বৃহস্পতিবার, ১৮ জানুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

বৈরাম খাঁর ভাগ্যলিপি ও ক্ষমতার রাজনীতি

হোসেন আবদুল মান্নান

বৈরাম খাঁর ভাগ্যলিপি ও ক্ষমতার রাজনীতি

ভারতবর্ষের ইতিহাসের আলোয় ওঠে আসা এক চিরঅনুগত, বিশ্বস্ত ও কৃতজ্ঞ সেনাপতির নাম বৈরাম খাঁ। ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন আর বৈরাম খাঁ যেন এক সূত্রে বাঁধা বিচিত্র কাহিনির অংশবিশেষ। বৈরাম খাঁ ১৫০১ সালে আফগানিস্তানে জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র ১৬ বছর বয়সে সম্রাট বাবরের সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে বাদশার বিশেষ নিরাপত্তা শাখায় কাজ শুরু করেছিলেন। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, বৈরাম খাঁ মুঘলদের তিন পুরুষের রাজ কর্মচারী।  কখনো সৈনিক, কখনো প্রধান সেনাপতি আবার কখনো অভিভাবক উপদেষ্টা। অর্থাৎ প্রথম মুঘল সম্রাট জহিরুদ্দিন মুহাম্মদ বাবর তার পুত্র নাসিরুদ্দিন মুহাম্মদ হুমায়ূন এবং তার অপ্রাপ্ত বয়স্ক পুত্র জালালুদ্দিন মুহাম্মদ আকবরের প্রধান সেনাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মৃত্যুঅবধি তিনি মুঘল সম্রাটদের প্রতি অভূতপূর্ব বিশ্বস্ততার নজির স্থাপন করেছিলেন। 

২. সাহিত্যের পরে ইতিহাসই আমাকে তুলনামূলক বেশি টানে। এর পরে আসে রাজনীতি বিজ্ঞান। ছাত্রাবস্থায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করলেও সুদূর বা নিকট অতীত ইতিহাসের নানা বাঁকবদল, উত্থান-পতন আমাকে বরাবরই তাড়িত ও প্রাণিত করে। যদিও একটা বহুল প্রচলিত আপ্তবাক্যের মর্মার্থ হলো যে, ‘ইতিহাসের সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো, মানুষ ইতিহাস থেকে কিছু শিক্ষা নেয় না।’ ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটা নিয়ে তো সব সময়ই কথা ওঠে। প্রতিনিয়ত চায়ের বাটিতে ঝড় ওঠে। সত্যি হলো- ইতিহাস ইতিহাসই, এর প্রবহমানতা ঠেকানো যায় না। এ চাকা কালের যাত্রায় নিরন্তর ঘূর্ণায়মান।

৩. বৈরাম খাঁ ইতিহাসের এক হতভাগ্য ও বিস্মৃতপ্রায় শিয়া মুসলিম সেনাপতির নাম। ঐতিহাসিক জহুর আবতাবচির মতে-বৈরাম খাঁর পূর্ব পুরুষরা যোদ্ধা হিসেবে পরিচিত ছিল। তারাও কয়েক দশক ধরে পারস্য শাসন করেছিলেন। স্থল যুদ্ধের কলাকৌশল তাঁর ধমনি ও রক্তের ভিতরই প্রবাহিত ছিল। একজন অকুতোভয় সাহসী সেনানী, আস্থাভাজন বীর ও বিজ্ঞ কূটনীতিক হিসেবে তিনি ছিলেন অতুলনীয়। ১৫৩৯ সালে সুরবংশীয় আফগান শেরশাহর সঙ্গে চৌসার যুদ্ধে পরাজিত হয়ে দিল্লির তথা হিন্দুস্থানের সম্রাট হুমায়ূন যখন পারস্যে নির্বাসিত জীবনে, তখন তাঁর বিশ্বস্ত সহচর হিসেবে দুঃসময়ের সারথী হয়েছিলেন বৈরাম খাঁ। মূলত আপন ভাই কামরান মির্জার দুঃশাসন ও বিশ্বাসভঙ্গের কারণে সিংহাসনচ্যুত হলেন হুমায়ূন। তখন শত-সহস্র প্রলোভনকে তুচ্ছজ্ঞান করে এ সেনাপতি নিঃস্ব সম্রাটকে পরিত্যাগ করে যাননি।

