সোমবার, ১৫ জানুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

পুণ্য হোক-পূর্ণ হোক এই আলোকিত যাত্রা

আবেদ খান

পুণ্য হোক-পূর্ণ হোক এই আলোকিত যাত্রা

এবারকারের সাধারণ নির্বাচনে এক অসাধারণ বিজয়ের সাক্ষী হওয়ার সুযোগ পেলাম। প্রায় আশি ছুঁইছুঁই বয়সের প্রান্তে দাঁড়িয়ে বলতে পারি, এ আমার অনবদ্য অর্জন। সাংবাদিকতা পেশার এই ষাটোর্ধ্বকাল সময়ে চারটি সফল নির্বাচনের প্রত্যক্ষদর্শী হতে পেরেছি। সত্তরের মহান নির্বাচনের সময় নিবেদিতপ্রাণ রাজনৈতিক কর্মীর মতো উদয়াস্ত পরিশ্রম করেছি সাংবাদিকতা পেশার পাশাপাশি বাড়তি শ্রম দিয়ে। তখন বয়স ছিল, উদ্দীপনা ছিল। পিছুটান বলতে তো কিছুই ছিল না, মা ছাড়া। সেটা ছিল বঙ্গবন্ধুর ডাকে ঝাঁপিয়ে পড়া ঐতিহাসিক নির্বাচন। 

এরপর ভোট কেন্দ্রে গিয়েছি ’৯৬-এ বঙ্গবন্ধুকন্যার বিজয়ের নির্বাচনে। তৃতীয়টি তাঁর বিজয়ের সোপানে পদস্পর্শ করার নির্বাচনে এবং এবার এই নির্বাচনে,  যেখানে তিনি একমেবাদ্বিতীয়ম।

এবার ভোট কেন্দ্রে দেখেছি পরিচ্ছন্ন পরিবেশ। প্রচারণার সীমানা নির্ধারিত এবং  যেটা অতিক্রম করার কোনো লক্ষণ পরিদৃষ্ট হয়নি কোথাও। পরিচ্ছন্ন ব্যবস্থাপনার জন্য প্রতিফলন ঘটতে পেরেছে মানুষের ইচ্ছার। মানুষের মধ্যে নির্বাচনের বিষয়ে যে আগ্রহ দেখা গিয়েছিল সেটার চমৎকার ছাপ দেখা গেছে। নির্বাচনে যারা অংশগ্রহণ করেনি, তারা রাজনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে এবং জনসম্পৃক্ততা হারিয়েছে- এ কথা শুধু আমার নয়, অনেক আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকেরও অভিমত। মার্কিন সরকারের এবং অন্ধ বাংলাদেশ বিরোধিতায় আচ্ছন্ন কিছু মানুষ ও কিছু মহল উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এ নির্বাচনের ব্যাপারে প্রচারণা করেই চলেছে। তাদের গাত্রদাহ হওয়ার কারণ হচ্ছে, আওয়ামী লীগের বিপুল জনপ্রিয়তা। তাদের একমাত্র লক্ষ্যই হচ্ছেন শেখ হাসিনা। তারা পরিষ্কারভাবে বুঝে গেছে, এই অপরাজেয় মানুষটিকে পরাস্ত করা সহজ নয়। এটাও স্পষ্ট হয়ে গেছে, এখন শেখ হাসিনার ওপর আঘাত করার অর্থ বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষের ওপর আঘাত করা। আর শুধু বাংলাদেশের মানুষই নয়, ভারত-রাশিয়া-চীন থেকে শুরু করে ইউরোপ-আমেরিকার সাধারণ মানুষও এই আঘাত মেনে নেবে না।

আমার ধারণা, এই দিক থেকে বিচার করলে বলতেই হবে যে, এই নির্বাচনটার খুব দরকার ছিল, এই বিজয়ের খুবই দরকার ছিল। কারণ এই নির্বাচন গোটা পৃথিবীকে কয়েকটি বার্তা দিয়েছে :

১. বাংলাদেশের মানুষ আওয়ামী লীগ এবং শেখ হাসিনার জন্য নিবেদিত;

