রাজা। সত্যিকার অর্থেই এদেশের নায়কদের রাজা হয়ে বিরাজ করতে লাগলেন রাজ্জাক ভাই। কত কত স্মরণীয় ছবি তাঁর। জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’ মুক্তি পেয়েছিল ১৯৭০-এর শেষদিকে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ছিল এ ছবির মূল থিম। এ এক ঐতিহাসিক চলচ্চিত্র। নায়করাজ চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন এ চলচ্চিত্রটির জন্য। কাহিনি ও চিত্রনাট্য ছিল আমজাদ হোসেনের। আমাদের চলচ্চিত্রের এ আরেক মহিরুহ, আমজাদ হোসেন। চমৎকার গল্প উপন্যাস লিখতেন। টেলিভিশনের জন্য লিখতেন ঈদের নাটক ‘জব্বর আলী’। কী জনপ্রিয় সেসব নাটক। পরিচালক হিসেবে অতুলনীয়। অভিনয়েও ছিলেন সমান দক্ষ। ‘জব্বর আলী’ চরিত্রে তাঁর তুলনা ছিল না। তারও আগে রুবিনা নামের এক অভিনেত্রীর সঙ্গে জোড় বেঁধে সিনেমার কমেডি চরিত্রে অভিনয় করতেন। সেখানেও তুমুল জনপ্রিয়। আমাকে খুব ভালোবাসতেন। চট্টগ্রামে একবার এক বইমেলায় আমজাদ ভাই আর আমাকে ডাকা হয়েছিল। তখন দুর্গাপূজা চলছে। হোটেলে আমরা এক রুমে আছি। নিজের জীবনের অসামান্য সব ঘটনা বলে যাচ্ছিলেন আমজাদ ভাই। ব্যাপক অভিজ্ঞতার কথা বলে যাচ্ছিলেন। আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম। সে রাতে কয়েকজন যুবক এসে আমাদের নিয়ে গেল পূজা দেখাতে। পূজামন্ডপে গিয়ে আমজাদ ভাই দুর্গামূর্তির সামনে ধূপদানি হাতে নিয়ে এত সুন্দর নাচলেন, সেই দৃশ্য এখনো আমার চোখে লেগে আছে।

এ লেখা লিখতে বসে বিচ্ছিন্নভাবে বহু ঘটনা মনে পড়ে। রাজ্জাক-কবরীর ‘ময়নামতি’ সিনেমাটির কাহিনি ও চিত্রনাট্য লিখেছিলেন সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক। চলচ্চিত্রটির কোনো কোনো গানও বোধহয় তাঁর লেখা ছিল। এ সিনেমা দেখেছিলাম ‘ডায়না’ হলে। আমার ধারণা পাঁচ সাতবার দেখেছি। দেখে আশ মিটতো না। কী সুন্দর অভিনয়, কী সুন্দর গান আর গল্প। রাজ্জাকের বাবার চরিত্রে এ টি এম শামসুজ্জামান। ভিলেন এবং অর্থলোভী। ছেলে বোটানি পড়তে চায়। তিনি বললেন, ‘থোও তোমার বোটানি আর ফুটানি’। এ সংলাপ এখনো আমার কানে লেগে আছে। তিন চারজন তুমুল জনপ্রিয় কমেডিয়ান ছিলেন তখন। খান জয়নুল, হাসমত, আশীষ কুমার লোহ। তাঁরা পর্দায় এলেই আনন্দে আত্মহারা হতো দর্শক। খান জয়নুল ছিলেন বিক্রমপুরের লোক। আমার বন্ধু নূহদের পরিচিত। খান জয়নুলের বাসায় নূহ একবার আমাকে নিয়ে গিয়েছিল। সেই প্রথম অমন একজন অভিনেতাকে খুব কাছ থেকে দেখেছিলাম। হাসমত সব সময় ‘হাবা চরিত্রে’ অভিনয় করতেন। এজন্য তাঁর নাম পড়ে গিয়েছিল ‘হাবা হাসমত’। আশীষ কুমার লোহ লেখালেখিও করতেন। তাঁর দুয়েকটি গল্প খুব বিখ্যাত হয়েছিল। এ তিনজনকে নিয়ে ‘ত্রিরত্ন’ নামে একটি ধারাবাহিক হতো বিটিভিতে। খুবই জনপ্রিয় ছিল। এ টি এম শামসুজ্জামান জনপ্রিয় হলেন আরেকটু পরে। পুরান ঢাকার সূত্রাপুরে থাকতেন। ডাকনাম খোকন। তাঁর ছোট ভাই মানিক আমার বন্ধু। আমি তাঁকে ‘দাদা’ ডাকতাম। আমার লেখা খুব পছন্দ করতেন। দেখা হলেই লেখালেখি নিয়ে কথা বলতেন।