হুমায়ূন ছিলেন সাধু সন্ন্যাসীর মতো কবি, আবেগী, বিশ্বপ্রেমিক, প্রকৃতির উপাসকধর্মী মানুষ। চরম দুঃসময়েও সৃষ্টিকর্তার প্রতি তিনি শতভাগ আস্থাশীল ছিলেন। ধার্মিক, ন্যায়পরায়ণ, ধৈর্যশীল ও সাহসী মানুষ হিসেবে তাঁর পরিচিতি ছিল। পরহেজগার মুসলমান বলেও ইতিহাসে তাঁর স্বীকৃতি আছে। যদিও কোনো কোনো ইতিহাসবিদ তাঁকে আফিমখোর ও নেশাগ্রস্ত হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। বৈরাম খাঁ এ মানবিক ও সংবেদনশীল সম্রাটকে কখনো ছেড়ে না গিয়ে বরং দিনের পর দিন বছরের পর বছর অমানুষিক শ্রম আর মেধার অনুশীলনে হুমায়ূনকে পুনরায় দিল্লির সিংহাসনে আসীন করিয়ে দিয়েছিলেন। যার পেছনের অনেক কিছুই সম্রাটের জানা ছিল না। তার ছিল কেবল আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা আর শের রচনার নেশা। শ্রুতি আছে, তার স্ত্রী হামিদা বানু বাসর রাতেই বলেছিলেন, ‘আপনি দুর্বল সম্রাট কিন্তু সবল কবি।’ বুদ্ধিমান চৌকশ বৈরাম খাঁ-ই নেপথ্যে কাজ করে সৈন্যবাহিনী পুনর্গঠনসহ সব রণনীতি, রণকৌশল বাস্তবায়ন করে গেছেন।

৪. ১৫৪২ সালের ১৫ অক্টোবর। সিন্ধু প্রদেশের অমরকোট শহরে জন্ম নেয় হুমায়ূনের পুত্র জালালুদ্দিন মুহাম্মদ আকবর। সদ্য জন্ম নেওয়া শিশুপুত্র ও স্ত্রী হামিদা বানুর খাদ্য, নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্বও ছিল বৈরাম খাঁর ওপর। তার কৌশলেই শিশুপুত্র ও তার মাতা জীবন ফিরে পায় এবং শেষ পর্যন্ত সম্রাট হুমায়ূনের কাছে ফিরে যেতে পারে। কাবুল দুর্গে কামরান মির্জার একাধিকবার হামলা থেকে আকবর ও তাঁর মাকে রক্ষা করেছিলেন বৈরাম খাঁ। তাদের অক্ষত রাখাই ছিল তখন তাঁর মূল কাজ। অথচ একই হামলায় হুমায়ূনের আরেক ছোট ভাই মির্জা হিন্দাল কামরান মির্জার হাতে প্রাণ হারায়। হিন্দাল বড় ভাই হুমায়ূনের প্রতি জীবন দিয়ে আনুগত্য রক্ষা করে গেছেন। বৈরাম খাঁ লাহোর ও কাবুল দুর্গ দখল করে মির্জা আসকারিকে গ্রেফতার করেছিলেন। কথিত আছে, বৈরাম খাঁ আসল সম্রাট হুমায়ূনকে অসুস্থ অবস্থায় তাঁবুতে নিরাপদে রেখে যুদ্ধক্ষেত্রে নকল হুমায়ূন বানিয়ে শেরশাহের পুত্র সিকান্দার শাহকে পরাজিত করে দিল্লির সিংহাসন পুনর্দখল করে নিয়েছিলেন। পরে একই চেহারার এ মানুষটিকে দেখে সম্রাট হুমায়ূন জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘তুমি কে’? জবাবে সে বলেছিল, ‘আমি একজন মুচি, পাদুকা সেলাই করি।’

হুমায়ূন আবার জিজ্ঞেস করেন, তোমার স্ত্রীর নাম কী?

সে বলে, ‘গোস্তাকি মাফ করবেন জাঁহাপনা, আমার স্ত্রীর নাম হামিদা।’

এবার হুমায়ূন বললেন, ‘কী আশ্চর্য, একই চেহারার দুজন মানুষ, একজন সম্রাট, অপরজন পাদুকা সেলাই করে।’

তিনি একটা শের রচনা করলেন,

‘বিশ্বের বিপুল রহস্যের

আমরা যেটুকু জানি...

তা-ও রহস্যে ঢাকা।’

৫. আমাদের কথাসাহিত্যের প্রবাদ পুরুষ হুমায়ূন আহমেদ তার ‘বাদশা নামদারে’ বলেছেন, “প্রায় ১৫ বছর পরে ২৩ জুলাই ১৫৫৫ সালে হুমায়ূন হিন্দুস্থানের অধিপতি হয়ে দিল্লির সম্রাট হিসেবে পুনঃ অভিষিক্ত হন। তার ডান পাশে শিশুপুত্র আকবর। তার মাথায় পাগড়ি পরানো। সে পাগড়ি খুলে তা নিয়ে খেলা করছে। আমিররা একে একে এসে সম্রাটের হাত চুম্বন করলেন। সবার পরে এলেন বৈরাম খাঁ। হুমায়ূন সিংহাসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। বৈরাম খাঁকে চমকে দিয়ে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। তিনি ঘোষণা করলেন, বৈরাম খাঁকে আমি খান ই খানান (রাজাদের রাজা) সম্মানে সম্মানিত করছি। আমার শরীর ভালো যাচ্ছে না। হঠাৎ মারা যেতে পারি। এমন কিছু ঘটলে নকল হুমায়ুন দিয়ে সিংহাসন রক্ষা করতে হবে না। আমার অবর্তমানে উনিই হবেন আকবরের অভিভাবক। আকবর বয়োপ্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত বৈরাম খাঁর নির্দেশে হিন্দুস্থান চলবে।”