২. এই নতুন সরকার বন্ধুহীন নয়, সময়ের পরীক্ষায়, সাফল্যের পরীক্ষায়,  যোগ্যতার পরীক্ষায়, সাহসিকতার পরীক্ষায় শেখ হাসিনা এবং তাঁর সরকার ও দল উত্তীর্ণ এবং প্রবলভাবে সফল;

৩. দেশের ১৭ কোটি মানুষের মৌলিক চাহিদার প্রতিটি ক্ষেত্র নিপুণভাবে পরিচালনা করার দক্ষতা শেখ হাসিনারই আছে আর কোনো রাজনীতিক বা দলের নেই;

৪. শেখ হাসিনাই একমাত্র রাজনীতিক হিসেবে বিশ্ব পরিমন্ডলে ভারত-চীন-রাশিয়া-মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপ-আমেরিকার একাংশকে একসূত্রে গাঁথতে পেরেছেন, আস্থা অর্জন করতে পেরেছেন আফ্রিকা ল্যাটিন-আমেরিকার মানুষেরও। নেলসন ম্যান্ডেলার পর শেখ হাসিনাই সেই রাজনীতিক, যিনি  বৈরিতার পথ পরিহার করে বন্ধুতার হাত প্রসারিত করেছেন।

এবার একটু পুরনো কথা বলি পাকিস্তান আমলের কথা।

১৯৪৮ সালেই মোটামুটি একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, পাকিস্তান নামের অদ্ভুত আকৃতির রাষ্ট্রটি চলবে না। আর এই বোধের ধারক কতিপয় সাহসী যুবক নেমে পড়েছিলেন লড়াইয়ের ময়দানে। পাকিস্তানের শাসকচক্র চিহ্নিত করেছিল এক আপসহীন যুবককে তাদের সবচেয়ে বিপজ্জনক প্রতিপক্ষ হিসেবে। সেই ছিল শুরু। শুরু মহাবিদ্রোহের ইতিহাসের, শুরু এক মহান বীরের পথযাত্রার। পাকিস্তান তখন সামরিক জান্তার লৌহকপাটের অন্তরালে। তার ভিতর থেকেই জলদগম্ভীর কণ্ঠের উদাত্ত আহ্বান জয় বাংলা।

এই জয় বাংলা স্লোগানের বিরুদ্ধে, বাংলার শ্রেষ্ঠ সংগ্রামী পুরুষের বিরুদ্ধে কত চক্রান্ত, কত ষড়যন্ত্র, কত হিংস্র কার্যক্রম! কারাগার যেন তাঁর স্থায়ী আবাস আর বারংবার চকচকে ফাঁসির রজ্জু যেন প্রতি মুহূর্তে তাঁকে হাতছানি দিতে থাকত। এসব ইতিহাস অবশ্য বাংলার মানুষ জানে, পৃথিবীর মানুষও জানে। কাজেই আমি তার পুনরাবৃত্তি করব না। আমি শুধু বলি, এই মানুষটি সংগ্রামের প্রতিটি ধাপে পা রেখে রেখে সিঁড়ি বেয়ে উঠেছেন। সঙ্গী করেছেন ত্যাগী, আদর্শবান, ন্যায়-নীতিনিষ্ঠ, সুশিক্ষিত কর্মীদের যারা লড়াই চিনে ছিল কিন্তু মৃত্যুর ভ্রুকুটিকে পরোয়া করেনি। তাই আজ আমরা স্বাধীনতার কথা এক বুক সাহস নিয়ে বলতে পারি- আমরা মুক্তিযুদ্ধে জীবন বাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়তে পেরেছি।

জাতির জনক হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি তাঁর এবং তাঁর নিকট-পরিজন ও একাত্তরের বন্ধুদের রক্তের বিনিময়ে আমরা এই বাংলাদেশ পেয়েছিলাম; কিন্তু ষড়যন্ত্রের কালো থাবা থেকে তো নিষ্কৃতি পাইনি। নানাভাবে নানা রূপে চক্রান্তকারীদের ছায়া ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে। আমরা পাশ্চাত্য অপশক্তির বিষাক্ত চেহারা প্রতিনিয়তই দেখতে পাই, তাদের কৌশলী কণ্ঠস্বর সেই একাত্তর সালের মতো এখনো ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওরা এখনো একাত্তরের বিজয়কে বাঙালির বিজয়, মুক্তিযুদ্ধের বিজয় বলতে চায় না। ওদের পরম মিত্র ’৭১-এর পরাজিত শক্তিরা যারা এই নির্বাচনের অর্জনকে অস্বীকার করে, অগ্নিসন্ত্রাসকে বৈধতা দেয়।

বঙ্গবন্ধুর আদর্শের বাংলাদেশ মাথা তুলে দাঁড়াক, ওরা চায় না বলেই একটার পর একটা ষড়যন্ত্র করেই চলেছে। তাদের চিন্তাভাবনা কিংবা বিশ্বাসের কোনো তারতম্য হয়েছে বলে মনে হয় না। এখনো তাদের পররাষ্ট্র মুখপাত্রের একই কথা জন কিরবি খুব কৌশলী মন্তব্যের ফাঁকে একটি কথা বুঝিয়েই দিয়েছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছার কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। আর চার মার্কিন সিনেটর ডিক ডারবিন, জেফ মার্কলি, টিম কেইন আর পিটার ওয়েলচ-এর মুখে সেই একই বুলি- ভয়ভীতি আর সহিংসতায় নির্বাচন প্রক্রিয়া ক্ষুণœ।

মার্কিনিদের আর বুঝিয়েও লাভ নেই আর তারা না বুঝলেও কিছু যায়-আসে না। ওরা চেষ্টা করছে এবং করেও যাবে। দেশটা আমাদের, এর দায়দায়িত্বও আমাদের। কারও কোনো ষড়যন্ত্রে ঘাড় পেতে দেওয়ার কোনো কারণই নেই। আমাদের বাঁচতে হবে আমাদেরই শর্তে, আমাদেরই স্বার্থে।

এখন কথাটা পরিষ্কার। দেশের নতুন সরকার শপথ নিয়েছে, অনেক নতুন মুখের পাশাপাশি অভিজ্ঞ মুখও এসেছে। তাঁদের শপথ সম্পন্ন হয়েছে, মিডিয়ায় প্রায় সবাই অনেক অঙ্গীকারও করেছেন। এখন আমাদের কাজ হলো, তাঁদের যার যার মন্ত্রণালয় বুঝে নেওয়ার জন্য ১০০ দিনের মতো সময় দেওয়া। এই সময়ের মধ্যে তাঁরা কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করবেন, নিজের কর্মপরিধি সম্পর্কে সম্যকভাবে অবহিত হবেন, নেতা এবং কর্মীর মধ্যে বিশ্বাস এবং পারস্পরিক বন্ধন তৈরি করবেন, নিজের দুর্বলতাকে আড়াল না করে সেটা সংশোধন করার চেষ্টা করবেন।

একজন প্রবীণ সাংবাদিক হিসেবে, এ দেশের মুক্তিযুদ্ধের একজন নিবেদিতপ্রাণ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে, মানবিক মূল্যবোধের ওপর আস্থাশীল ব্যক্তি হিসেবে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতি একলব্যের সাধনা নিয়ে নিবেদিত মানুষ হিসেবে, শুধু একটি কথা বলে রাখি- রাষ্ট্র নির্মাণে শেখ হাসিনার প্রদর্শিত পথই বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার পথ। কোনো ক্ষুদ্রতায়, কোনো সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে, কোনো ব্যক্তিস্বার্থের কারণে যেন কোনো বিচ্যুতি না ঘটে, এটাই আমার সর্বান্তকরণ কামনা।

শ্রদ্ধেয় এম আর আক্তার মুকুল ভাইয়ের অমর গ্রন্থের নাম ছিল ‘আমি বিজয় দেখেছি’। আজ আমিও পরম শ্লাঘার সঙ্গে বলি, আমিও বিজয় দেখেছি- মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নতুন সারথি শেখ হাসিনার জয়রথের অভিযাত্রার উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বর্ণশিখরে স্পর্শ করার বিজয়ে। 

 

লেখক : প্রকাশক ও সম্পাদক, দৈনিক জাগরণ

সর্বশেষ খবর