মঙ্গলবার, ১৬ জানুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণ

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণ

১১ জানুয়ারি কালিয়াপাড়া ঘোনারচালায় নির্বাচন-পরবর্তী সভা আহ্বান করা হয়েছিল। আমি টাঙ্গাইলেই ছিলাম। বঙ্গভবনে মন্ত্রিসভার শপথ, বারবার নানা জায়গা থেকে অনুরোধ আসছিল। শপথ অনুষ্ঠানে উপস্থিত হওয়ার একপর্যায়ে স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। আমার সাদামাটা স্ত্রী সহজভাবেই বলেছিল, ‘এরকম এক অবস্থায় না গেলেও পারো; কিন্তু গেলে ভালো হয়।’ তাই গিয়েছিলাম। ১১ জানুয়ারি ’৭২ আমার জীবনে এক ঐতিহাসিক দিন। স্বাধীনতার পর প্রথম পিতার সঙ্গে দেখা। ধানমন্ডির ১৯ নম্বর সড়কে ঠিক সকাল ৭টায় পিতাকে আলিঙ্গন করেছিলাম। আর মন্ত্রিসভার শপথ ছিল কাঁটায় কাঁটায় সন্ধ্যা ৭টায়। ধীরে ধীরে সবকিছু কেমন যেন বদলে যাচ্ছে। ক্যাবিনেট সচিব সবাইকে সম্বোধন করলেন। কিন্তু নানা দলের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের উপস্থিতি তিনি মুখে আনেননি। একেবারে সামনের আসনে বসেছিলাম। ডানে জি এম কাদের, এক আসন বাদে বামে প্রবীণ নেতা আমির হোসেন আমু। খুব অল্প সময়ের অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠান শেষে আপ্যায়নের ব্যবস্থা। আমি আপ্যায়নে শরিক হইনি। চলে এসেছিলাম। বঙ্গভবনে গাড়ি বের করতে খুবই জটিলতা। তাই অনেক কষ্টে পায়ে হেঁটে বেরিয়ে ট্যাক্সি করে চলে এসেছিলাম। এসেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে অভিনন্দন বার্তা পাঠিয়েছি।

“মাননীয় প্রধানমন্ত্রী,

বহু চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ’৯৬ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে প্রথম এবং দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর টানা চারবার, সব মিলে মোট পাঁচবার গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ায় আমাদের দল কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, আমার পরিবার এবং আমি আপনাকে আন্তরিক অভিনন্দন ও শুভ কামনা জানাচ্ছি। আপনার সুমহান নেতৃত্বে জাতি গঠনে সফলকাম হন- এমনটাই আমাদের প্রত্যাশা।”

এবার আমার নির্বাচন নিয়ে লেখা হলো না। পরের পর্বে লিখব। আমার নির্বাচনের সঙ্গে প্রথম পরিচয় বা নির্বাচন দেখা ’৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর নির্বাচন দিয়ে। তখন কালিহাতী-বাসাইলে ফ্রন্টের প্রার্থী ছিলেন আমীর আলী খান মোক্তার। তার জুনিয়র হিসেবে আমার বাবা মৌলভী মুহাম্মদ আব্দুল আলী সিদ্দিকী কাজ করতেন। সেই সুবাদে বাপ-চাচা-বড় ভাই সবাই ফ্রন্টের সমর্থক। বাড়িসুদ্ধ সবাই আমরা একদল একমত। আমার বয়স তখন সাড়ে সাত-আট বছরের মতো। নির্বাচনি হৈ-হল্লাও শুনতাম, বুঝতাম না কিছুই। ঝাঁকে ঝাঁকে লোকজন নির্বাচনি প্রচারে বের হতেন। ধ্বনি দিতে দিতে বাড়ির সামনে দিয়ে যেতেন চেয়ে চেয়ে দেখতাম। এরপর এলো ’৭০-এর নির্বাচন। মাঝে নানা ধরনের নির্বাচন হয়েছে। আইয়ুব খানের বুনিয়াদি গণতন্ত্র সে আজব চিজ। বাঙালিরা ভোট দিতে জানে না, বাঙালিরা কেন পুরো পাকিস্তানিরাই ভোট দিতে জানে না, তাই বেসিক ডেমোক্রেসি প্রবর্তন করেছিলেন আইয়ুব খান। ৪০ হাজার পূর্ব পাকিস্তান, ৪০ হাজার পশ্চিম পাকিস্তানে, এরা হলো ইলেক্টোরাল কলেজ। এই ইলেক্টোরাল কলেজের সদস্য বিডি মেম্বারদের ভোট দেয় সাধারণ ভোটার আর বিডি মেম্বাররা ভোট দিতেন অন্যসব স্তরে এমপি থেকে প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত। সে এক আজব ব্যাপার। অনেক সংগ্রাম আন্দোলনের পর ’৭০-এ সাধারণ নির্বাচন। বঙ্গবন্ধু এককভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। হুজুর মওলানা ভাসানীর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিও করেছিল। তারা ‘ভোটের বাক্সে লাথি মারো, পূর্ব বাংলা স্বাধীন করো’ স্লোগান দিয়ে মাঝপথে নির্বাচন থেকে সরে গিয়েছিলেন। কিন্তু হুজুর মওলানা ভাসানীর দল নির্বাচনবিরোধী কোনো তৎপরতা চালাননি। ফলাফলে দেখা গেল- সব ভোট পেয়েছে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ বা নৌকা। হুজুর ভাসানী সরে যাওয়ায় ভোট ভাগাভাগি হয়নি। তিনি থাকলে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি এবং অন্যান্য দল যদি ২০-২৫টা সিটও পেত তাহলে আজকের বাংলাদেশ হতো না। ১৬৯টির মধ্যে ১৬৭টি আসন পেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। পশ্চিম পাকিস্তানে পাকিস্তান পিপলস পার্টি ৮১ সিট পেয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে চিহ্নিত হয়। ’৭০-এর নির্বাচনে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য হিসেবে কালিহাতী থেকে লতিফ সিদ্দিকী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। বিরোধী সব প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছিল। সেবার আমি প্রথম ভোট দিয়েছিলাম। নির্বাচনের তিন বা চার দিন আগে বড় ভাইয়ের বন্ধু আজিজুল হক জজের পুরনো গাড়ি নিয়ে তার ছোট ভাই সাইফুল ইসলাম লাড্ডুকে নিয়ে ৩২ নম্বর ধানমন্ডিতে এসেছিলাম। তখন রাত ১১-১২টা হবে। বাড়িতে পৌঁছতেই লোকজন খবর দেন, খবর পেয়ে বঙ্গবন্ধু সঙ্গে সঙ্গে নিচতলায় নেমে আসেন। বড় ভাইকে আলাদা ঘরে নিয়ে ৩ হাজার টাকা দেন। চলে আসার পথে আমাকে ডেকে আমার হাতে ৫০০ টাকা দিয়েছিলেন। তখনকার ৫০০ এখনকার ৫০ হাজারেরও বেশি। ওরকম ’৬৯-এর গণ-আন্দোলনের মাঝামাঝি কোনো সময় ৫০০ টাকা দিয়েছিলেন তখনকার আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জননেতা আবদুল মান্নান। এরপর মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে দেশের স্বাধীনতা আসে। বঙ্গবন্ধু পাঁচ-ছয়বার মন্ত্রী বানাতে চান। কিন্তু ক্ষণস্থায়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে উঠে আসা আমি কখনো রাজি হইনি। সব সময় মনে হয়েছে মন্ত্রী হওয়ার যোগ্যতা তখনো আমি অর্জন করিনি। এরপর আসে ’৭৩-এর নির্বাচন। আমি খুব একটা সক্রিয় ছিলাম না। বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকীর প্রিয় শিষ্য জনাব শাজাহান সিরাজ জাসদ গঠন করে তারা দুর্বার বিরোধী রাজনীতি শুরু করেন। রাজনীতি করলে কোনো দোষ ছিল না। শুধু রাজনীতি নয়, ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ করছিলেন।