৬. ১৫৫৬ সালের ১৪ জানুয়ারি মাত্র ১৩ বছর বয়সে বৈরাম খাঁ আকবরকে সিংহাসনে বসালেন। একই বছর ৫ নভেম্বর পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধ সংঘটিত হয়। তৎকালে আদিল শাহের প্রধানমন্ত্রী হিমুর নেতৃত্বে হিন্দু রাজারা কিছুদিনের জন্য দিল্লি দখল করে রেখেছিল। আকবর তখন কিশোর। তার প্রধান অভিভাবক ও সেনাপতি বৈরাম বেগ বা বৈরাম খাঁকে নিয়ে দিল্লি যাত্রা করেন। সেদিন  মুঘল বাহিনীর প্রচন্ড আঘাতে হিমুর চোখ নষ্ট হয়ে যায় এবং তার বিরাট বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। বৈরাম খাঁর নেতৃত্বেই এদের পরাজয় ঘটে এবং হিমুকে বন্দি করে আকবরের দরবারে হাজির করা হয়। এভাবেই দিল্লি শহর পুনরুদ্ধার হয়।

বৈরাম খাঁ ১৪ বছর বয়সের কিশোর সম্রাটকে নিজের হাতে প্রশিক্ষিত করে গড়ে তুলতে শুরু করেন। সাম্রাজ্য রক্ষা, যুদ্ধের কলাকৌশল, শত্রুদের মোকাবিলা করা, কর আরোপ, ধৈর্য- সহিষ্ণুতার পরীক্ষা ইত্যাদি। উল্লেখ্য, সম্রাট হুমায়ূনের জীবদ্দশায় তার নির্দেশেই তিনি হিন্দুস্থানের কর্তৃত্ব গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু সম্রাটের মৃত্যুর পর কিছুদিনের মধ্যেই আমিরদের ভিতরে অসন্তোষ দানা বাঁধতে থাকে। দুয়েক জায়গায় অভ্যন্তরীণ যুদ্ধও সংঘটিত হতে থাকে। এবং এসবের জন্য বৈরাম খাঁকে দায়ী করা হচ্ছিল। এদিকে আকবরের মা হামিদা বানুও শঙ্কিত বোধ করছিলেন বৈরাম খাঁ হয়তো আর ক্ষমতা ছাড়বেন না এবং তাঁর পুত্র আকবরকে পুতুল বানিয়ে রাখবেন। সিংহাসনে আসীন হওয়ার পর থেকেই কুচক্রীরা আকবরের কানে নানা সংবাদ পৌঁছাতে থাকে। এমনকি যুদ্ধ বাধিয়ে বৈরাম খাঁকে বন্দি করা হয়। এক পর্যায়ে তরুণ সম্রাট আকবর তাঁর অভিভাবক বৈরাম খাঁকে বললেন, ‘আপনি মুঘল রাজবংশের জন্য অনেক করেছেন, আপনার পরিশ্রমেই আজ দিল্লি আমাদের। তবে আপনার এখন বিশ্রাম প্রয়োজন।’

বৈরাম খাঁ : ‘তাহলে আপনি কি মনে করছেন এখন আমাকে আর আপনার প্রয়োজন নেই?’

আকবর : ‘আমার প্রয়োজনের চেয়ে আপনার বিশ্রাম বেশি জরুরি।’

বৈরাম খাঁ : ঠিক আছে আমি বিশ্রামে যাচ্ছি এবং দায়িত্ব বুঝিয়ে দিচ্ছি।

আকবর বললেন, ‘আপনার বিশ্রাম হিন্দুস্থানে নয়, হবে মক্কায়।’

বৈরাম খাঁর জবাব : ‘আমি নিজের ইচ্ছায় মক্কা না গেলে আপনি জোর করে তা পারবেন না। কারণ বিশাল মুঘল বাহিনীর আমি প্রধান এবং সৈন্যরা আমার অনুগত। তবুও আপনার ইচ্ছায় আমি মক্কায় যাব।’

৭. বৈরাম খাঁ ভগ্ন হৃদয় আর বিষণ্ণ বদনে মক্কায় রওনা হলেন। তার দুঃখবোধ একটাই, যে মুঘল সাম্রাজ্যের জন্য সারা জীবন উজাড় করে দিয়েছেন এবং বারবার অপরাজেয় বীরের তকমায় ভূষিত হয়েছেন। আজ পড়ন্ত বেলায় সেখান থেকেই পরাজিত এবং বিতাড়িত তিনি!

১৫৬০ সাল। বৈরাম খাঁ হজব্রত পালনের উদ্দেশে মক্কায় যাত্রা করলেন। পথে গুজরাটের কাছে পাটানে এক গুপ্ত ঘাতকের হাতে নিহত হন।  ইতিহাস বলে, ‘আকবর দ্য গ্রেট’-এর প্রেরিত গুপ্তচরই তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল। আসলে যুগ যুগ ধরে এ পৃথিবী শুধু ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করেই চলেছে।

♦ লেখক :  গল্পকার ও কলামিস্ট

সর্বশেষ খবর