রাজ্জাক যখন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে, তখন তাঁকে কাছাকাছি থেকে দেখার লোভে আমি আর আমার এক বন্ধু এফডিসির পশ্চিম দিককার গেটে গিয়ে পাঁচ-ছয় ঘণ্টা দাঁড়িয়েছিলাম। তবু দেখতে পাইনি। ভেবে খুব গৌরববোধ করি সেই রাজ্জাক সাহেব, আমাদের নায়করাজ তাঁর জীবনের শেষ সিনেমাটি করেছিলেন আমার গল্প নিয়ে। ‘আয়না কাহিনি’। পরিচালনার কাজ অনেক আগেই শুরু করেছিলেন তিনি, ‘আয়না কাহিনি’ দিয়েই শেষ করলেন। খুব ভালোবাসতেন আমাকে, সম্মান করতেন। ‘পাঁচ নায়িকা’ নামে আমার একটি প্রেমের উপন্যাসের সংকলন রাজ্জাক ভাইকে উৎসর্গ করেছিলাম। প্রতিটি লেখাই তাঁর খুব ভালো লেগেছিল। আমাকে একদিন ফোন করে বললেন, ‘এই পাঁচটি কাহিনি নিয়েই পরবর্তী পাঁচটি সিনেমা তিনি পরিচালনা করবেন।’ আমার দুর্ভাগ্য নায়করাজ সেই সময় পেলেন না।

যে মিষ্টি মেয়ে কবরী ছিলেন আমার স্বপ্নের নায়িকা, তাঁর সঙ্গে একসময় এত বন্ধুত্ব হলো, প্রায়ই ফোন করতেন। বহুক্ষণ ধরে গল্প করতেন। টেলিভিশনে বহু অনুষ্ঠান করেছি তাঁর সঙ্গে। অত্যন্ত স্পষ্টবাদী মানুষ ছিলেন। কথা বলায় বিন্দুমাত্র জড়তা ছিল না। কারও তোয়াক্কা করে, আর কারও মন রাখার জন্য সত্য বলা থেকে কখনোই দূরে থাকেননি। একবার তাঁর গুলশানের বাসায় ডাকলেন আমাকে। আমার গল্প নিয়ে সিনেমা বানাতে চান। দীর্ঘক্ষণ আড্ডা গল্প হলো। আমাকে কিছু টাকা অগ্রিম হিসেবে দিলেন। তারপর তিনি জড়িয়ে গেলেন রাজনীতিতে। অর্ধেক পথে লেখা আটকে গেল আমার। কিন্তু আমি এক অপরাধবোধে ভুগছিলাম। কাজটা যেহেতু হলো না, টাকাটা তো ফেরত দেওয়া উচিত! টাকা নিয়ে একদিন গেলাম তাঁর ফ্ল্যাটে। সেই টাকা কিছুতেই ফেরত নিলেন না। বললেন, ‘ওটা সামান্য টাকা। আপনার গাড়ির তেল খরচ হয়েছে এর চেয়ে অনেক বেশি।’ ‘করোনা’ কেড়ে নিল আমাদের এ মিষ্টি মেয়েটিকে। আমি তখন থাকি মগবাজারে। ‘কালের কণ্ঠ’ পত্রিকার সম্পাদক। অনেক রাতে বাসায় গিয়েছি, ঘুমিয়েও পড়েছি। অফিস থেকে ফোন করল আমার অত্যন্ত প্রিয় মেহেদী হাসান তালুকদার। কবরীর চলে যাওয়ার খবরটি দিল। সেই ধাক্কা আমি নিতেই পারছিলাম না। তার ওপর মেহেদী এক দায়িত্ব চাপাল, এখনই কবরীকে নিয়ে একটা লেখা তৈরি করে দিতে হবে। সেই লেখা ওরা নগর সংস্করণে ছাপবে। সংবাদপত্রে এ ধরনের কাজ অনেক সময় করতে হয়। কবরীর সঙ্গে বহুদিনকার বহু স্মৃতি। যতটা সম্ভব ফোনেই গুছিয়ে বলতে লাগলাম। মেহেদী রেকর্ড করল। ভেবেছিলাম তিন চার শ শব্দ হবে। লেখা শেষ হওয়ার পর মেহেদী বলল, ‘সাড়ে আট শর মতো শব্দ হয়েছে।’ সেই লেখাই ছাপা হলো।  প্রিয় মানুষদের নিয়ে লিখতে বসলে ছোট বড় মিলিয়ে কত ঘটনা যে মনে আসে, বলে শেষ করা যায় না। এই লেখা লিখতে গিয়েও একই রকম অনুভূতি। যাঁদের নিয়ে লিখলাম, তাঁদের নিয়েই তো আরও কত স্মৃতি রয়ে গেল। এর বাইরে রয়ে গেল আমাদের চলচ্চিত্রের আরও বেশ কয়েকজন নায়ক নায়িকার সঙ্গে, অভিনেতা অভিনেত্রী ও পরিচালকদের সঙ্গে, লেখকদের সঙ্গে, অনেক অনেক স্মৃতি ও মধুময় দিন কাটানোর কথা। হয়তো পরে আবার কখনো তাঁদের কথা লিখব।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও প্রধান সম্পাদক, কালের কণ্ঠ

সর্বশেষ খবর