বৃহস্পতিবার, ১৮ জানুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

যে সমুদ্রের তীর নেই

আফতাব চৌধুরী

যে সমুদ্রের তীর নেই

প্রকৃতির এক অনবদ্য সৃষ্টি লাগিয়ে আছে উত্তর আটলাণ্টিক মহাসাগরে। এর একটি তীর বিহীন সাগর আছে যার নাম ‘সারগাসো’ সাগর। তীরের বদলে সাগরটিকে তীরে আছে আটলান্টিক মহাসাগরের চার ধরনের স্রোত।

সারগাসো সাগরই পৃথিবীর একমাত্র সমুদ্র যার কোনো তীর নেই। সাগরটির পশ্চিমে আছে গাল্ফ স্ট্রিম, উত্তরে আটলান্টিক কারেন্ট, পূর্বে ক্যানারি কারেন্ট এবং দক্ষিণে নর্থ-ইকুয়েটরিয়াল কারেন্ট। ওই চারটি স্রোত চক্রাকারে ঘুরে চলেছে অবিরাম। চারটি স্রোতের মাঝে থাকা সারগাসো সাগরের পানি স্থির ও প্রবাহহীন, তাই উত্তাল আটলান্টিক মহাসাগরের সবচেয়ে শান্ত অঞ্চল সারগাসো সাগর। এটি দৈর্ঘ্যে ৩ হাজার ২০০ কিলোমিটার এবং প্রস্থে প্রায় ১ হাজার ১০০ কিলোমিটার। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১০৯০ খ্রিস্টাব্দে আল- মোরাভিদ সাম্রাজ্যের সুলতান আলি ইবন ইউসুফ একটি জাহাজ পাঠিয়েছিলেন ওই এলাকায়। জাহাজে ছিলেন বিখ্যাত মানচিত্র- নির্মাতা মহম্মদ আল-ইদ্রিসি। তিনি সাগরটির মানচিত্র নির্মাণ করেছিলেন। 

সারগাসো সাগরকে রহস্যের খনি বলে বর্ণিত হয়েছিল অনেক বিখ্যাত উপন্যাসে। চতুর্থ শতাব্দীর লেখক রাফাস ফেস্টাস অ্যাভেনিয়াসের লেখায় ওই সাগরের উল্লেখ পাওয়া যায়। উইলিয়াম হোপ হজসনের লেখা উপন্যাস ‘দ্য বোট অব দ্য গ্লেন ক্যারিগ’ ভিক্টর অ্যাপেলটনের লেখা  ‘ডন টার্ডি ইন দ্য পোর্ট অব লস্ট শিপ্স’, জুলে ভার্নের লেখা ‘টোয়েন্টি থাইল্যান্ড লিগস আন্ডার দ্য সি’ উপন্যাস ছাড়াও আরও অসংখ্য উপন্যাস ও গল্পে সারগাসো সাগরের কথা লেখা আছে।

এর নাম সারগাসো দিয়েছিল পর্তুগিজরা। সাগরের বুকে তারা দেখেছিল সারগাসম নামে সামুদ্রিক শৈবালটির অস্বাভাবিক প্রাচুর্য। তাই তারা শৈবালটির নামেই সাগরটির নাম দিয়েছিল সারগাসো। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে জাহাজের নাবিকদের কাছে মূর্তিমান বিভীষিকা হয়ে আছে সারগাসো সাগরটি।

 

 সাগরটির কোনো কোনো জায়গায় শৈবালের স্তর এতই পুুরু হয়, সেখান দিয়ে জাহাজ চলাচল করতে পারে না। এ ছাড়া পানির স্রোত না থাকায় স্রোতের সাহায্যও পায় না জাহাজ। ওইসব জায়গা দিয়ে জাহাজ চালাতে গেলে জাহাজের প্রপেলারে শ্যাওলা জড়িয়ে প্রপেলার বন্ধ হয়ে যায়। একই জায়গায় আটকে থাকে জাহাজ। উন্মত্ত বাতাসের ঝাপটায় দুলতে শুরু করে। ছোট বোট হলে ডুবে যায়।

কিšুÍ আটলান্টিকের মধ্যে কী করে এসেছে এত শৈবাল!  আসলে সারগাসো সাগরটিকে চারদিক থেকে ঘিরে  রাখা পানির স্রোতই বয়ে নিয়ে এসেছিল সামুদ্রিক শৈবাল। সেগুলো জমা করেছিল সারগাসো সাগরের বুকে। এখনো প্রতিনিয়ত জমা করে চলেছে। এভাবেই সারগাসো সাগর একদিন হয়ে উঠেছিল ‘শৈবাল সাগর’। শৈবালের- ফাঁদে পড়ে পানি হয়ে উঠেছিল স্রোতহীন ও শান্ত।

৩৫ লাখ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে থাকা সারগাসো সাগরের পানি অস্বাভাবিক রকমের স্বচ্ছ। পানির রং ঘন নীল। উজ্জ্বল দিনে পানির নিচে ২০০ ফুট পর্যন্ত দৃষ্টি চলে যায়। আটলান্টিক মহাসাগরের মধ্যে সবচেয়ে লবণাক্ত অঞ্চলও এই সারগাসো সাগর।

সারগাসো সাগরে দেখতে পাওয়া যায় জৈববৈচিত্র্যের প্রাচুর্য। খাদ্যের বিপুল সম্ভার এবং শ্যাওলার আড়ালে লুুকিয়ে থাকা সুবিধাজনক বলে বিভিন্ন প্রকার সামুদ্রিক প্রাণী বাস করে ওই সারগাসো সাগরে। ডিম পাড়ার সময় আটলান্টিকের বিভিন্ন জায়গা থেকে সারগাসো সাগরে চলে আসে আমেরিকান ও ইউরোপীয় ইলের দল। তবে মানুষের জন্যই আজ প্লাস্টিকের ডাস্টবিন হয়ে উঠেছে সারগাসো সাগর। দূষণ ছড়াচ্ছে সারগাসো সাগর থেকে চারদিকের জলস্রোতে। এর ফলে আটলান্টিক মহাসাগর জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে দূষণ।

তবে পর্তুগালের স্বশাসিত আজোর দ্বীপপুঞ্জ, বারমুডা, মোনাকো, ব্রিটেন আমেরিকাকে নিয়ে ২০১৪ সালের ১১ মার্চ গড়ে উঠেছে ‘সারগাসো সি কমিশন’। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকে সঙ্গে নিয়ে ওই কমিশন ঝাঁপিয়ে পড়েছে সারটিকে বাঁচাতে।

♦ সাংবাদিক-কলামিস্ট

 

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর