বৃহস্পতিবার, ১৮ জানুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

সুশাসনের পথে যেতে হবে

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

সুশাসনের পথে যেতে হবে

মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার পথে থাকা, স্বপ্নে বিভোর বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সামনের দিনগুলোকে অবশ্যই সুশাসনের সঙ্গে ধনী গরিবের দূরত্ব যেমন কমাতে হবে, তেমনি সামষ্টিক অর্থনীতির সুব্যবস্থাপনায় দায়িত্বশীল হতে হবে। দরকার হবে সার্বিক উন্নয়ন প্রয়াস প্রচেষ্টার মধ্যে সুসমন্বয়ের। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ অর্থনীতির অন্তর্নিহিত শক্তি (রেজিলিয়েন্ট পাওয়ার) ও সম্ভাবনা শনাক্তকরণ যেমন জরুরি তেমনি এর  অন্তর্নিহিত দুর্বলতা, অসঙ্গতি ও অপারগতার দিকটিও আরও বেশি সচেতন সতর্কতার সঙ্গে বারবার পর্যালোচনাযোগ্য। কেননা অর্থনৈতিক উন্নয়ন শুধু ভাব-ভাবনার তথা প্রচার-প্রচারণার বিষয় হয়ে থাকলে এবং এ ব্যাপারে বাস্তব উদ্যোগ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা ও স্বচ্ছতা জবাবদিহিতার উপলব্ধি যদি অব্যাহতভাবে অমনোযোগিতার হাতে বন্দি থাকে; কিংবা প্রগলভতায় ভিন্ন খাতে প্রবাহের প্রয়াস পরিলক্ষিত হয় তা হলে স্বপ্ন দেখাই শুধু সার হচ্ছে বা হবে।

বছর বারো আগে টিআইবির এক রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছিল, সে সময় অনুষ্ঠিত তিনটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রার্থীরা অতিমাত্রায় অতিরিক্ত অর্থব্যয়ের প্রতিযোগিতায় নেমেছিলেন। মাঠপর্যায়ে (অর্থাৎ সিটি করপোরেশন এবং ওয়ার্ড পর্যায়ে) যারা ভোট প্রার্থী তারা ভোটারদের কাছে নিজেদের তুলে ধরবেন এবং ভোটাররা ভোট প্রার্থীদের অতীত ও বর্তমান অবস্থান এবং তাদের ভবিষ্যৎ কর্মসূচি বাছ-বিচার করে অবাধ ও নিরপেক্ষভাবে তাদের মতামত প্রকাশ করবেন- এটিই ছিল সবার ধ্রুপদ প্রত্যাশা। কিন্তু ভোটারদের কাছে প্রার্থীর পৌঁছানোর পদ্ধতি প্রক্রিয়াটা যদি হয় অনৈতিক ও বিব্রতকর এবং বিশেষ করে এ ব্যাপারে অতিরিক্ত আর্থিক ব্যয় সংশ্লেষের ব্যাপার ঘটে যায়, তা বেশ উদ্বেগজনক। কেননা যে কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণে প্রার্থীরা যদি বড় ধরনের আর্থিক বিনিয়োগ ও পেশি প্রদর্শন করেন তাহলে গোটা নির্বাচন প্রক্রিয়াটি মূল উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ে। আর এ জাতীয় বিচ্যুতির সুদূরপ্রসারী ক্রিয়া-প্রক্রিয়াও অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। এটি যেন এ দেশের সংস্কৃতির অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যে কোনো নির্বাচনে (এমনকি পেশাজীবী সংগঠন সমিতি কিংবা ক্লাবের নির্বাচনে) প্রার্থী ‘সৎ, মেধাবী, যোগ্য, সমাজ সেবক’ এসব বিশ্লেষণে বিভূষিত করে নির্বাচনে নিজেকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে উপস্থাপন করতে পারলেই ভোটে যেন জিতে যাবেন। সর্বত্র মনে হচ্ছে শুধু ভোটারদের টানার জন্য কে কত খরচ করতে পারবে তার প্রতিযোগিতা চলছে। সে সময় ভোটের দুই সপ্তাহ আগেই দেখা গিয়েছিল গোটা মেট্রোপলিটন পোস্টারে ছেয়ে গিয়েছে। এ বাবদ কয়েক হাজার টন কাগজ, কালি, দড়ি-রশি সবই সাবাড় হয়েছে। কিন্তু কেন? এই বিপুল ব্যয়ের টাকা কোথা থেকে এসেছে এবং পরবর্তীকালে প্রার্থীরা এ খরচ কীভাবে উসুল করতে চাইবেন। মূল প্রশ্নটি সেখানে। একজন প্রার্থীর নিজের ছবিসহ তার মার্কা কী তা জানানোর জন্য হাজার হাজার ল্যামিনেটেড পোস্টার বানানো এবং টানানোর প্রয়োজন আছে কি? এর পেছনে যে খরচ তার আয়ের উৎস এবং তা উসুলে যে পথ পন্থা ধরা হবে তা যে ‘জনসেবা মূলক’ হবে না এটা সবাই জানে। অথচ এই পরিমাণ অর্থ গঠনমূলক কোনো কাজে ব্যয় করলে সেটিই হতে পারত আসল সমাজসেবা।

মধ্যম আয়ের দেশ অভিলাষী একটি দেশে সামাজিক ও রাজনৈতিক অর্থনীতির ব্যবস্থাপনায় ‘অন্তর্ভুক্তি’র দৃষ্টিভঙ্গি বিশেষ পুষ্টিকর ও উপাদেয় এ বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই। অন্তর্ভুক্তির দর্শনকে সার্বিকভাবে টেকসই ও বাস্তবায়নযোগ্য করা উচিত। প্রশাসনে, আর্থসামাজিক পরিবেশে, সংস্থায়, প্রতিষ্ঠানে, দেশজ সংস্কৃতিতে সর্বত্র পক্ষভুক্তকরণের দৃষ্টিভঙ্গি ও বিচ্যুতকরণ ব্যবস্থাপনার উপস্থিতিতেই অন্তর্ভুক্তি উন্নয়ন দর্শন যাতে ব্যর্থতায় পর্যবসিত না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। রাষ্ট্রের সেবা ও সুবিধা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে (ক্ষেত্র বিশেষে) বিশেষ প্রাধান্য প্রাপ্তি, অর্থ ও মেধা পাচারের হলাহলপূর্ণ পরিস্থিতিতে, ব্যাংকিং খাতে অসম্ভব অন্যায় অনিয়মে প্রতিকার প্রতিবিধানে পক্ষপাতিত্ব কিংবা অপারগতার মধ্যে অন্তর্ভুক্তির মতো কার্যকর দর্শন হারিয়ে যেতে পারে না। শত শত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে দীর্ঘদিন কর্মহীন অবস্থায় বেতন-ভাতাদি আহরণ করতে হচ্ছে, ঊর্ধ্বতন পদে উন্নীত হয়েও স্বপদে কাজ করতে হচ্ছে, উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্ব ঘটার কারণে যে ৪-৫ গুণ ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে, ব্যাংকিং খাতে বড় দাগে আত্মসাৎ ও লোপাট হচ্ছে, তা তো যে কোনো বিবেচনায় ‘গুডস অ্যান্ড সার্ভিস প্রডিউস না হয়েও অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়’। এহেন অর্থনৈতিক দুর্গতির দোষ করোনা ও রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের ওপর যতই চাপানো হোক না কেন, শর্ষের মধ্যে যে ভূত তা জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থীদের হলফনামায় তাদের সম্পদ ও সম্পত্তির অতি উল্লম্ফনের মাত্রা দেখলে মনে হবে করোনা কিংবা কিয়েভ-ক্রেমলিন যুদ্ধ তাদের জন্য বরং সাপে বর হয়েছে। শত সহস্র জনের সর্বনাশে কতিপয়ের পৌষ মাস। নানান অস্থিরতায় উৎপাদন ব্যাহত হয়ে, সরবরাহে বিঘ্ন ঘটে, নানান দুর্ঘটনায় দুর্নীতিতে, অগ্নিকান্ডে, বন্যায় যে বিপুল ক্ষতি হয়, সেটিই বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি দুই ডিজিটে যাওয়ার সুযোগ ও সম্ভাবনাকে নাকচ করে দিলেও সিন্ডিকেট বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্থনীতিকে অসম্ভব নাজেহাল করে ছাড়ছে।

