শুক্রবার, ১৯ জানুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

ইমানের পর শ্রেষ্ঠ ইবাদত নামাজ

আল্লামা মাহ্‌মূদুল হাসান

নামাজ আল্লাহপাকের এক মহান বিধান, যা তিনি সব উম্মতের ওপর ফরজ করেছেন। নামাজ হলো সর্বোত্তম ইবাদত; ইমানের পরই যার স্থান। যেমন হাদিসপাকে এসেছে- একদা নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হলো সর্বোত্তম আমল কী? তিনি উত্তরে বললেন, আল্লাহপাকের প্রতি ইমান আনা। এরপর জিজ্ঞেস করা হলো তারপর সর্বোত্তম আমল কী? তিনি বললেন, নামাজ পড়া।

যে আমল সবচেয়ে উত্তম সে আমল বিনষ্ট করতে শয়তান সবচেয়ে বেশি তৎপর থাকে। তাইতো নামাজের মতো মহান আমলকে নষ্ট করার জন্য শয়তান বিভিন্নভাবে ধোঁকা দিয়ে থাকে। নামাজির অন্তরে নানা ধরনের ওয়াসওয়াসা আসা শয়তানের ধোঁকার অংশ। এ ছাড়াও সে নামাজির মনকে অস্থির করে তোলে। ফলে নামাজে মন বসে না।

নামাজে ওয়াসওয়াসা দুই কারণে হয়ে থাকে। (ক) অভ্যন্তরীণ কারণ, (খ) বহিরাগত কারণ। অভ্যন্তরীণ কারণের মাঝে মূল হলো নফসে আম্মারাহ বা কুপ্রবৃত্তি। তিন ধরনের নফসের সমন্বয়ে মানুষ। (১) নফসে মুতমাজিন্নাহ : এটা মানুষকে সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখতে সচেষ্ট থাকে। কোনো খারাপ বা অপছন্দনীয় কাজ দেখলেই মানুষের বিবেক ধাক্কা দেয়, এর দ্বারা মানুষ গুনাহ থেকে বেঁচে থাকে।

(২) নফসে লাওয়ামাহ : এটা ভালো কাজের আদেশ করতে পারে না এবং খারাপ কাজ থেকে বিরতও রাখে না, বরং ইমান রক্ষার জন্য কঠিন, গুনাহ, অসত্য ও ভ্রান্ত আকিদাহ থেকে বাঁচিয়ে রাখে।

(৩) নফসে আম্মারাহ : এটা শুধু খারাপ ও হীন কাজের আদেশ দিয়ে থাকে। এটা মানুষকে একেবারে ধ্বংস করে দেয়। ‘আমর’ অর্থ আদেশ। ‘আম্মারাহ’ এটা মুবালাগার ছিগা। অর্থ হলো বেশি বেশি খারাপ কাজের আদেশদাতা। প্রত্যেক মানুষের মাঝে এ তিন প্রকারের নফস বিদ্যমান থাকে। যার মাঝে যে নফস প্রবল থাকে, সে ওই নফসের অনুকরণে কাজ করে থাকে।

যার নফসে মুতমাজিন্না প্রবল

যার নফসে মুতমাজিন্না প্রবল থাকবে আলহামদুলিল্লাহ তার পরিণতি ভালো হবে। সে খারাপ কাজ করবে না। সর্বদা তার দৃষ্টি ভালো কাজের প্রতিই থাকবে। হঠাৎ কখনো খারাপ কিছু হয়ে গেলে পরক্ষণেই তার মাঝে হুঁশ আসবে এবং অনুতপ্ত হবে। নফসে আম্মারাহ তাকে কিছুই করতে পারবে না।

আর যার মাঝে নফসে লাওয়ামাহ প্রবল থাকে, সে গুনাহে লিপ্ত হয়, আবার কখনো কখনো ভালো কাজও করে। গুনাহে লিপ্ত হলেও ইমানকে রক্ষা করে। পক্ষান্তরে ‘নফসে আম্মারাহ’ যার মাঝে প্রবল থাকে, সে ধ্বংসের একেবারে কাছে এসে যায়। এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে কারিমে আছে- ‘নিঃসন্দেহে নফস খারাপ ও হীন কাজের আদেশ দিয়ে থাকে।’ এখানে নফস দ্বারা নফসে আম্মারাহকেই বোঝানো হয়েছে।

ক্ষতির দিক দিয়ে নফসে আম্মারাহ শয়তান থেকেও মারাত্মক। কেননা শয়তান আগে ভালো ছিল। তার সমপরিমাণ আমল কেউ করতে পারেনি। শয়তান আল্লাহপাকের অতি নৈকট্য অর্জন করেছিল। এত নৈকট্য অর্জন করা সত্ত্বেও তাকে বিতাড়িত ও বঞ্চিত করেছে নফসে আম্মারাহ। সে হয়ে গেল কেয়ামত পর্যন্ত অভিশপ্ত, সমস্ত সৃষ্টজীবের মাঝে লাঞ্ছিত। মোটকথা শয়তানকে শয়তান বানাল নফসে আম্মারাহ। যার পেছনে পড়ে আজ অসংখ্য বুজুর্গও ধ্বংসের শিকার হচ্ছেন। এ কুপ্রবৃত্তি যুবকাবস্থায় সবচেয়ে বেশি দেখা দেয়। ১৫ থেকে ৩০ বছর বয়সকালটাই অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এ বয়সে মানুষ নিজেকে সামলাতে পারে না। মন যা চায় তাই বাস্তবায়িত করে। শত অপরাধ করতে অনীহা করে না। বরং অপরাধে জড়িত হয়েও নিজেকে নিখুঁত-নির্দোষ মনে করে। শরীরে থাকে পূর্ণ যৌবন। অন্য কেউ কিছু বলারও হিম্মত করে না। এ সময় প্রত্যেক মানুষ নিজেকে স্বাধীন মনে করে, কারও কাছে মাথা নত করতে চায় না।

এ সময় নিজেকে সামলাতে না পারলে ধ্বংস অনিবার্য। সুতরাং জীবন রক্ষার্থে নিজেকে সামলাতেই হবে। আর সামলানোর পন্থা হলো জীবনের দিকনির্দেশক হিসেবে শায়েখ তথা মুরুব্বি নির্বাচন করা। তবে মুরুব্বি নির্বাচন করার আগে ভালোভাবে যাচাই-বাছাই করে নেবে; কাউকে নির্বাচন করার পর যেন অভক্তির দরুন বর্জন করতে না হয়। মুরুব্বি নির্বাচন করার পর তার উপদেশ ও পরামর্শ অনুযায়ী চলতে হবে। তাহলেই জীবনের সাফল্যের রাস্তা খুঁজে পাওয়া যাবে, অন্যথায় ধ্বংসের রাস্তাই সুগম হবে। আমাদের আলোচনা ছিল নামাজে শয়তানের ধোঁকা সম্পর্কে। এতক্ষণ প্রথম প্রকারের আলোচনা হয়েছে। দ্বিতীয় প্রকার হলো-

(খ) বহিরাগত কারণ : বাইরে ঘোরাফেরার দরুন মুসল্লি নামাজে অমনোযোগী ও অন্যমনস্ক হয়ে থাকে। দিনরাত রাস্তাঘাটে ঘোরাফেরার দরুন অসংখ্য দৃশ্য পরিলক্ষিত হয়, নামাজে দাঁড়ালে ওইসব দৃশ্য ভেসে ওঠে। বর্তমান যুগে বাইরে ঘোরাফেরা করে ইমান রক্ষা করা অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার। রাস্তাঘাটে যেদিকেই তাকানো হয়, অসংখ্য নারীর ছবি ও চিত্র চোখের সামনে পড়ে।

বর্তমান সমাজ যে কত অধঃপতনের দিকে ধাবিত হচ্ছে, তা কল্পনাতীত। অশ্লীল পত্রিকা ও রাস্তাঘাটে লাগানো নগ্নচিত্র দেখে সমাজের যুবক-যুবতীরা নৈতিক ধ্বংসের পথে এগোচ্ছে। মুসলমানদের এ দেশে আজ যা হচ্ছে, তা সৎ মানুষের অন্তরের ব্যথাই বাড়িয়ে দেয়। দীনের দাওয়াতের কাজকে আরও বেগবান করতে হবে। নয়তো মুসলমানদের সামনে ভবিষ্যতে ভয়াবহ পরিস্থিতি দেখা দেবে। যাই হোক, দিনভর ঘোরাফেরা করে যা কিছু দর্শন করেছে, নামাজে দাঁড়ালে ওইসব চিত্রই মনে ভেসে ওঠে। এতে বিভিন্ন ধরনের ওয়াসওয়াসা থেকে থাকে। এ ওয়াসওয়াসা থেকে রক্ষা পেতে চাইলে বাইরে ঘোরাফেরা বন্ধ করতে হবে। মানুষের ব্রেন হলো ক্যামেরার মতো। ক্যামেরা যেমন সামনে যা পড়ে সবকিছুকে হুবহু ধারণ করে থাকে, মানুষের স্মরণশক্তিও তদ্রƒপ, সামনে যত দৃশ্য পড়ে সবকিছু হৃদয়ে অঙ্কিত হয়ে থাকে। তাই অপরিহার্য প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের হওয়া অনুচিত। যদি ধারণা হয় যে, বাইরে গেলে অপদৃষ্টি হবে, তাহলে সামান্য প্রয়োজনেও বাইরে যাওয়া ঠিক হবে না। কেননা গুনাহমুক্ত থাকাকে লাভের ওপর প্রাধান্য দিতে হবে।

তবে অবস্থা যদি এমন হয় যে, বাইরে বের হতেই হবে, যেমন- প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনার কেউ নেই, তাহলে অপদৃষ্টির সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বাইরে বের হওয়া যাবে।  তবে অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে। কেননা ছোট ছোট গুনাহ থেকেই বড় বড় গুনাহের সৃষ্টি হয়ে থাকে, যেমন ছোট ছোট অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বিশাল অগ্নিকুন্ডে পরিণত হয়। এক বুজুর্গ বলেন, ছোট অগ্নিস্ফুলিঙ্গ থেকে যেমন বড় আগুনের সৃষ্টি, তেমনই অপদৃষ্টি থেকে সব গুনাহের সৃষ্টি। তীর ভেদ করার মতো অনেক অপদৃষ্টি দ্রষ্টার অন্তর ভেদ করেছে।

লেখক : আমির, আল হাইআতুল উলয়া ও বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ

সর্বশেষ খবর