সোমবার, ১৫ জানুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

স্বতন্ত্র পরিচালককে ব্যাংকের চেয়ারম্যান করতে হবে

স্বতন্ত্র পরিচালককে ব্যাংকের চেয়ারম্যান করতে হবে

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ও উন্নয়ন সমন্বয়ের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অর্থনীতিবিদ ড. আতিউর রহমান বলেছেন, দেশের আর্থিক খাতে ঐতিহ্যগতভাবে ঋণখেলাপি সমস্যা সমাধান ও শৃঙ্খলা ফেরাতে পেশাদার স্বতন্ত্র পরিচালকদের মধ্য থেকে চেয়ারম্যান নিয়োগ করতে হবে। গরিব ও কম আয়-রোজগেরে প্রান্তিক মানুষের জীবন চলা সহজ করার জন্য কম দামে খাদ্য সরবরাহসহ সামাজিক সুরক্ষার চৌহদ্দি আরও প্রসারিত করতে হবে। ডলার সংকট সমাধানে বিনিময় হার আরও নমনীয় করে বাজারের চাহিদা ও সরবরাহের পরিপ্রেক্ষিতে যেমনটি হওয়া দরকার তা করা গেলে প্রবাসী আয় ও রপ্তানি আয় আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে বেশি বেশি আসবে। ব্যবসায়ীদের কর, এলসি, ঋণ, বিদ্যুৎসহ প্রয়োজনীয় সমস্যাগুলো কী করে দ্রুত সমাধান করা যায় সে চেষ্টা করতে হবে। বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন - শাহেদ আলী ইরশাদ

 

বাংলাদেশ প্রতিদিন : নতুন বছর, নতুন সরকার গঠিত হয়েছে। সরকারের সামনে চ্যালেঞ্জগুলো কী কী?

ড. আতিউর রহমান : নতুন বছরে যে নতুন সরকার গঠিত হয়েছে তার সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দেবে মূল্যস্ফীতিসহ সামষ্টিক অর্থনীতিকে কত দ্রুত স্থিতিশীল করা যায়। সেজন্য মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতির মধ্যে আরও সুদৃঢ় সমন্বয় নিশ্চিত করার নীতি অগ্রাধিকার অব্যাহত রাখতে হবে। পাশাপাশি মূল্যস্ফীতির শিকার গরিব ও কম আয়-রোজগেরে প্রান্তিক মানুষগুলোর জীবন চলা সহজ করার জন্য কম দামে খাদ্য সরবরাহসহ সামাজিক সুরক্ষার চৌহদ্দি আরও প্রসারিত করতে হবে। সরবরাহ চেইনকে অক্ষুণœ রাখাও আরেকটি চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে লোহিত সাগরে জাহাজ চলাচলে যে সংকট তৈরি হচ্ছে তাতে আমাদের পণ্য রপ্তানির ব্যয় বেড়ে যেতে পারে। এমনিতে ২০২৩ সালে রপ্তানি খাত বেশ চাপের মধ্যে ছিল। নতুন এই সংকটের কারণে যদি সরবরাহ চেইনে বাড়তি টানাপোড়েন তৈরি হয়, তাহলে প্রতিযোগিতা মূল্যে আমাদের বস্ত্র রপ্তানির ধারা গতিময় রাখাটা চ্যালেঞ্জিং হতে পারে। সেজন্য রপ্তানি পণ্যের গন্তব্য এবং পণ্যের রকমফেরে বৈচিত্র্য আনাটা জরুরি হয়ে পড়বে। এ ছাড়া বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারের তারতম্যের কারণে রপ্তানি আয় ফেরত আনা এবং আনুষ্ঠানিক উপায়ে প্রবাসী আয় বাড়ানোর চ্যালেঞ্জও বাংলাদেশকে মোকাবিলা করতে হবে। অর্থনীতির বাইরে সামাজিক ও রাজনৈতিক সুস্থিতি ফিরিয়ে আনার চ্যালেঞ্জ তো আছেই। আর জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য বাড়তি অর্থায়ন এবং সবুজ প্রবৃদ্ধির ধারাকে বেগবান করার সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জের কথাও নতুন সরকারকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মোকাবিলা করতে হবে।

 

বাংলাদেশ প্রতিদিন : আর্থিক খাত এ-মুহূর্তে আলোচিত বিষয়। এ আর্থিক খাতকে স্বাভাবিক করতে কী কী উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে?

ড. আতিউর রহমান : আর্থিক খাতের বড় চ্যালেঞ্জ এখন ডলার সংকট। বিনিময় হার আরও নমনীয় করে বাজারের চাহিদা ও সরবরাহের পরিপ্রেক্ষিতে যেমনটি হওয়া দরকার তা করা গেলে প্রবাসী আয় ও রপ্তানি আয় আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে বেশি বেশি আসবে। তখন ডলার সংকট মেটানো সহজ হবে। তবে ছোটখাটো উদ্যোক্তাদের এলসি খোলার জন্য বিশেষ বিদেশি মুদ্রার তহবিল খুলতে দেশে থাকা বিদেশি ব্যাংককে মধ্য মেয়াদি বিদেশি ঋণ সরবরাহে উৎসাহী করতে পারে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর ঐতিহ্যগতভাবে ঋণখেলাপি সমস্যা তো আছেই। সেজন্য ব্যাংকগুলোতে আরও বেশি করে পেশাদারি স্বতন্ত্র পরিচালক (তাদের মধ্য থেকে চেয়ারম্যান নিয়োগ করাসহ) নিয়োগের উদ্যোগ নিতে পারে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেজন্য তাদের ফিট অ্যান্ড প্রোপার টেস্টের সূচকগুলো স্পষ্টতর করতে পারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। একই সঙ্গে ঋণের ব্যবহার ঠিকঠাক হচ্ছে কি না তার সুপারভিশনের তীব্রতা ও মান বাড়ানো জরুরি হয়ে পড়েছে। নতুন ব্যাংক কোম্পানি আইনে ইচ্ছাকৃত খেলাপির সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। এর আলোকে নিয়মনীতি চালু করে এদের বিরুদ্ধে শক্ত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

 

বাংলাদেশ প্রতিদিন : চলতি বছরই বড় বড় বিদেশি ঋণ পরিশোধ শুরু হওয়ার কথা। বড় হারে ঋণ পরিশোধের এই সংকট মোকাবিলার উপায় কী?