অন্যান্য অবস্থা অপরিবর্তিত থাকলে, উৎপাদন ও প্রবৃদ্ধি ঘটলে মানুষের কর্মসংস্থান, আয় এবং জীবনকুশলতা বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা জাগে এবং এই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আবার মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি ঘটায়। সাধারণভাবে ধরে নেওয়া হয়, জনসংখ্যা বৃদ্ধি স্থির থাকলে জাতীয় আয় বৃদ্ধি সাপেক্ষে সমাজে সবারই কিছু না কিছু আয় বৃদ্ধি ঘটে, যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে অন্য সব সমস্যার সমাধান করে দেয়। যেমন : সুপেয় পানি, স্বাস্থ্যসম্মত পয়ঃনিষ্কাশন, অসুস্থতা, শিক্ষা ইত্যাদি। উন্নয়নের জন্য অবশ্য আয় বৃদ্ধি দরকার হবে যদিও মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি ঘটলেই জনগণের উন্নয়ন ঘটবে এটা নিশ্চিত নয়; আর এ জন্যই বলা হয়ে থাকে যে, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি উন্নয়নের দরকারি শর্ত পূরণ করে, তবে যথেষ্ট শর্ত পূরণ করে না। প্রবৃদ্ধি বাড়লে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেয়ে অন্যান্য ক্ষেত্রে উন্নতি ঘটতে পারে কিন্তু প্রবৃদ্ধি ঘটা মানেই উন্নয়ন নয় এবং উন্নয়ন যেখানে আছে সেখানে অবশ্য মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি ঘটেছে বলে ধরে নিতে হবে। কিন্তু মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি ঘটেছে বলেই সেখানে উন্নয়ন ঘটেছে এ কথা জোর দিয়ে বলা যাবে না। বস্তুত প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন তখনই একসঙ্গে যেতে পারে যখন অপেক্ষাকৃত সাম্যমূলক নীতি গ্রহণ করা যায়। মোটকথা, এত দিন উন্নয়ন ডিসকোর্সে মানুষের ‘স্বত্বাধিকার’ ও সেই স্বত্বাধিকার থেকে পাওয়া ক্ষমতার দিকে খুব একটা নজর দেওয়া হয়নি অথচ ‘অর্থনৈতিক উন্নয়নের চরম লক্ষ্য হওয়া উচিত মানুষের সক্ষমতা সৃষ্টি। রোগপ্রতিরোধের অবকাঠামোগত সুবিধা, প্রতিষেধক প্রাপ্তির নিশ্চয়তা, স্বাস্থ্যসেবা, গুণগত শিক্ষা লাভের সুযোগ লাভ কি করতে পারছে, কি পারছে না, সেটাই উন্নয়ন তত্ত্বের আলোচ্য হওয়ার কথা। আমজনতা অকাল মৃত্যুকে জয় করতে পারছে? তার কী যথেষ্ট পুষ্টির ব্যবস্থা হয়েছে? সে কি পরস্পর চিন্তার আদান-প্রদান করতে পারছে বা শিখেছে? তার নীতি-নৈতিকতার বোধ বিশ্বাস শক্ত থাকছে, না ভেলকিবাজিতে ভেস্তে যাচ্ছে?