যাই হোক নির্বাচনে প্রচ- প্রতিযোগিতা হয়। ঘোষিত ফলাফলে লতিফ ভাই সব সময় এগিয়ে ছিলেন। তাই স্বস্তিতে ছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভোটের ব্যবধান ছিল খুবই কম। আমরা বেশি দিন স্বস্তিতে থাকতে পারিনি। স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় স্বাধীনতাবিরোধী ঘাতকের হাতে বঙ্গবন্ধু নির্মমভাবে নিহত হন। সবকিছু কেমন ওলটপালট হয়ে যায়। মন্ত্রিসভার একজনও ঘুরে দাঁড়ায়নি। একমাত্র প্রধানমন্ত্রী মনসুর আলী ছাড়া আর কারও কাছে কোনো প্রতিবাদী মনোভাব পাওয়া যায়নি। ’৭৫-এ আমাকে গভর্নর করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু অনেক আশা নিয়ে দেশে জেলা গভর্নর পদ্ধতি চালু করেছিলেন। প্রতিটি জেলাকে স্বতন্ত্রসত্তায় প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। মানুষ যাতে সেবা পায়, মানুষ যাতে স্বস্তি পায়, নির্যাতনের হাত থেকে মুক্তি পায়। রাষ্ট্র পরিচালনায় সর্বক্ষেত্রেই যাতে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ এবং প্রাধান্য থাকে সেটাই ছিল মূল উদ্দেশ্য। পোড়খাওয়া দেশপ্রেমিক একজন রাজনৈতিক নেতার যে চিন্তা-চেতনা ও আদর্শ থাকে বঙ্গবন্ধু তার চেয়েও কয়েক ধাপ এগিয়ে ছিলেন। চীনের মাও সে তুং, ভারতের মহাত্মা গান্ধী, নেতাজি সুভাষ বোস, আব্রাহাম লিংকন- এদের থেকে কোনো অংশেই এই ছোট্ট একটি দেশের নেতার নেতৃত্ব, কর্তৃত্ব ও দেশপ্রেম কম ছিল না। এটা খুবই সত্য, তখন বাংলাদেশের চেয়ে বাংলাদেশের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের পরিচিতি এবং সম্মান অনেক বেশি ছিল। এরপর অনেক নির্বাচন গেছে। কোনোটা পাতানো, কোনোটা সাজানো, কোনোটা একেবারেই নির্বাচন নয়। ১৫৩ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছে। তারও আগে ’৯৬-এর ১৫ ফেব্রুয়ারি শুধু বিএনপি নির্বাচন করে। সে সময়ও ৭০-৮০ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছিল। তারা আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ১২ জুনের নির্বাচনে সেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ৭০-৮০ জনের মধ্যে ৫-৬ জন মাত্র জিতেছিলেন। বিস্ময়ের ব্যাপার, যেভাবে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বিএনপির পতন হয়েছিল তাতে সাধারণ নির্বাচনে তাদের ১০-২০টির বেশি আসন পাওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু তারা ১১৬টি আসন পেয়েছিল। বাংলাদেশের পার্লামেন্টে সেটাই ছিল সব থেকে শক্তিশালী বিরোধী দল। তারপর আবার বিএনপি আসে। আওয়ামী লীগের সিট সংখ্যা ৫০-এর নিচে নেমে যায়। পরের বার আসে আওয়ামী লীগ। বিএনপির সিট সংখ্যা একেবারে তলানিতে ঠেকে। ২০১৪ সালে বিএনপি ভোট বয়কট করে। তারপর একইভাবে চলছিল। কিন্তু ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচন আরও খারাপ হয়। সে থেকে সংসদের বাইরে প্রধান বিরোধী দল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বাইরে নির্বাচনে যাবে না। বিশেষ করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বোন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে কোনো সরকারের অধীনে তারা নির্বাচন করবে না। এজন্য আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকে। তারা প্রধান বিরোধী দল হওয়ার কারণে তাদের অনেক ভুল পদক্ষেপে বিরোধী আন্দোলন কখনো দানা বাঁধেনি। আদর্শগত বিভেদও রয়েছে বিস্তর। স্বাধীনতাবিরোধীদের বেশি প্রাধান্য প্রধান বিরোধী দল বিএনপিতে। অতি সম্প্রতি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি এবং তাদের সঙ্গী-সাথি অনেক দল অংশগ্রহণ করেনি।

যে যাই বলুন এতে নির্বাচনি আমেজ কিছুটা কম হয়েছে। বিশেষ করে ভোটারের অনুপস্থিতি ছিল দেখার মতো। আমরা কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ ২০১৮ সালের পরে কোনো নির্বাচনেই অংশ নিইনি। সেটা প্রধান বিরোধী দল বিএনপির সঙ্গে মিলেঝিলে নয়। এমনিতেই বিবেকের তাড়নায় নির্বাচন থেকে দূরে ছিলাম। ২০২৩ সালের মে মাসে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আমাদের একটা বৈঠক হয়। সেখানে পুরো নির্বাচন কমিশন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন আমরা নির্বাচনে অংশ নিলে নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু হবে। নির্বাচন কমিশনের সেই আশ্বাসে বিশ্বাস করে আমরা দলীয়ভাবে বাসাইল পৌর নির্বাচনে রাহাত হাসান টিপুকে নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলাম। নির্বাচনটি বেশ উৎসবমুখর প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হয়েছিল। আমাদের গামছা প্রতীকের প্রার্থী রাহাত হাসান টিপু জয়যুক্ত হয়েছিল। এরপর সখীপুরের কয়েকটি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন হয়। সেখানেও আমরা কয়েকটিতে অংশগ্রহণ করি। আমাদের প্রার্থী জয়ী না হলেও সরকারি প্রার্থী একজনও বিজয়ী হয়নি। উপরন্তু বিপুল ভোটারের উপস্থিতিতে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয়ী হয়। মানুষ নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারায় খুব খুশি হয়। এর আগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বোন হাসিনা আমাকে বলেছিলেন, তিনি ভোটে কোনো কারচুপি চান না। স্বচ্ছ, প্রভাবমুক্ত নির্বাচন চান। আমি তাঁর সে আশ্বাসে বিশ্বাস করেছিলাম। কিন্তু ইচ্ছা না থাকলেও বলতে পারছি না যে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সর্বক্ষেত্রে অবাধ, নিরপেক্ষ ও প্রভাবমুক্ত হয়েছে। নির্বাচনের আগে আগে মানিকগঞ্জ ও বরিশালের উজিরপুর গিয়েছিলাম। উজিরপুরে আমাদের গামছার প্রার্থী নকুল কুমার বিশ্বাস খুবই জনপ্রিয় প্রার্থী ছিল। এক দিন সারা দিন উজিরপুর ছিলাম। সন্ধ্যা নদীর পাড়ে কুচিয়ারপাড় গ্রামে একেবারে হতদরিদ্র হিন্দু পরিবারের খাবার খেয়েছিলাম। দাসবাড়ির উঠানে ১০-১৫টি বাড়ি থেকে খাবার এনে খেয়েছিলাম। যা ছিল খুবই সুস্বাদু। সেখানে অর্পিতা নামের খুবই সুন্দর, খুবই হতদরিদ্র মেয়েটিকে আমার বেশ ভালো লেগেছিল। আমি নাম দিয়ে এসেছি দেবতা শিবের সঙ্গী দেবী পার্বতী। তারপর আরেকটু উত্তর-পশ্চিমে নকুলের আত্মীয় অবিনাশ বিশ্বাসের বাড়িতে। সেখানে জোহরের নামাজ আদায় করেছিলাম। নামাজ শেষে বারবার মনে হচ্ছিল বহু বছর আগে সম্রাট আওরঙ্গজেব কাশিতে এক হিন্দুবাড়িতে নামাজ আদায় করেছিলেন। ডাবেরকুল বাজারে অনেকক্ষণ ছিলাম। অনেক আওয়ামী লীগ নেতাও নানা ধরনের কথাবার্তা বলেছিল। সেখানে নৌকার প্রার্থী তালুকদার মো. ইউনুসকে প্রত্যাহার করে ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা রাশেদ খান মেননকে দেওয়া হয়েছিল। যার ভোট পাওয়ারই কথা না। শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের নাতি ফাইয়াজুল হক রাজু আর গামছার প্রার্থী নকুল দুজনের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হওয়ার কথা। কারণ রাশেদ খান মেনন গত ২০ বছরে কয়েক ঘণ্টার জন্যও উজিরপুর-বানারীপাড়া যাননি। তিনি ২ লাখের মতো ভোট পেয়েছেন। অথচ সারা দেশে ভোট কাস্ট হয়েছে ২৫-৩০ শতাংশ। যাতে সব মিলিয়ে ১ লাখের বেশি কাস্টিং ভোটের কথা নয়।

এবার আসি নিজের জেলা টাঙ্গাইল নিয়ে। টাঙ্গাইল-১ এ ড. আবদুর রাজ্জাকের বিরুদ্ধে কোনো জুতসই প্রার্থী ছিল না। তবে তার নামে যত ভোট দেখিয়েছেন অত ভোট কাস্ট কোনোমতেই সম্ভব নয়। টাঙ্গাইল-২ এ যা হওয়ার তাই হয়েছে। ভোটের কারচুপি কীভাবে কীভাবে করতে হয়, ভোট ডাকাতি কেমন করে হয়, জোর-জুলুম অন্যায় কাকে বলে পুরো ব্যাপারটি সাজিয়ে গুছিয়ে একটি ছোটখাটো বই বের করলে তা নির্বাচনি কারচুপির শ্রেষ্ঠ বই হিসেবে স্থান পাবে। টাঙ্গাইল-৩ এ স্বতন্ত্র প্রার্থী বিজয়ী হয়েছে। নৌকার প্রার্থী একেবারে অপরিচিত। কোনোখানে কোনো কাজে তার তেমন কোনো ভূমিকা নেই। তাই তার হারার কথা ছিল, হেরেছে। টাঙ্গাইল-৪ এ এমপি ছিল সোহেল হাজারী। তাকে মনোনয়ন না দেওয়ায় এলাকার লোকজন মানত করেছে, গ্রামে গ্রামে খিচুড়ি খেয়ে খুশি জাহির করেছে। মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল মাজহারুল ইসলাম ঠান্ডুকে। একজন ইউনিয়ন লেভেলের নেতাও তিনি নন। লতিফ ভাইয়ের দয়া দাক্ষিণ্যে সে এত বছর রাজনীতির নামে নানা অপকর্ম করেছে। শুরু থেকে হাজার হাজার মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে নেমে এসেছিল লতিফ ভাইয়ের পক্ষে। সব নেতা-কর্মী আন্তরিকভাবে কাজ করেছে। নির্বাচনের ৩-৪ দিন আগে বল্লা স্কুলমাঠে ট্রাক মার্কার জনসভায় গিয়েছিলাম। মুক্তিযুদ্ধে বল্লা এক উল্লেখযোগ্য স্থান। সেখানে আমরা প্রথম বিজয় অর্জন করেছিলাম। তাই বল্লার প্রতি আমার একটা আলাদা আকর্ষণ রয়েছে। সেই বল্লায় ৩১ ডিসেম্বর জনসভা ছিল সর্বকালের বৃহৎ জনসভা। যেখানে মাজহারুল ইসলাম ঠান্ডুর ২০-২৫ হাজারের বেশি ভোট পাবার কথা না, সেখানে সে ভোট পেয়েছে ৫৪ হাজার। কেন পাবে না? তার ইউনিয়নে মোট ভোটার ৩১ হাজার। সেখানে সে একাই পেয়েছে ২৮ হাজার। স্বতন্ত্র প্রার্থী ট্রাক মার্কা কয়েক শ। টাঙ্গাইল-৪ এর পুরো ফলাফল এসে যাওয়ার পরও প্রায় আড়াই-তিন ঘণ্টা আটকে রাখা হয়েছিল। ১০-১৫ হাজার বীর জনতা ইউএনও অফিস ঘেরাও করলে অবস্থা বেগতিক দেখে ফলাফল ঘোষণা করতে বাধ্য হয়। প্রশাসন যে কী পরিমাণ নৌকার পক্ষে ছিল সেটা দেখা যায় নির্বাচনের এক দিন পর। ট্রাক মার্কার কয়েকজন সমর্থককে অহেতুক গ্রেফতার করে থানায় আনা হয়। হাজার হাজার ট্রাকের সমর্থক থানা ঘেরাও করে। খবর পেয়ে বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী ঢাকা থেকে সকালের নাশতা মুখে না দিয়েই কালিহাতী ছুটে যান। আমি খবর পেয়ে আড়াইটার দিকে কালিহাতী থানার সামনে পৌঁছি। সবাইকে ছেড়ে না দিলে লতিফ ভাই উঠবেন না। আমাকে থানার ভিতরে যেতেও বারণ করেন। অনেক বলে-কয়ে থানার ভিতরে যাই। গিয়ে দেখি এক এএসপি রাসেল ও আরেক এসপি প্রমোশনপ্রাপ্ত কর্মকর্তা অনেক পুলিশ নিয়ে অপেক্ষা করছেন। ওসির কাছে অভিযোগপত্র চাইলে বিচলিত ওসি কম্পিত হাতে অভিযোগের কপি এনে দেন। অভিযোগপত্রে দুজন এবং অভিযোগের বাইরে চারজন এ ছাড়া আরও দু-একজনকে ইচ্ছামতো ধরে এনেছিল। যেহেতু জামিনযোগ্য ধারা সেহেতু তখনই কোর্ট থেকে জামিনে ছেড়ে দিতে রাজি হলে আমি তাদের নিয়ে বেরিয়ে আসি। আমি চাই না এজাহারভুক্ত কোনো আসামিকে বিনা জামিনে বের করে আনতে। কারণ এক-দুই দিন আগে একটি তথাকথিত নির্বাচন হয়েছে। ভালো হোক, মন্দ হোক এই সময় দেশের কোনো রকম উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃষ্টি মোটেই ভালো না। কেউ বুঝুক আর না বুঝুক আমি বুঝি, দেশ একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। সেখানে আমাদের সবার ব্যক্তি চিন্তা না করে দেশের চিন্তা করা উচিত। তাই উত্তেজনা আর বাড়তে দিইনি। দুজনকে কোর্টে পাঠিয়ে দিয়ে বাকিদের নিয়ে বেরিয়ে এসেছিলাম। মজার ব্যাপার হলো, এজাহারবহির্ভূত একজন সাধারণ মানুষকে ধরে এনেছিল। আমার জীবনে এই প্রথম তার মুক্তিতে জিম্মাদার হয়ে স্বাক্ষর করে এসেছি। কালিহাতী থানাতে এটিই আমার একমাত্র স্বাক্ষর। বাইরে এসে লতিফ ভাইকে অনুরোধ করলে তিনি অবস্থান থেকে উঠে যান। রাস্তাঘাট স্বাভাবিক করতে এরপরও ১৫-২০ মিনিট লেগে যায়। মাঝে একবার পরাজিত প্রার্থী লাঠিসোঁটাসহ লোকজন নিয়ে অবস্থানস্থলে হামলা করতে এলে বেশ ধাক্কাধাক্কি ধস্তাধস্তি হয়। একপর্যায়ে আক্রমণকারীরা পালিয়ে যায়। আমার মনে হয় সেটাই হবে দুষ্কৃতকারীদের জন্য শেষ পালানো। কারণ এমন উচ্ছৃঙ্খল কায়কারবার এরপর কালিহাতীতে আর হবে না। 

লেখক : রাজনীতিক

www.ksjleague.com

সর্বশেষ খবর