ড. আতিউর রহমান : বৈদেশিক ঋণ শোধ করার চাপ বাড়লেও বাংলাদেশের এক্ষেত্রে রেকর্ড বেশ ভালো। আমরা কখনই ঋণ শোধ করতে ডিফল্ট করিনি। নতুন বছরেও তিন-চার বিলিয়ন ডলারের বেশি বৈদেশিক ঋণ শোধ করতে হবে না। যদি আমরা প্রবাসী আয় এবং রপ্তানি আয় বৃদ্ধির উদ্যোগগুলো সাফল্যের সঙ্গে নিতে পারি তাহলে এ পরিমাণ ঋণ শোধ করা মোটেও চ্যালেঞ্জিং হবে না। এখনো আমাদের সরকারি বিদেশি ঋণের পরিমাণ জিডিপির ২০-২২ শতাংশের বেশি নয়। এ অনুপাত পড়শিদের চেয়ে ঢের কম।

 

বাংলাদেশ প্রতিদিন : দেশের আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে করণীয় কী?

ড. আতিউর রহমান : দেশের আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে বাংলাদেশ ব্যাংককেই নেতৃত্ব দিতে হবে। সেই সক্ষমতাও তার আছে। দরকার শুধু কেন্দ্রীয় ব্যাংককে প্রয়োজনীয় সাহস, স্বাধীনতা এবং জনবলের কারিগরি দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য উপযুক্ত রাজনৈতিক অঙ্গীকার। তাছাড়া দুদক, বিএফআইইউ এবং বিচার বিভাগের মাঝে আরও সমন্বয় এবং তাদেরও জনশক্তির সক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নিলে দ্রুতই এ খাতে শৃঙ্খলার সুবাতাস বইবে।

 

বাংলাদেশ প্রতিদিন : প্রথম এক বছরে সরকারের কোন কোন খাতে নজর দেওয়া উচিত।

ড. আতিউর রহমান : প্রথম এক বছরের অগ্রাধিকারে থাকতে হবে মূল্যস্ফীতি ৫-৬ শতাংশে নামিয়ে আনা, বিনিময় হার বাজারনির্ভরতার কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া, আর্থিক হিসাবের ঘাটতি দূর করা, রিজার্ভ বৃদ্ধির ধারা জোরদার করা, প্রবৃদ্ধির ধারা গতিময় করার জন্য কর্মসংস্থান বৃদ্ধির জন্য বিনিয়োগ পরিবেশ ব্যবসায়ীবান্ধব করা এবং রাজস্ব সমাবেশ বাড়ানোর জন্য এনবিআরের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও ডিজিটাল প্রযুক্তিজ্ঞান সমৃদ্ধ প্রশিক্ষিত জনশক্তির সমাহারে মনোনিবেশ করা।

 

বাংলাদেশ প্রতিদিন : ডলার সংকট এ-মুহূর্তে একটি বড় বিষয়। এ ডলার সংকট কাটিয়ে ওঠা যায় কীভাবে?

ড. আতিউর রহমান : ডলার সংকট মোকাবিলা সম্ভব হবে বিনিময় হার স্থিতিশীল করে একে ঘিরে স্পেকুলেশনের সুযোগ কমিয়ে ফেলা। আমাদের প্রবাসী বন্ড, বিনিয়োগ বন্ড, ট্রেজারি বন্ড ডিজিটালি বিক্রি এবং এগুলোর রিটার্ন আরও আকর্ষণীয় করা গেলে। এ সম্পর্কিত নিয়মনীতি সহজ করাও জরুরি।

 

বাংলাদেশ প্রতিদিন : ব্যবসায়ীরা এ সংকট কীভাবে কাটাতে পারেন?

ড. আতিউর রহমান : ভালো ব্যবসায়ীদের উৎকণ্ঠা ও উদ্বেগ দূর করাই হতে হবে নীতিনির্ধারকদের প্রধান অগ্রাধিকার। সেজন্য তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা অব্যাহত রেখে তাদের কর, এলসি, ঋণ, বিদ্যুৎসহ প্রয়োজনীয় সমস্যাগুলো কী করে দ্রুত সমাধান করা যায় সে চেষ্টা করতে হবে। এর ফলে তাদের ব্যবসায় আস্থা বাড়বে। তারাও বেশি করে কর দেবেন। সামাজিক দায়বদ্ধ এবং সবুজ ব্যবসা-বাণিজ্যে তাদের উৎসাহী করাও রেগুলেটর ও সরকারের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। আশা করি, নতুন সরকার সত্যিকার ব্যবসায়ীদের মনের খোঁজ করবে এবং তাদের সঙ্গে সৌহার্দ্যরে পরিবেশ উন্নত করে বিনোয়োগ বাড়িয়ে প্রবৃদ্ধির ধারাকে আরও অংশগ্রহণমূলক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করার কৌশলগত উদ্যোগ নেবে।

সর্বশেষ খবর