সংবিধানের প্রস্তাবনায় ‘আমরা, বাংলাদেশের জনগণ’ বলে যাদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, সেসব জনগণই বড় কথা। এই মানুষের দায়িত্ব বোধের দ্বারা কর্তব্য কর্ম সুচারুরূপে সম্পাদনের মাধ্যমে সমাজ সমৃদ্ধি লাভ করে। আবার কতিপয় মানুষের দায়িত্বহীনতার কারণে সমাজের সমূহক্ষতি সাধিত হয়। মানব সম্পদ না হয়ে সমস্যায় পরিণত হলে সমাজের অগ্রগতি তো দূরের কথা, সমাজ মুখথুবড়ে পড়তে বাধ্য। মানুষের উদ্ভাবনী শক্তি সভ্যতার বিবর্তনে সহায়ক হয়। মানুষের সৃষ্ট দুর্ভিক্ষ, দুর্নীতি, যুদ্ধ কিংবা মারণাস্ত্রে মানুষের ধ্বংস অনিবার্য হয়ে ওঠে। মানবতার জয়গান মানুষই রচনা করে আবার মানবভাগ্যে যত দুর্গতি তার স্রষ্টাও সে। মানুষের সৃজনশীলতা, তার সৌন্দর্যজ্ঞান, পরস্পরকে সম্মান ও সমীহ করার আদর্শ অবলম্বন করে সমাজ এগিয়ে চলে। পরমত সহিষ্ণুতা আর অন্যের অধিকার ও দাবির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার মাধ্যমে সমাজে বসবাস করার পরিবেশ সৃষ্টি হয়। সুতরাং সবার সহযোগিতা ও সমন্বিত উদ্যোগে সমাজ নিরাপদ বসবাসযোগ্য হয়ে ওঠে। সমাজবিজ্ঞানীরা তাই মানুষের সার্বিক উন্নয়নকে দেশ জাতি রাষ্ট্রের সব উন্নয়নের পূর্বশর্ত সাব্যস্ত করে থাকেন। সমাজের উন্নতি, অগ্রগতি ও কল্যাণ সৃষ্টিতে মানুষের সার্বিক উন্নতি অপরিহার্য শর্ত। আগে সমাজ না আগে মানুষ এ বিতর্ক সর্বজনীন। আলোকিত মানুষ ছাড়া মনুষ্য সমাজের প্রত্যাশা বাতুলতামাত্র। সুতরাং একেকটি মানুষের উন্নতি সবার উন্নতি, সমাজের উন্নতি। একেক মানুষের দায়িত্ববোধ, তার কান্ডজ্ঞান তার বৈধ-অবৈধতার উপলব্ধি এবং ভালোমন্দ সীমা মেনে চলার চেষ্টা প্রচেষ্টার মধ্যে পরিশীলিত পরিবেশ গড়ে ওঠা নির্ভর করে। রাষ্ট্রে সব নাগরিকের সমান অধিকার এবং দায়িত্ব নির্ধারিত আছে। কিন্তু দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতা অধিকার আদায়ের সম্ভাবনা ও সুযোগকে নাকচ করে দেয়। পণ্য ও সেবা সৃষ্টি না হলে চাহিদা অনুযায়ী ভোগের জন্য সম্পদ সরবরাহে ঘাটতি পড়ে। মূল্যস্ফীতি ঘটে সম্পদ প্রাপ্তিতে প্রতিযোগিতা বাড়ে। পণ্য ও সেবা সৃষ্টি করে যে মানুষ সেই মানুষই ভোক্তার চাহিদা সৃষ্টি করে।  উৎপাদনে আত্মনিয়োগের খবর নেই- চাহিদার ক্ষেত্রে ষোলোআনা- টানাপোড়েন তো সৃষ্টি হবেই। অবস্থা ও সাধ্য অনুযায়ী উৎপাদনে একেকজনের দায়িত্ব ও চাহিদার সীমারেখা বেঁধে দেওয়া আছে কিন্তু এ সীমা অতিক্রম করলে টানাপোড়েন সৃষ্টি হবেই, বৈষম্য বাড়বেই। ওভারটেক করার যে পরিণাম দ্রুতগামী বাহনের ক্ষেত্রে, সমাজে সম্পদ অর্জন ও ভোগের ক্ষেত্রে সীমা অতিক্রমণে একই পরিবেশ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়ে থাকে। সমাজে অস্থিরতা ও নাশকতার যতগুলো কারণ এ যাবৎ আবিষ্কৃত হয়েছে তার মধ্যে এই সম্পদ অবৈধ অর্জন, অধিকার বর্জন এবং আত্মত্যাগ স্বীকারে অস্বীকৃতি মুখ্য।

♦ লেখক : সরকারের সাবেক সচিব এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর